হঠাৎ যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বরে প্রত্যুত্তরটা বজ্রের মতই ঘোষিত হল, গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটী বলে, শকুনিবাবু, দুঃস্বপ্নই হোক বা অন্য কিছুই হোক, নিষ্ঠুর নির্মম সত্য হয়েই ব্যাপারটা গতকাল রাত্রে কিন্তু প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে।
অ্যাঁ! কি বলছেন আপনি? কতকটা যেন একটা চাপা আর্ত কণ্ঠেই শকুনি ঘোষ কথা উচ্চারণ করে বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সম্মুখে দণ্ডায়মান কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ, সত্যিসত্যিই গতকাল ঠিক রাত্রি চারটের সময়েই আপনার মামা রায়বাহাদুর নিহত হয়েছেন।
বলেন কি মিঃ রায়! সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। তিনি নিহত হয়েছেন।
আমি—আমি যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ রায়। মামা নিহত হয়েছেন? কে-কে তাঁকে হত্যা করল?
নিহত যখন হয়েছেন নিশ্চয়ই তখন কেউ না কেউ তাঁকে হত্যা করেছে এ অবধারিত।
মামা নেই! সহসা শকুনি ঘোষের দুটি চোখ অশ্রুতে টলমল করে এবং কং ষরটা যেন বুজে আসে।
কিরীটী নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শকুনি ঘোষের মুখের দিকে, অশ্রুপ্লাবিত তার দুটি চোখের দিকে।
বেদনাক্লিষ্ট অশ্রুসিক্ত দুটি চোখের দৃষ্টি ও সমগ্র মুখখানি যেন সত্যিই বিষণ্ণ-কাতর একটি অনির্বচনীয় ভাবাবেগে নিবিড় হয়ে উঠেছে।
রায়বাহাদুরের হত্যাসংবাদটা যে একান্ত মর্মান্তিক ভাবেই শকুনি ঘোষকে একটা আঘাত দিয়েছে সে বিষয়ে যেন কোন সন্দেহ তার আর থাকে না।
সহসা শকুনি ঘোষ দুহাতে মুখটা ঢেকে বোধ হয় অদম্য ক্রন্দনের বেগকে বোধ করবার প্রয়াসে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
কিরীটী চেয়ে থাকে কেবল শকুনি ঘোষের মুখের দিকে।
অনেক প্রশ্নই তার মনের মধ্যে ঐ মুহূর্তে আনাগোনা করছিল।
কিন্তু সে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে যেন।
কারণ কিরীটীর ইচ্ছে কিছু প্রশ্ন তার দিক থেকে উচ্চারিত না হয়ে শকুনির দিক থেকেই প্রথমে আসুক।
যা বলবার শকুনিই স্ব-ইচ্ছায় প্রথমে বলুক, তারপর যা বলবার সে বলবে।
ধীরে ধীরে শকুনি নিজেকে যেন কিছুটা সামলে নেয় এক সময়।
তারপর ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে যখন কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় তখনও তার অশ্রুসিক্ত চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা মর্মঘাতী বেদনাই প্রকাশ পাচ্ছিল।
সত্যি মিঃ রায়, এখনও যেন আমি ভাবতেই পারছি না এত বড় একটা দুর্ঘটনা সত্যিসত্যিই ঘটে গেছে। উঃ, কি ভয়ানক! মামা নেই? মামাকে হত্যা করা হয়েছে, এ যেন এখনও। আমার কল্পনাতেও আসছে না।
কিন্তু যা হবার, যতই মর্মান্তিক বা দুঃখের হোক ঘটে গিয়েছে মিঃ ঘোষ। এখন যদি আমরা সেই হত্যাকারীকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিতে পারি, তবেই না আমাদের দুঃখের কিছুটা সান্ত্বনা মিলবে!
হত্যাকারীকে?
হ্যাঁ। হত্যাকারীকে যেমন করে হোক আমাদের ধরতেই হবে।
কিন্তু–
এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই মিঃ ঘোষ। হত্যাকারীকে আমরা ধরবই, তবে তাকে ধরতে হলে সর্বাগ্রে আমাদের যে বস্তুটির প্রয়োজন সেটা হচ্ছে আমাদের পরস্পরকে পরস্পরের সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে পরস্পর আমরা পরস্পরের সহযোগী না হলে আপনার মামা রায়বাহাদুরের নিষ্ঠুর মৃত্যুরহস্যের কোন কিনারাই করতে পারব না জানবেন।
কিরীটীর কথার শকুনি কোন জবাবই দেয় না, নিঃশব্দে বসে থাকে সামনের দিকে শূন্য
দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
আবার একসময় কিরীটীই কথা বলে, মিঃ ঘোষ?
অ্যাঁ! শকুনি যেন চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
এ বাড়ির মৃত রায়বাহাদুরের সমস্ত আত্মীয়-পরিজন আপনাদের সকলের সাহায্যই আমি চাই শকুনিবাবু।
সাহায্য!
হ্যাঁ, সাহায্য। এ হত্যারহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে আপনারা সকলেই যে যতটুকু জানেন সমস্ত কথা অকপটে বলে আমাকে যদি না সাহায্য করেন, বুঝতেই পারছেন আমার পক্ষে এ রহস্যের কিনারা করা কতখানি কষ্টকর হবে।
কিন্তু কি ভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি মিঃ রায়? আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না?
একটা কথা আপনার জানা দরকার শকুনিবাবু, আপনার মামা রায়বাহাদুরকে বাইরে থেকে কেউ এসে হত্যা করেনি বলেই আমার ধারণা।
কিরীটীর কথায় শকুনি ঘোষ যেন দ্বিতীয়বার চমকে ওঠে।
এবং বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
ঠিকই বলছি। বাইরে থেকে কেউ এসে তাঁকে হত্যা করেনি।
তার মানে আপনি বলতে চান—
তাই বলতে চাই শকুনিবাবু, এ বাড়ির মধ্যেই কেউ-না-কেউ তাঁকে হত্যা করেছে।
সত্যিই আপনি একথা বিশ্বাস করেন মিঃ রায়?
করি। এবং আমার বিশ্বাস যে মিথ্যা নয় শীঘ্রই তা প্রমাণিতও হবে।
কেউ এ বাড়িরই বলতে ঠিক আপনি কাকে মীন করছেন মিঃ রায়, মানে কে ঐ নিষ্ঠুর হত্যার জন্য দায়ী?
বলতে দুঃখ ও লজ্জাই হচ্ছে আমার মিঃ ঘোষ। এই বাড়ির মধ্যে যাঁরা রায়বাহাদুরের আত্মীয় বলে পরিচিত তাঁদের মধ্যেই কেউ-না-কেউ সুনিশ্চিতভাবে এ কাজ করেছেন।
আমি! কথাটা যেন কতকটা অজ্ঞাতেই নিজের কণ্ঠ হতে শকুনির বের হয়ে আসে।
হ্যাঁ, আপনিও করতে পারেন বৈকি।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! শকুনি যেন আর্তকণ্ঠে একটা চিৎকার করে ওঠে।
কিছুই অসম্ভব বলছি না মিঃ ঘোষ। আপনার পক্ষেও রায়বাহাদুরকে হত্যা করা এতটুকুও অসম্ভব বলে আমি মনে করি না। অত্যন্ত স্বাভাবিক।
এরপর শকুনি ঘোষ কিছুক্ষণ যেন ফ্যালফ্যাল করে একান্ত বোকার মতই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটি কথাও যেন উচ্চারণ করতে পারে না।