সত্যি অপূর্ব মিষ্টি কণ্ঠস্বর বক্তার।
এ তো কণ্ঠস্বর নয়, সঙ্গীতের সুর বুঝি।
সঙ্গীতের জন্যই যেন ভগবান ঐ কণ্ঠস্বরটি সৃষ্টি করেছেন।
০৪. গানের মতই মিষ্টি কণ্ঠস্বর
সত্যি গানের মতই মিষ্টি কণ্ঠস্বর।
উঁচু বলিষ্ঠ পুরুষোচিত গঠন।
কালো গায়ের রঙ হলেও, মুখ-চোখের গঠন ও দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব কিছু নিয়ে যেন অপূর্ব একটা শ্রী ও সৌন্দর্যের সমন্বয় যা সাধারণতঃ বড় একটা চোখে পড়ে না।
পরিধানে মিহি কালোপেড়ে ফরাসডাঙার গিলে-করা কোঁচানো ধুতি। ধুতির কোঁচা পায়ের পাতার উপরে লুটুচ্ছে।
গায়ে একটা হাফ-হাতা গরম পাঞ্জাবি। কাঁধের উপরে দামী কল্কার কাজ করা কমলালেবু রঙের কাশ্মীরী শাল। পায়ে ঘাসের চটি।
কাকা সাহেব! যেন কতকটা আত্মগতভাবেই কথাটা উচ্চারণ করেন দুঃশাসন চৌধুরী।
এ বাড়ির কাকা সাহেব অবিনাশ চৌধুরী।
কাকা সাহেব অবিনাশ চৌধুরী সত্যিই ঐ বাড়ির একটি বিশেষ ব্যতিক্রম যেন। শুধু মাত্র চেহারা ও বেশভূষাতেই নয়, চালচলনে আদবকায়দায় কথাবার্তায় এ বাড়ির কারও সঙ্গে যেন অবিনাশ চৌধুরীর কোন মিল নেই। শুধু আজ বলেই নয়, কোন কালেই বুঝি ছিল না।
প্রথম যৌবনে ছিলেন কাকা সাহেব অবিনাশ চৌধুরী লোকটি উগ্র সাহেব। তারপর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই উগ্র সাহেবিয়ানার বদলে তাঁর সব কিছুর মধ্যে দেখা দিয়েছিল একটা বাদশাহী আভিজাত্য। যেমন দিলদরিয়া তেমনি স্ফুর্তিবাজ। বিয়ে করেননি, তাই বলে ব্রক্ষ্মচারীর চরিত্রও নয়।
সুরা নারী সঙ্গীত অভিনয় ও শিকার এই ছিল লোকটির জীবনের সব কিছু। রায়বাহাদুরের মুখেই কিরীটী শুনেছিল, এককালে ঐসব খেয়ালে দুহাতে লোকটি অর্থ উড়িয়েছেন। এখন
অবিশ্যি সঙ্গীতসাধনা নিয়েই ঘরের মধ্যে নিজেকে সর্বদা ব্যস্ত রাখেন।
প্রথম যৌবনের সাহেবী আচরণের জন্যই সকলে তাঁকে কাকা সাহেব বলে সম্বোধন করত। এখনও সেই সম্বোধনেই তিনি পরিচিত।
অবিনাশ চৌধুরীর বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে এবং বয়স তাঁর যতই হোক না কেন, অতি পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন দেহের মধ্যে এতটুকুও তার ছাপ যেন দেখা যায় না।
আছে! আছে—আলবৎ আছে— দুবছর আগে দুর্যোধন উইল করে রেখেছিল।
কটি কথা বলে এবারে অবিনাশ চৌধুরী বারেকের জন্য সকলের দিকে একবার চেয়ে বৃহন্নলার প্রতি দৃষ্টি স্থাপন করে বললেন, সত্যিই কি দুর্যোধন মারা গেছে নাকি, বিনু? এরা গিয়ে এইমাত্র আমাকে সংবাদ দিল।
কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল।
সে যেন ঠিক বুঝতে পারে না—কে এইমাত্র অবিনাশ চৌধুরীকে গিয়ে দুর্যোধন চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদটা দিল!
কিন্তু অবিনাশ চৌধুরীর কথার কেউই কোন জবাব দেয় না।
ব্যাপার কি, তোমরা যে সবাই মুখে ছিপি এঁটে দিয়েছ বলে মনে হচ্ছে! কথা বলছ না কেন—বলতে বলতে প্রৌঢ় অবিনাশ চৌধুরীর পাশেই দণ্ডায়মান পুলিশ-সুপার দালাল সাহেবের প্রতি নজর পড়তেই মুহূর্তে কি একটা বিরক্তিতে যেন মুখটা তাঁর কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
এবং সকলকে যেন কতকটা বিস্মিত ও বিব্রত করেই দালাল সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে এবারে রুক্ষ কণ্ঠে অবিনাশ বললেন, এ সময় দালাল সাহেব আপনি এখানে কেন? আপনি কেন এসেছেন?
রায়বাহাদুর নিজে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
কি বললেন, দুযযাধন আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিল? কেন? নিশ্চয়ই এ বাড়িতে কোন চুরি-ডাকাতির কিনারা করতে নয়?
গম্ভীর কণ্ঠে দালাল সাহেব বললেন, তার চাইতেও গুরুতর ব্যাপারে চিঠি লিখে আমার সাহায্য প্রার্থনা করে আসতে বলেছিলেন।
গুরুতর ব্যাপারে! গুরুতর ব্যাপারটা কি শুনি?
তিনি–রায়বাহাদুর যে আজ রাত্রে নিহত হবেন, যে করেই হোক ব্যাপারটা তিনি পূর্বাহ্নে বুঝতে পেরে আমাকে সাহায্য করবার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এবং এখন দেখতে পাচ্ছি তাঁর সে অনুমান মিথ্যে নয়। সত্যি-সত্যিই তিনি নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হয়েছেন।
হুঁ, সত্যি-সত্যিই তাহলে দুর্যোধন নিহত হয়েছে! ব্যাপারটার মধ্যে যেন এতটুকু গুরুত্বও নেই এইভাবে কথা কটি উচ্চারণ করে ধীরে শান্ত ও মৃদু পদবিক্ষেপে ঘরের অন্যাংশে পর্দার ওপাশে এগিয়ে গেলেন অবিনাশ চৌধুরী।
কিরীটী ও দালাল সাহেব নিঃশব্দে অবিনাশ চৌধুরীকে অনুসরণ করে।
শয্যার উপর রায়বাহাদুরের মৃতদেহ ঠিক পূর্বের মতই পড়ে আছে দেখা যায়।
অবিনাশ একেবারে মৃতদেহের সামনে শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালেন এবং নিষ্পলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, দুযযাধন! Poor boy! সত্যি-সত্যিই তুই তাহলে মরলি! আশ্চর্য, তুই যে মরবি এ কথা তুই জেনেছিলি কি করে!
সহসা এমন সময় কিরীটীর প্রশ্নে অবিনাশ চৌধুরী ফিরে তীব্র দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকান।
কিরীটী প্রশ্ন করে, আপনিও তাহলে সে কথা জানতেন অবিনাশবাবু?
Who are you? অবিনাশ চৌধুরী প্রশ্ন করেন।
চিনতে পারছেন না আমাকে, আমার নাম কিরীটী রায়!
কিরীটী রায়! ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমাদের সেই দলিল জালের একটা ব্যাপারে বছর দুই আগে তুমিই না সব ধরে দিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
হুঁ, তা কি বলছিলে, আমি সে কথা জানলাম কি করে, না? নতুন কথা তো নয়, দুনিয়াসুদ্ধ লোকেই তো শুনলাম জানতো। দুর্যোধন তো কথাটা বলে বেড়িয়েছে সকলকে শুনেছি।
আপনাকেও তাহলে তিনি বলেছিলেন?