শকুনি ঘোষ!
একবার শকুনির খোঁজটা নেওয়া দরকার। শকুনির ঘরটা কিরীটীর চেনা।
দোতলারই শেষ প্রান্তের ঘরটায় শকুনি থাকে।
কিরীটী বারান্দা অতিক্রম করে শকুনির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ঘরের দরজা বন্ধ। কি ভেবে হাত দিয়ে ঈষৎ ধাক্কা দিতেই দুয়ার খুলে গেল—দরজা ভেজানো ছিল।
মাঝারি আকারের ঘরটি। খোলা জানালাপথে ভোরের পর্যাপ্ত আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে।
সেই আলোয় কিরীটী দেখল, অদূরে শয্যার ওপরে শকুনি অকাতরে তখনও ঘুমোচ্ছ।
সত্যিই শকুনি ঘুমোচ্ছিল। সমস্ত ঘরের মধ্যে একটা এলোমেলো বিশৃঙ্খলা। একটা ছন্নছাড়া শ্রীহীন বিপর্যয়ের মধ্যে যেন পরম নির্বিকার ভাবেই একান্ত নিশ্চিন্তে অঘোরে নিদ্রাভিভূত শকুনি ঘোষ। বাড়ির মধ্যে যে কিছুক্ষণ মাত্র পূর্বে একটা নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে গিয়েছে—ওর নিদ্রায় তাতে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি।
পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে শকুনি ঘোষ। গায়ের ওপরে একটা কম্বল চাপানো।
ঘরের একধারে একটা চেস্ট-ড্রয়ার, কপাট দুটো তার খোলা।
একরাশ জামাকাপড় এলোমেলো ভাবে সেই চেস্ট-ড্রয়ারটার মধ্যে স্তুপীকৃত করা আছে।
একটা বেহালা দেওয়ালের গায়ে পেরেকের সঙ্গে ঝুলছে।
ঘরের এক কোণে একটা জলের কুঁজো এবং তার আশপাশের মেঝে জলে যেন থৈ থৈ করছে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখে।
হঠাৎ নজরে পড়ে, একটা ব্যবহৃত ধুতি ও একটা মলিন তোয়ালে ঘরের কোণে পড়ে আছে।
কিরীটী নিঃশব্দ পদসঞ্চারে নিদ্রিত শকুনির শয্যার একেবারে সামনেটিতে এসে দাঁড়ায়।
আবার কি ভেবে সেখান থেকে এগিয়ে গেল—যেখানে ক্ষণপূর্বে তার নজরে পড়েছিল একটা ব্যবহৃত ধুতি ও মলিন একখানা তোয়ালে।
ঈষৎ নিচু হয়ে কিরীটী মেঝে হতে প্রথমে তোয়ালেটা তুলে নিল হাতে।
স্থানে স্থানে তোয়ালেটা তখনও ভিজে বলে মনে হয় কিরীটীর। বুঝতে কষ্ট হয় না তার, রাতেই কোন একসময় ঐ তোয়ালেটা নিশ্চয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিঃশব্দে তোয়ালেটা কিরীটী চোখের সামনে মেলে ধরে পরীক্ষা করতে থাকে।
সহসা কিরীটীর দুচোখের দৃষ্টিতে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল চকিতে। তোয়লের সিক্ত অংশগুলিতে একটা মৃদু লালচে আভা যেন।
সিক্ত অংশের ঈষৎ লালচে আভা যেন কিসের এক ইঙ্গিত দেয়।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেই সিক্ত অংশগুলি পরীক্ষা করে একসময় আবার কিরীটী তোয়ালেটা ফেলে ধুতিটা হাতে তুলে নিল।
তোয়ালেটার মত অতঃপর ধুতিটাও ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল।
ধুতিরও কোন কোন অংশ তখনও ঈষৎ সিক্ত বলেই মনে হয় এবং সেই সিক্ত অংশগুলিতে অস্পষ্ট একটা রক্তিমাভা যেন পরিষ্কার চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।
কিরীটী অতঃপর একটা দুঃসাহসিক কাজ করে, ধুতির ঈষৎ লালিমাযুক্ত ভিজে অংশ হতে একটা টুকরো ছিঁড়ে নিজের পকেটে রেখে দিল।
আর ঠিক ঐ সময় মৃদু একটা শব্দ ওর কানে প্রবেশ করতেই মুহূর্তে ও ফিরে তাকাল।
শকুনির ঘুম ভেঙেছে।
এবং নিদ্রাভঙ্গে শকুনি ইতিমধ্যে কখন যেন শয্যার ওপরে উঠে বসেছে।
এবং কেমন যেন বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে শকুনি।
প্রথমটায় কিরীটীও যে একটু বিব্রত হয়ে পড়েনি তা নয়, কিন্তু অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বই তাকে যেন উপস্থিত পরিস্থিতিতে সজাগ ও সক্রিয় করে দেয়।
মৃদু হেসে যেন কিছুই হয়নি এইরকম একটা ভাব দেখিয়ে কিরীটী শয্যার ওপরে সদ্য নিদ্রাভঙ্গে উপবিষ্ট শকুনির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ঘুম ভাঙল মিঃ ঘোষ?
শকুনি মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়, হ্যাঁ। আপনি?
আপনার খোঁজেই এসেছিলাম আপনার ঘরে। দেখলাম আপনি ঘুমোচ্ছেন তাই—
আমার খোঁজে এসেছিলেন? কেন?
কয়েকটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবার ছিল।
কথা? কি কথা?
গতকাল রাত্রে রায়বাহাদুরের ঘর থেকে হঠাৎ যে আপনি কোথায় উধাও হয়ে গেলেন আপনার আর দেখাই পেলাম না!
হ্যাঁ। বড্ড ঘুম পাচ্ছিল তাই ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিলাম।
কখন শুতে এসেছিলেন? কিরীটী দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে।
তা রাত তখন গোটাতিনেক হবে বোধ করি। আগের রাত্রে মামার ঘরে জেগেছিলাম। মামার খবর কিছু জানেন–কেমন আছেন তিনি?
কিরীটী শকুনির প্রশ্নে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল শকুনির মুখের দিকে।
শকুনির মুখ একান্ত, নির্বিকার। দুচোখের দৃষ্টি একান্ত সহজ ও সরল।
কোন পাপ দুরভিসন্ধি বা দুস্কৃতির চিহ্নমাত্রও যেন তার চোখ-মুখের মধ্যে কোথাও নেই।
সহজ সরল নিস্পাপ দৃষ্টি।
মামার সেই দুঃস্বপ্নটা নিশ্চয়ই এখন আর অবশিষ্ট নেই—শকুনি বলে।
দুঃস্বপ্ন?
হ্যাঁ। শকুনি মৃদু হেসে বলে, তাঁর সেই দুঃস্বপ্নের কথা আপনি তো জানেন। কাল রাত্রে ঠিক চারটের সময় নাকি তিনি নিহত হবেন, তাঁর সেই ফোরকাস্ট—ভবিষ্যদ্বাণী নিজের মৃত্যু সম্পর্কে! আজ কয়েকদিন ধরে কি যে তাঁর মাথার মধ্যে চেপে বসেছিল আর সেজন্য কিই না এ কদিন ধরে তিনি করেছেন। এমন কি আপনাকে পর্যন্ত তিনি তাঁর পরিকল্পিত হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করবার জন্য ডেকে এনেছেন। তা এখন তাঁর সে ভয় কেটেছে তো?
মৃদু কণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল, হ্যাঁ।
ভেবে দেখুন একবার ব্যাপারটা মিঃ রায়, মামার মত একজন বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ব্যক্তি, তাঁর মাথার মধ্যেও কি সব উদ্ভট কল্পনা!
উদ্ভট কল্পনা? কিরীটী শকুনির মুখের দিকে তাকায়।
তাছাড়া আর কি বলি বলুন! কোন সেই ম্যানের পক্ষে এটা চিন্তা করাও তো যায় না। এমন কথা কস্মিনকালেও শুনেছেন কখনও যে মানুষ তার হত্যার কথা পূর্বাহ্নেই জানতে পেরেছে!