যুগপৎ ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি প্রাণীই সেই নারীকণ্ঠ শুনে ফিরে তাকায়।
মধ্যবয়সী অপূর্ব সুন্দরী এক নারী ও তার পার্শ্বে এক অপূর্ব সুন্দরী কুড়ি-একুশ বৎসর বয়স্কা যুবতী।
শুধু অপূর্ব সুন্দরীই নয় সেই যুবতী, রূপের যেন তার সত্যিই তুলনা নেই।
কি রূপ!
চিত্রকরের আঁকা যেন একখানা ছবি।
চোখের দৃষ্টি যেন ফেরানো যায় না।
দুটি অসমবয়েসী নারীমূর্তিকে দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে একে অন্যের প্রতিচ্ছায়া। অর্থাৎ মা ও মেয়ে।
সকলেই বর্ষীয়সী নারীর প্রশ্নে স্তম্ভিত, নির্বাক।
বৃহন্নলা চৌধুরীই কথা বলে প্রথমে, পিসিমা!
কিরীটী এতক্ষণে চিনতে পারে, ইনিই দুর্যোধন চৌধুরীর বিধবা ভগিনী গান্ধারী দেবী। বৃহন্নলার পিসিমা এবং তাঁর পার্শ্বে দাঁড়িয়ে গান্ধারী দেবীর একমাত্র কন্যা রুচিরা দেবী।
রুচিরার অপূর্ব রূপলাবণ্যের কথা কিরীটী রায়বাহাদুরের মুখে ইতিপূর্বে শুনেছিল বটে তবে ভাবতে পারেনি যে রুচিরা সতিসত্যিই অমনি রূপবতী।
মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কিরীটী রুচিরার দিকে এবং শুধু কিরীটীই নয়, ডাঃ সমর সেনও বিস্ময়ে যেন অভিভূত হয়ে রুচিরার দিকে চেয়ে ছিল পলকহীন দৃষ্টিতে।
আপনিই রায়বাহাদুরের বোন? সহসা কিরীটী গান্ধারী দেবীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। মৃদুকণ্ঠে গান্ধারী দেবী প্রত্যুত্তর দেয়।
আপনার দাদা রায়বাহাদুর যে নিহত হয়েছেন কার মুখে শুনলেন?
রুচি আমাকে একটু আগে গিয়ে বলল।
কে? রুচিরা দেবী, মানে আপনার মেয়ে?
হ্যাঁ।
এবারে কিরীটী রুচিরার মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, আপনি বলেছেন আপনার মাকে যে আপনার মামা নিহত হয়েছেন?
হ্যাঁ।
আপনি কি করে জানলেন সে কথা?
আমি–রুচিরা একবার মার মুখের দিকে চেয়ে কিরীটীর মুখের দিকে ফিরে তাকিয়ে কেমন যেন ইতস্তত করে।
হ্যাঁ, আপনি জানলেন কি করে? আমি তো জানি আপনারা দক্ষিণের মহলে থাকেন, তাই না?
হ্যাঁ।
তবে?
আমাকে ছোটমামাবাবুই তো গিয়ে বলে এসেছেন।
কি বললি, আমি বলে এসেছি? বিশ্বাস করবেন না, মিথ্যে কথা—দুঃশাসন চৌধুরী হঠাৎ রূঢ়-কঠিন প্রতিবাদে চিৎকার করে ওঠেন এবং যুগপৎ সকলেই তাঁর মুখের দিকে তাকায়।
মিথ্যে কথা বলছি? কি বলছ ছোটমামাবাবু? একটু আগে গিয়ে তুমি আমাকে বলে আসোনি যে বড়মামাবাবুকে ছোরা দিয়ে কে যেন খুন করেছে! সেই কথা শুনেই তো আমি মাকে গিয়ে খবর দিয়েছি।
Its a damn lie! ডাহা মিথ্যে কথা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুঃশাসন চৌধুরী আবার প্রতিবাদ জানায়, কখন তোর ঘরে আমি গিয়েছিলাম রে মিথুক? আমি তো বৃহন্নলাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। তার ঘরেই ছিলাম।
ছোটমামা, মিথ্যে কথা বলে কোন লাভ নেই। তোমার কীর্তির কথা জানতে তো আর কারও বাকি নেই।
রুচিরা!
বিশ্রী কণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী গর্জন করে ওঠেন। সামান্য একটা কথাকে কেন্দ্র করে বাদ-প্রতিবাদে মুহূর্তে কক্ষের মধ্যে যেন একটা বিষের হাওয়া জমাট বেঁধে ওঠে।
কিরীটী দেখল তিক্ত ব্যাপারকে আর বেশীদূর গড়াতে দেওয়া উচিত হবে না।
সে ধীর শান্ত কণ্ঠে বলে, দুঃশাসনবাবু, বাদানুবাদের কোন প্রয়োজন নেই। সত্যকে কেউই আপনারা গোপন করে রাখতে পারবেন না, সময়ে সবই জানা যাবে। তারপর দুঃশাসন চৌধুরীর দিকে ফিরে বলে, দুঃশাসনবাবু, আপনি কিছুক্ষণের জন্য যদি একটু স্থির হয়ে ওই চেয়ারটায় বসেন—আমি রুচিরা দেবীকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
কিন্তু রুচিরাকে দুঃশাসন চৌধুরী কি যেন প্রতিবাদ জানাতে শুরু করতেই কিরীটী তাঁকে। পুনরায় বাধা দিল, না, এখন আর একটি কথাও নয়। আপনাকে যখন আমি প্রশ্ন করব আপনার। যা বলবার বলবেন।
বেশ। তাই হবে। গজগজ করতে করতে দুঃশাসন চৌধুরী অনতিদূরে রক্ষিত চেয়ারটার উপরে গিয়ে উপবেশন করলেন।
রুচিরাকে প্রশ্ন করবার আগে একটা ব্যাপার কিরীটীর চোখে পড়েছিল। রুচিরা ঘরে ঢোকার পর হতেই ডাঃ সমর সেনের দিকে মধ্যে মধ্যে আড়চোখে সে তাকাচ্ছিল। এবং শুধু সে নয়, ডাক্তার সেনও।
কিন্তু কিরীটী যেন ব্যাপারটা আদৌ লক্ষ্য করেনি এইভাবে রুচিরাকে অতঃপর প্রশ্ন শুরু করে।
রুচিরা দেবী, বলুন তো এবারে, ঠিক কতক্ষণ আগে আপনার ছোটমামা দুঃশাসন চৌধুরী আপনাকে গিয়ে রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলেন?
তা ঘণ্টাখানেক!
বলতে বলতে কিরীটী একটিবার নিজের হাতঘড়িটার দিকে চেয়ে বললে, বেশ, এখন বলুন exactly, দুঃশাসনবাবু আপনাকে গিয়ে কি বলেছিলেন?
ছোটমামাবাবু আমার ঘরে গিয়ে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে, বড়মামাবাবুকে নাকি ছোরা মেরে কে খুন করেছে!
ঐ কথা বলেই তিনি চলে আসেন, না তারপরেও ঘরে ছিলেন?
চলে আসেন।
হুঁ। এক ঘণ্টা আগে যদি দুঃশাসনবাবু আপনাকে খবরটা দিয়ে থাকেন, চারটে বাজবার কয়েক মিনিট আগেই বলুন খবরটা উনি আপনাকে দিয়েছেন, তাই নয় কি?
হ্যাঁ, তাই হবে।
বেশ। আচ্ছা একটা কথা রুচিরা দেবী, দুঃশাসনবাবু যখন আপনার ঘরে যান আপনার ঘরের দরজা কি খোলা ছিল?
হঠাৎ কিরীটীর শেষ প্রশ্নে রুচিরা দেবী কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে যায়।
কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ঘরের দরজা বন্ধ ছিল।
ঘরের আলো জ্বালা ছিল, না নেভানো ছিল?
আর একবার চমকে ওঠে রুচিরা, মৃদু কণ্ঠে বলে, জ্বালানোই ছিল।
আপনি জেগে, না ঘুমিয়ে ছিলেন?
ঘুমিয়ে ছিলাম।