কিরীটীই এবার প্রশ্ন করে, অর্ধ-উন্মাদ নাকি অবিনাশবাবু?
তাছাড়া আর কি! আর এখানে সকলেই তো সে কথা জানে। খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন বছর পাঁচেক আগেই প্রথম ওঁর মাথা খারাপের লক্ষণ প্রকাশ পায়। সেই সময় অনেক চিকিৎসা করা হয়, এমন কি কিছুদিন তাঁকে মেন্টাল হসপিটালেও ওঁকে রাখা হয়েছিল।
আপনি তো দীর্ঘকাল ধরে বিদেশে ছিলেন এবং রায়বাহাদুরের মুখেই আমি শুনেছি আপনার সঙ্গে এ বাড়ির কখনও পত্র বিনিময়ও ছিল না। এসব কথা তবে আপনি জানলেন কি করে?
এখানে এসেই শুনেছি।
হুঁ। বলতে বলতে হঠাৎ বৃহন্নলা চৌধুরীর দিকে ফিরে চেয়ে কিরীটী প্রশ্ন করে, বৃহন্নলাবাবু, সত্যিই কি আপনার দাদুর মাথার গোলমাল ঘটেছিল?
হ্যাঁ, দাদুকে কিছুদিন রাঁচীতে কাঁকে মেন্টাল হসপিটালে ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল।
কতদিন হাসপাতালে তিনি ছিলেন?
তা বছর দেড়েক তো হবেই।
সেখান থেকে কি পরে তাঁকে তারাই ডিসচার্জ করে দেয়, না আপনারাই ওঁকে ছাড়িয়ে আনেন?
ভাল হয়ে যাওয়ায় আমরাই ওঁকে ছাড়িয়ে আনি।
অসুখটা কি হয়েছিল ওঁর জানেন কিছু?
না।
.
দালাল সাহেব আবার প্রশ্ন শুরু করেন দুঃশাসন চৌধুরীকে।
রাত্রি ঠিক সাড়ে তিনটে থেকে রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে এ ঘরে আসবার পূর্ব পর্যন্ত সময়টা আপনি কোথায় ছিলেন এবং কি করছিলেন দুঃশাসনবাবু?
মাস তিনেক ধরে রাত্রে আমার একেবারেই বলতে গেলে ঘুম হয় না। তবে আজ নার্স আমাকে একটা স্ট্রং ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল তাতেই বোধহয় একটু ঝিম মত এসেছিল। বোধ হয় তো কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়েও পড়েছিলাম।
হুঁ। তা রায়বাহাদুর যে মারা গেছেন টের পেলেন কি করে?
সত্যি কথা বলতে কি-দাদার আজ কদিনকার কথা শুনে আজকের রাত্রে ঐ সময়ে যে একটা বিপদ ঘটতে পারে আর কেউ বিশ্বাস না করলেও যেন কেন আমার মন বলেছিল, একবারে অবিশ্বাস করে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার নয়। তাছাড়া আমি তো এই পাশের ঘরেই থাকি, তাই চারটে বাজবার মিনিট চার-পাঁচ আগেই হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙে এ ঘরে এসেছি
এসে কি দেখলেন?
দেখলাম ঘরের মধ্যে একা দাদার চাকর দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে-মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ও হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বললে, বাবু নেই। পর্দার ওপাশে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই–
তারপর?
তখন আমিই ওকে আপনাদের ডাকতে বলি ডাক্তারের ঘর থেকে।
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী নার্স সুলতা করের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, দুঃশাসনবাবুকে কি ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন সুলতা দেবী?
ডাঃ সানিয়ালের ইনস্ট্রাকসন ছিল একটা লুমিনল ট্যাবলেট দিতে, তাই দিয়েছিলাম।
মৃদু কোমল কণ্ঠে সুলতা কর জবাব দিল।
কিরীটী লক্ষ্য করে, সুলতা কর ঐ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ডাঃ সমর সেন ও ডাঃ সানিয়াল যুগপৎ যেন নার্স সুলতা করের মুখের দিকে তাকাল।
ডাঃ সানিয়াল কি যেন বলবারও চেষ্টা করেন কিন্তু বলার সময় পান না—দালাল সাহেব তাড়াতাড়ি বলেন, আচ্ছা এবারে আপনি আপনার ঘরে যেতে পারেন দুঃশাসনবাবু। তবে একটা কথা—আমার জবানবন্দি না শেষ হওয়া পর্যন্ত এবং আমার পারমিশন ব্যতীত এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেন যাবেন না।
দুঃশাসন চৌধুরী দালাল সাহেবের নির্দেশ শুনে ফিরে তাকায়, তার মানে আমাকে কি নজরবন্দী রাখা হচ্ছে?
না, নজরবন্দী নয়। শুধু একা আপনি নন, এ বাড়িতে যাঁরা যাঁরা এখন আছেন প্রত্যেকের প্রতি আমার ঐ আদেশ।
বেশ।
দুঃশাসন চৌধুরী অতঃপর ঘর হতে বেরিয়ে গেলেন এবং স্পষ্টইবোঝা গেল দালাল সাহেবের কঠোর নির্দেশে তিনি আদপেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
এবং শুধু দুঃশাসন চৌধুরীই নয়, সকলেই যে একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েছে, সকলের মুখেই যেন তার আভাস পাওয়া গেল।
কিন্তু দালাল সাহেব কোন ভ্রুক্ষেপই করলেন না।
তিনি এবার বৃহন্নলা চৌধুরীর দিকে চেয়ে বললেন, বৃহন্নলাবাবু, এবারে আপনাকে আমি কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
০৫. বৃহন্নলা চৌধুরী কেমন যেন
বৃহন্নলা চৌধুরী কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে দালাল সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে বলে, বলুন!
আশা করি আপনাকে যা যা জিজ্ঞাসা করব তার সঠিক জবাব পাব।
নিশ্চয়ই।
গলার স্বরটা মৃদু।
রাত তিনটে থেকে এ ঘরে আসবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আপনি কি আপনার ঘরেই ছিলেন?
হ্যাঁ। সন্ধ্যে থেকেই শরীরটা আমার আজ ভাল ছিল না। তাছাড়া ডাঃ সানিয়াল বলেছিলেন ভয়ের কোন কারণ নেই, তাই নিজের ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলাম।
সে ঘরে আর কেউ ছিল?
না। আমি একাই এক ঘরে শুই বছরখানেক যাবৎ।
আপনার স্ত্রী ও ছেলে।
পাশের ঘরে তারা শোয়।
কার কাছে এ দুঃসংবাদ প্রথমে পেয়ে তাহলে আপনি এঘরে আসেন?
কাকাই গিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সব কথা বলেন।
কাকা মানে দুঃশাসনবাবু?
হ্যাঁ।
এবারে কিরীটী প্রশ্ন করে, হুঁ, আচ্ছা বৃহন্নলাবাবু, আপনার বাবা যে রাত্রে মারা যাবেন এ কথা আপনাকে বলেছিলেন কি কখনও?
বলেছিলেন। কিছুদিন থেকে প্রত্যেকের কাছেই তো ও কথা বলেছেন তিনি।
আচ্ছা হঠাৎ ঐ ধরনের কথা বলবার তাঁর কোন সঙ্গত কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয় কি বৃহন্নলাবাবু? দালাল সাহেব প্রশ্ন করেন।
কি জানি, আমি তো দেখতে পাই না।
এমন সময় ঘরের মধ্যে সকলকে বিস্মিত ও সচকিত করে অপূর্ব একটি নারীকণ্ঠ শোনা গেল।
বৃহন্নলা! দাদাকে নাকি সত্যিসত্যিই কে খুন করেছে?