হুঁ।
কবে?
দিন পনের আগে ও একবার বলেছিল—
এর মধ্যে আর বলেননি?
না। বলবে কখন—দেখাই তো হয়নি!
দেখাই হয়নি!
না।
কত দিন দেখা হয়নি?
তা দিন পনেরো হবে।
এই দিন পনেরোর মধ্যে একবারও ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেননি?
না।
উনি যে অসুস্থ তা আপনি জানতেন?
জানব না কেন!
তবে?
তবে আবার কি! ওসব বড়লোকের রোগফোবিয়া আমার দু-চক্ষের বিষ, I cant stand them.
রায়বাহাদুরের এই দীর্ঘদিনের রোগটা তাহলে আপনার মতে একটা ফোবিয়া ছাড়া কিছু নয়? কিরীটী বলে।
নিশ্চয়ই না।
কি বলছেন আপনি! এত বড় বোগ, এত ডাক্তার, সব ছিল তাঁর একটা ফোবিয়া? প্রশ্ন করলেন এবারে দালাল সাহেব।
হ্যাঁ, তাছাড়া আর কি! সাত-সাতটা হার্ট অ্যাটাক হলে কোন ভদ্রলোক উঠতে পারে বলে তো কখনও শুনিনি। আসলে ও হার্ট অ্যাটাক নয়।
অবাক বিস্ময়ে কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে।
অবিনাশ চৌধুরী তখনও বলে চলেছেন, বুঝলেন, আসলে ওসব কিছু নয়, ওকে পেয়েছিল মেলানকোলিয়ায়, বেটসা অর্থাৎ সুরমার মৃত্যুর পর হতেই ও মেলানকোলিয়ায় ভুগছিল। ইদানীং আবার গোদের ওপর বিষফোড়া হয়েছিল, মেলানকোলিয়াই গিয়ে শেষ সিজোফ্রেনিয়াতে দাঁড়িয়েছিল। ভারি তো দুছটাক সম্পত্তি আর সামান্য কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স, তার জন্যে লোকে ওকে হত্যা করবে! যত সব—
বড় বড় রোগের নাম উচ্চারিত হতে শুনেই ডাঃ সমর সেন ও ডাঃ সানিয়াল উভয়েই কৌতূহলী হয়ে অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকান।
উভয়েরই বাক্যস্ফুর্তি হয় না অবিনাশ চৌধুরীর কথা শুনে।
অবিনাশ চৌধুরী বললেন, অপঘাতে মৃত্যু! এইবার সব ধসে পড়বে। দীর্ঘদিন ধরে অনেক পরিশ্রম করে দুর্যোধন আর আমি সব গড়ে তুলেছিলাম, এইবারে সব যাবে। অভিশাপ-—সতীসাধ্বীর অভিশাপ!
বলতে বলতে অবিনাশ চৌধুরী বোধ হয় ফিরে যাওয়ার জন্যই পা বাড়িয়েছিলেন।
দালাল সাহেব সহসা বাধা দিলেন, অবিনাশবাবু!
তুমি আবার কে?
আমি এখানকার এস.পি.।
I see—তা তোমার কিছু বক্তব্য আছে নাকি?
ভ্রূ কুঞ্চিত করে তীব্র দৃষ্টিতে তাকান অবিনাশ চৌধুরী দালাল সাহেবের মুখের দিকে।
পালটা প্রশ্নে দালাল সাহেব কেমন যেন থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকেন।
এই সময় কিরীটী কথা বলে আবার।
সে অবিনাশ চৌধুরীকে প্রশ্ন করে, একটা কথা অবিনাশবাবু–
বলুন!
একটু আগে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আপনি যে বলছিলেন দু বৎসর আগেই রায়বাহাদুর উইল করেছিলেন—
হ্যাঁ, করেছিলই তো।
সেটা অবিশ্যি আমিও শুনেছিলাম, কিন্তু সেটা কি রেজিস্টার্ড উইল?
রেজিস্ট্রি করেছিল কিনা উইলটা তা জানি না তবে একটা উইল তার আছে। আগে যে ঘরে দুর্যোধন শুত সেই ঘরের আয়রন চেস্টেই বোধ হয় তার সে উইল আছে, যতদূর আমি জানি। তবে সে উইল শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে বলে আর আমার এখন মনে হচ্ছে না।
কেন? কিরীটী প্রশ্ন করল।
কেন! এমনি অপঘাত মৃত্যু, তার ওপরেও সে উইল পাওয়া যাবে বলে আপনি মনে করেন মিঃ রায়? তাছাড়া আমি তো জানি সে উইলে এই যারা সব পরমাত্মীয়ের দল ঘরের মধ্যে এসে ভিড় করেছে তারা কেউই কিছু পায়নি।
কি বলছেন আপনি? কিরীটীই আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, উইলটা যদি খুঁজে পান তো সেটা খুললেই আমার কথার সত্যি-মিথ্যে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।
অতঃপর দ্বিতীয় আর বাক্যব্যয় না করে অবিনাশ চৌধুরী কক্ষত্যাগ করে চলে গেলেন নিঃশব্দে।
অবিনাশ চৌধুরীর শেষের কথায় ও তাঁর কক্ষ হতে প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই যেন সমগ্র কক্ষের মধ্যে একটা বিশ্রী থমথমে ভাব জমাট বেঁধে ওঠে।
অভাবনীয় পরিস্থিতি। কারও মুখেই কোন শব্দটি পর্যন্ত নেই। নিচুপ সকলেই।
অবিনাশ চৌধুরীই যেন সকলকে অকস্মাৎ মূক করে দিয়ে গিয়েছেন। ওদিকে রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে আসছিল।
আকাশের বুকে শেষ অন্ধকারের পাতলা পদাটা আসন্ন আলোর ছোঁয়ায় যেন থির থির করে কাঁপছিল।
নাইট-কীপার হুম্ সিংহের খবরদারির চিৎকার সে রাত্রির মত থেমে গিয়েছিল বোধ হয়।
সারারাত্রির জাগরণক্লান্ত হুম্ সিং বাগানের মধ্যে ছোট্ট টালির শেষ্টার মধ্যে এতক্ষণ গিয়ে হয়ত ঢুকেছে।
এখন টানা ঘণ্টা চারেক ঘুমোবে। বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ একবার জেগে নিজ হাতে উনুন ধরিয়ে এক মগ কড়া চা তৈরী করে পান করে আবার বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমোবে।
তারপর কিছু রুটি ও ডাল আহার এবং আবার সূযাস্ত পর্যন্ত একটানা নিদ্রা।
জাগবে সে ঠিক সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার যখন প্রকৃতির বুকে একটু একটু করে ঘন হয়ে উঠবে।
.
কিরীটীই ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে।
দালাল সাহেবের দিকে চেয়ে বলে, আপনার জবানবন্দি নেওয়া শেষ হল দালাল সাহেব?
না, এই যে শুরু করি—
দালাল সাহেব আবার তাঁর জবানবন্দি নিতে শুরু করেন।
.
রায়বাহাদুরের ভাই দুঃশাসন চৌধুরীর জবানবন্দি নেওয়া তখনও শেষ হয়নি, আকস্মিকভাবে ঘরের মধ্যে অবিনাশ চৌধুরীর আবির্ভাব ঘটে।
কিরীটীর নির্দেশে বোধ হয় তারই পূর্ব প্রশ্নের জের টেনে দালাল সাহেব দুঃশাসন চৌধুরীর দিকে চেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, তাহলে আপনি এই তো বলতে চান যে রায়বাহাদুরের কোন প্রকার উইলই ছিল না?
আমি তো মশাই সেই রকমই জানি।
তবে আপনার কাকা সাহেব যে সব কথা বলছিলেন—
ছেড়ে দিন না মশাই। একটা অর্ধ-উন্মাদ লোক—ওঁর কথা কেউ বিশ্বাস করবে নাকি? তাছাড়া দিবারাত্রি গান আর বাইজী নিয়েই তো পড়ে আছেন।