- বইয়ের নামঃ তাতল সৈকতে
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. মানুষের জীবনে এমন এক একটা ঘটনা
মানুষের জীবনে এমন এক একটা ঘটনা দৈবাত ঘটে যায় যা একটা দুঃস্বপ্নের মতই যেন বাকি জীবনে কখনই সে ভুলতে পারে না। ডাঃ সমর সেনও তার জীবনের এক মধ্যরাত্রির অনুরূপ একটি ঘটনা আজ পর্যন্ত ভুলতে তো পারেইনি, এমন কি আজও যেন মধ্যে মধ্যে তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। মধ্যে মধ্যে আজও নিদ্রার ঘোরে যেন ডাঃ সমর সেনকে সেই দুঃস্বপ্নটা আতঙ্কিত করে তোলে।
মনে হয় অন্ধকারের মধ্যে যেন কে তার দিকে চেয়ে আছে।
পলকহীন, স্থির নিষ্কম্প, বিভীষিকাময় দুই চক্ষুর কঠিন মৌন দৃষ্টি যেন তারই দিকে তাকিয়ে আছে। এ দৃষ্টি যেন এ জগতের নয়, কোন প্রেতলোকের বায়বীয় দেহের।
হাড় জাগানো বলিরেখাঙ্কিত মুখ : ফ্যাকাশে রক্তহীন লোল চর্ম। বিস্ত কাঁচাপাকা চুলগুলি বলিরেখাঙ্কিত কপালের উপরে নেমে এসেছে।
আর ঐ সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে সেই লোকটির বক্ষে সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে একখানি কালো বাঁটওয়ালা ছোরা।
.
ডাঃ সমর সেনের ঘুমটা আজও আবার ভেঙে গেল।
নিস্তব্ধ মধ্যরাত্রি। ঘরের মধ্যে ও বাইরে অন্ধকার থমথম করছে। নিচ্ছিদ্র জমাট কালো কালির মত নিবিড় অন্ধকার।
তারপরই ডাঃ সমর সেন স্পষ্ট শুনতে পায় বদ্ধ দরজার গায়ে মৃদু করাঘাত করতে করতে কে যেন মৃদু কণ্ঠে ডাকছে, ডাক্তার সাব, ডাক্তার সাব–
কে?
সে রাত্রেও ঠিক অমনি শয়নঘরের বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু অথচ স্পষ্ট করাঘাতের শব্দে আচমকা ডাক্তারের ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল।
একটা জটিল অপারেশনের ব্যাপারে সমস্তটা দ্বিপ্রহর ও সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত ব্যস্ত থেকে পরিশ্রান্ত ডাক্তার তাড়াতাড়িই গিয়ে শয্যা গ্রহণ করেছিল এবং ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ ও সেই সঙ্গে কে যেন ডাকছে, সাব, ডাক্তার সাব—
একটা বিশ্রী অস্বস্তির সঙ্গে ডাঃ সেন শয্যার উপর উঠে বসে, কে?
সাব আমি শিবু। একটা জরুরী কল এসেছে।
কল! এত রাত্রে জরুরী কল!
একান্ত বিরক্তচিত্তেই ডাঃ সেন শয্যা থেকে মেঝের উপরে নেমে দাঁড়ায়। মাঘের শেষ, তবে বিহার অঞ্চল বলেই শীতের প্রকোপ যেন একটু বেশীই দাঁত বসায়। খাটের বাজু থেকে গরম ড্রেসিং গাউনটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপাতে চাপাতে বিরক্তির সঙ্গেই ঘরের দ্বার অর্গলমুক্ত করে বাইরে এসে দাঁড়াল, কে? কোতা থেকে কল এসেছে?
একেবারে গাড়ি নিয়ে এসেছে সাহেব। আমি বাইরের ঘরে বসতে দিয়েছি। বিনীতভাবে ভৃত্য শিবদাস বলে।
শিবদাস ডাক্তারের কমবাইণ্ড হ্যাণ্ড।
ডাঃ সেন বাইরের দিকে পা বাড়ায়।
একতলা বাংলো প্যাটার্নের ছোটখাটো বাড়িটা। সামনে ও পেছনের দিকে নাতিপ্ৰশস্ত বারান্দা, বারান্দা অতিক্রম করে ডাক্তার ঘরের সামনে এসে ভারী পদাটা তুলে ভিতরে ঢুকল।
ঘরের অত্যুজ্জ্বল আলোয় ডাঃ সেন আগন্তুকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে।
গলাবন্ধ কালো রঙের একটা কোট গায়ে, মাথায় উলের মাঙ্কি ক্যাপ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে একটা সোফার উপর পা তুলে দিয়ে শীতে জবুথবু ভাবে বসে।
ডাঃ সেনের পদশব্দে লোকটি উঠে দাঁড়ায় : নমস্কার। আপনিই বোধ হয় ডাঃ সেন?
হ্যাঁ।
বলছিলাম কি, এখুনি আজ্ঞে, আপনাকে একটিবার শ্রীনিলয়ে যেতে হবে।
শ্রীনিলয়! কার বাড়ি? ভ্রূকুঞ্চিত করে ডাক্তার প্রশ্ন করে।
বলছিলাম কি, সাত-সাতটা কোল মাইনসের প্রোপাইটার রায় বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর নাম শোনেননি আজ্ঞে?
না। শোনবার সৌভাগ্য হয়নি। একটু ব্যঙ্গভরেই যেন জবাবটা দেয় ডাঃ সেন। তা কেষ্টা কি, কারই বা অসুখ?
বলছিলাম কি, অধীন সামান্য তশীলদার। সংবাদ তো জানি না আজ্ঞে, তবে রায়বাহাদুরেরই অসুখ—তিনিই আজ্ঞে রোগী।
হুঁ। এখান থেকে আপনার শ্রীনিলয় কতদূর?
তা মাইল দশেক পথ হবে।
ফিস্ কিন্তু আড়াইশো টাকা নেব।
তাই পাবেন। বলছিলাম কি, একটু তাড়াতাড়ি করলে—
বসুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি আসছি।
ডাক্তার ঘর হতে বের হয়ে গেল।
লোকটিকে বাইরের ঘরে বসতে বলে শয়নঘরে ঢুকে বেশ বদলাতে বদলাতে ডাক্তার কলটির কথাই ভাবছিল।
সত্যি কথা বলতে কি ডাক্তার একটু যেন বিস্মিতই হয়। এ তল্লাটে আড়াইশো টাকা ফিস এক কথায় দিতে রাজী হয়! তাছাড়া ডাঃ সেন বৎসরখানেক হয় এখানে এসে প্র্যাকটিস শুরু করেছে, কিন্তু কই রায়বাহাদুর দুযোধন চৌধুরী বা শ্রীনিলয়ের নাম ইতিপূর্বে কখনও শুনেছে বলে তো মনে পড়ে না। তাই যেন কিছুটা কৌতূহল জাগে মনের মধ্যে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে ডাক্তার পুনরায় বসবার ঘরে ফিরে এসে বলে, চলুন। আগে সেই বৃদ্ধ ও পশ্চাতে ডাঃ সেন তাকে অনুসরণ করে ওরা বাইরে এসে দাঁড়ায়। আকাশে স্বল্প জ্যোৎস্না পাতলা একটা কুয়াশার আবরণের তলায় যেন মৃতি হয়ে পড়ে আছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সেই মৃদু জ্যোৎস্নালোকে ডাক্তার দেখতে পায় গেটের অনতিদূরে কালো রঙের একখানা সুবৃহৎ প্যাকার্ড-গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তূপীকৃত একটা ছায়ার মতই।
বৃদ্ধই এগিয়ে গিয়ে গাড়ির সামনে উপবিষ্ট ড্রাইভারকে সম্বোধন করে বলে, রামনরেশ, দরজাটা খুলে দাও।
ডাক শুনেই ড্রাইভার নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজা খুলে দিল।