বাকি সকলকে সন্দেহের তালিকার মধ্যে ধরা যেতে পারে, কারণ বাকি সকলের প্রত্যেকেরই মৃত রায়বাহাদুরের মৃত্যুতে লাভবান হবার সম্ভাবনা।
কাজেই প্রত্যেকের পক্ষেই রায়বাহাদুরকে হত্যা করা এমন কিছুই অসম্ভব নয় বা ছিল না।
কিরীটীর চিন্তাজাল হঠাৎ ছিন্ন হয়ে গেল।
ঐ সময় সুপার দালাল সাহেব সুলতা করের জবানবন্দি শেষ করে দুঃশাসন চৌধুরীকে জেরা শুরু করেছেন।
আপনি বলেছেন দীর্ঘ পাঁচ বছর আপনি বাড়িছাড়া থাকবার পর মাত্র দিন দশেক আগে এখানে ফিরে এসেছেন, কেমন কিনা?
হ্যাঁ। দালাল সাহেবের প্রশ্নের জবাবে জানান দুঃশাসন চৌধুরী।
এই পাঁচ বছর আপনি কোথায় ছিলেন?
বর্মামুলুকে মৌচিতে—
মৌচি–কেন?
মৌচিতে আমার মাইকার বিজনেস ছিল—
মাঝখান থেকে কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে, কয়েকটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই মিঃ দালাল মিঃ চৌধুরীকে, যদি অবশ্য আপনি অনুমতি দেন।
একটু যেন বিরক্তি ও অনিচ্ছার সঙ্গেই দালাল সাহেব বলেন, বেশ তো, করুন।
মিঃ চৌধুরীর কি মাইকার সেই বিজনেস এখনও আছে? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে দুঃশাসন চৌধুরীকে।
না। দাদার অনুরোধে সমস্ত বিজনেস তুলে দিয়েই একেবারে চলে এসেছি।
বিজনেস কেমন চলছিল আপনার?
খুব ভালই চলছিল। তাই আমারও বিজনেস তুলে দেবার কোন ইচ্ছাই ছিল না। গত বছর দেড়েক ধরে দাদা অনবরত আমাকে ওখানকার বিজনেস তুলে দিয়ে দেশে ফিরে আসবার জন্য অনুরোধ করছিলেন চিঠির পর চিঠি দিয়ে। তাছাড়া এখানকার এত বড় কলিয়ারী বিজনেস বৃহন্নলা একা একা ম্যানেজ করে উঠতে পারছিল না–
কেন, আমি তো যতদূর জানি ইদানীং অসুস্থ অবস্থাতেও দুমাস আগে পর্যন্ত বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই রায়বাহাদুর নিজে বিজনেস দেখাশুনা করতেন। তাছাড়া আপনার ছোটকাকা অবিনাশবাবুও তো বিজনেস দেখাশুনা করতেন বলেই শুনেছি—কিরীটী এবারে বলে।
কিরীটীর কথায় দুঃশাসন চৌধুরী বিশেষ অর্থপূর্ণ একটু হাসি হেসে বলেন, কে দেখাশুনা করতেন বললেন, আমাদের কাকা সাহেব?
হ্যাঁ।
হুঁ, তা দেখতেন বটে। তবে এতই যখন আপনার জানা আছে—এও নিশ্চয়ই আপনি জানেন, কাকা সাহেবের আসল বিজনেসের চাইতে গানবাজনার ব্যাপারেই বরাবর বেশী ঝোঁক এবং সেই কারণেই বরাবর দাদাকে না হোক মাসে হাজার দেড় হাজার করে অর্থ আত্মীয়তার আক্কেলসেলামী বাবদ জলে ফেলতে হত। বলতে বলতে কণ্ঠের মধ্যে আরও তাচ্ছিল্য ও অবহেলার ভাব এনে বললেন, হুঁ, তিনি দেখবেন বিজনেস! এই যে বাড়ির মধ্যে এত বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে, দেখুন গিয়ে কাকা সাহেব দিব্যি খোসমেজাজে বাঈজীর গান শুনছেন এখনও তাঁর ঘরে আসর জমিয়ে।
কিরীটী দুঃশাসন চৌধুরীর কথায় কোনরকম গুরুত্ব না দিয়ে অত্যন্ত ধীর শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়, দেখুন দুঃশাসনবাবু, আজ গত সাত বছর ধরে রায়বাহাদুরের সঙ্গে এবং আপনাদের এই ফ্যামিলির সঙ্গে আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচয়। আপনাদের কাকা সাহেব অবিনাশধাবুর সমস্ত কিছুই আমার জানা, তিনি আমার আদৌ অপরিচিত নন। একটা কথা আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন দুঃশাসনবাবু, রায়বাহাদুরের বর্তমান সুবিপুল সম্পত্তি অর্জনের মূলে আপনাদের কাকা সাহেবের দীর্ঘ বারো বৎসরের পরিশ্রম ও অধ্যবসায় আছে। সেদিক দিয়ে আমি যতদূর জানি, রায়বাহাদুরই ইদানীং বৎসর তিনেক হল আপনাদের কাকা সাহেবের জন্য মাসিক দেড় হাজার টাকা মাসোহারার পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ইচ্ছে করেই
শ্লেষাত্মক কণ্ঠে এবারে দুঃশাসন চৌধুরী জবাব দিলেন, আপনি দেখছি অনেক কিছুই জানেন মিঃ রায়, তাই একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করার লোভটা দমন করতে পারছি না। এতই যখন আপনি জানেন, এও আপনার নিশ্চয়ই অজানা নয় যে কোথাও কোন কাগজপত্রে এ সম্পকে কোন নির্দেশ আছে, না এটা একটা উভয়ের মধ্যে তাদের মৌখিক ব্যবস্থাই হয়েছিল!
বৎসর দুই আগে রায়বাহাদুরের সঙ্গে যখন একবার আমার কলকাতায় দেখা হয়, কথায় কথায় সেই সময়েই রায়বাহাদুর আমাকে বলেছিলেন—লিখিত ভাবে তাঁর উইলের মধ্যেও–
উইল! দাদার উইল! পরম বিস্ময়ের সঙ্গেই যেন দুঃশাসন চৌধুরী কথা কটা উচ্চারণ করেন কিরীটীকে বাধা দিয়ে।
হ্যাঁ। উইলেই সে রকম লিখে দিয়েছেন তিনি, তাই আমাকে বলেছিলেন—
এবারে সত্যিই আমাকে হাসালেন মিঃ রায়। দাদার উইল! যতদূর আমার জানা আছে। তাঁর তো কোন উইলই নেই।
পাকাপোক্ত রেজিস্টার্ড উইল একটা না থাকলেও—উইল তাঁর একটা ছিল আমি জানি—বেশ জোরের সঙ্গেই জবাব দিল এবার কিরীটী।
ভুল শুনেছেন। কাঁচা পাকা কোন উইলই তাঁর নেই।
ইতিমধ্যে একসময় রায়বাহাদুরের পুত্র বৃহন্নলা চৌধুরীকেও দালাল সাহেব ঐ কক্ষের মধ্যে ডেকে এনেছিলেন।
পিতার আকস্মিক নিষ্ঠুর মৃত্যুতে বৃহন্নলা চৌধুরী যেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পাথরের মতই একপাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল।
তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, বৃহন্নলাবাবু, আপনার বাবার কোন উইল বা ঐজাতীয় কোন কিছু লেখা কি নেই?
না। আমি যতদূর জানি বাবার কোন উইল ছিল বলে আমি শুনিনি অন্ততঃ—
আছে। কে বললে নেই! আছে, আলবৎ হ্যায়।
অকস্মাৎ অন্য একটি পুরুষের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি প্রাণীই যুগপৎ বিস্মিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় বক্তার দিকে।
কোন পুরুষের কণ্ঠস্বর এমন মধুস্রাবী হতে পারে এ যেন ধারণাও করা যায় না—ডাঃ সেনের মনে হল।