Site icon BnBoi.Com

ড্রাগন – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

ড্রাগন - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

১. বর্ষা-মেদুর সন্ধ্যা

চারিদিকে আবছা কালো অন্ধকারের যেন যবনিকা থিরথির করে কাঁপছে। কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে তার বসবার ঘরে কৃষ্ণা চুপটি করে বসে কিরীটীর গল্প শুনছে। কিরীটীর পরিধানে গেরুয়া রঙের খদ্দরের ঢোলা পায়জামা ও গেরুয়া রঙের ঢোলা খদ্দরের পাঞ্জাবি।

মুখে পাইপ।

কিরীটী বলছিল : এই মিস্ত্রি, যাকে তোমরা রহস্য বল-এ কোন ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে পাওয়া যায় না। কত প্রকারের মিস্ট্রিই যে আমি দেখেছি ও শুনেছি-রাতের পর রাত তোমাদের বসে বসে আমি গল্প শোনাতে পারি। ক্রাইমের রহস্য আছে : কোন খুনের মামলার যখন আদালতে বিচার হয়, আদালতে প্রত্যেকটি দর্শক তখন উদগ্রীব ও উৎসুক হয়ে থাকে। ধর একটা খুন হল, কে খুন করলে? কেন খুন করলে? কেমন করে কোন অবস্থায় কখন খুন হল? একটার পর একটা চিন্তা আমাদের মনের মাঝে রহস্যের জাল বুনতে শুরু করে। এই এক ধরনের মিস্ত্রি। আবার হয়ত এমন হল, কোন লোক সহসা আশ্চর্য ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় গেল সে অদৃশ্য হয়ে? কেমন করে সে অদৃশ্য হল? তাকে কি কেউ চুরি বা গায়েব করে নিয়ে গেল? অথবা কেউ কি তাকে খুন করে পৃথিবী থেকে তার মৃতদেহ চিরতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে ফেললে? কিংবা হয়ত কোন নিরালা মাঠের প্রান্তে পাওয়া গেল তার হিমশীতল প্রাণহীন দেহখানি কিংবা কোন এক প্রাসাদোপম অট্টালিকার কোন এক নির্জন সুসজ্জিত কক্ষে দেখা গেল পড়ে আছে তার মৃতদেহ। অথবা কোন নদীকিনারে এসে ঠেকে রয়েছে তার মৃত্যুশীতল প্রাণহীন দেহ।

আর তার কাছ থেকে জানা যাবে না কোনদিন কখন কে বা কারা কি ভাবে তাকে এমনি করে খুন করে ফেলে রেখে গেল!

ভাষা তার চিরদিনের জন্য মূক হয়ে গেছে।

আর সে কথা বলবে না, আর সে সাড়া দেবে না।

নিস্তব্ধ স্বল্পালোকিত কক্ষের মধ্যে কিরীটীর স্বপ্নাতুর কণ্ঠস্বর রিম্ ঝিম্ করতে লাগল। বাইরে তখন অশ্রান্ত বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

সোঁ সোঁ করে প্রচণ্ড হাওয়া বন্ধ জানালার কাঁচের শার্সির গায়ে এসে আছাড়িপিছাড়ি করছে।

মাঝে মাঝে হিল-হিল করে উঠছে বিদ্যুতের অগ্নি-ইশারা। কড়কড় করে কোথায় যেন বাজ পড়ল।

পথের ধারের বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছটা ঝড়জলে সোঁ-সোঁ সপসপ শব্দ তুলেছে।

পাইপের আগুনটা নিভে গিয়েছিল, কিরীটী আবার তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিল।

আবার সে বলতে শুরু করল : এ ধরনের মিস্ত্রিও আছে- একটু অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, অদ্ভুত সব দৃশ্য চোখে পড়ে-যখন কেউ কোথাও জেগে নেই; সব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে। অদ্ভুত অশরীরী সব মৃদু চাপা পায়ের শব্দ কোন অন্ধকার শূন্য ঘর থেকে হয়ত শোনা যাচ্ছে। ছুটে হয়ত দেখতে গেলে সেখানে কিসের শব্দ, কিছু চোখে পড়ল না।

যেন মায়ায় গেছে সব মিলিয়ে।

সাত সমুদ্র তের নদীর পার থেকে স্বপ্নের ফাঁকে ভেসে আসা ঘুমন্ত রাজকন্যার স্মৃতির মত।

কেউ হয়ত দেখে, আবছা চাঁদের আলোয় কোন পোড়ো বাড়ির বারান্দায় নিঃশব্দে একাকী কে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

কে সে?

কেন সে একাকী গভীর রাতে এমনি করে পোড়ো বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়?

কাকে সে খোঁজে?

সে কি কোন বিদেশী রাজপুত্র, হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারীকে আজও এই পৃথিবীর ঘরে ঘরে নিশীথ রাতে খুঁজে খুঁজে ফেরে? মানুষ না ছায়া? না মিথ্যা দুঃস্বপ্ন?

শরীর সহসা রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।

মিস্ত্রি! মিস্ত্রি! রহস্য!

কার চাপা ফিসফিস কণ্ঠস্বর? কার করুণ কান্নার সুর? মৃদু গানের আওয়াজ বা সঙ্গীতের মৃদু রেশ…রাতের নিঃশব্দে অন্ধকারে এমনি করে ভেসে আসে।

কে শব্দ করে? কে কথা বলে? কে গান গায়? কে বাজায় একা একা আপন মনে?

এ প্রশ্নের মীমাংসা কোথায়? কোথায় এ রহস্যের সমাধান? শুধু কী এই? মানুষের চরিত্রও কি অনেক সময় একটা প্রকাণ্ড রহস্য হয়ে আমাদের চোখের কোণে মায়া জাগায় না? এই পৃথিবীর ঘরে ঘরে কত বিভিন্ন চরিত্রের লোকই না আছে। কেউ কাদে পরের দুঃখে, কেউ দুঃখ দিয়ে আনন্দ পায়। কেউ ভালবেসে হয় সুখী, কেউ ঘৃণা করে আনন্দ পায়। কেউ আপনাকে বিলিয়ে দিয়েই ধন্য, কেউ অন্যকে বঞ্চিত করে নিজেকে মনে করে ধন্য!

***

বিচিত্র—সব বিচিত্র রহস্যময় বিচিত্র এই পৃথিবী! বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষ!

মানুষই মানুষকে করে খুন।

যে খুন করেছে সেও মানুষ—যাকে খুন করছে, সেও তারই মত একজন মানুষ!

কেউ উদ্দেশ্য নিয়ে খুন করে, আবার কেউ বিনা উদ্দেশ্যেই নিছক নেশায় খুন করে।

ডাক্তারী ভাষায় বলা হয় তাদের—হোমিওসাইড্যাল ম্যানিয়াক মানুষের।

.

সারাটি রাতের বর্ষণক্লান্ত প্রকৃতি প্রথম ভোরের আলোয় ঝিলমিল করছে। কিরীটী লম্বা টান-টান হয়ে একটা বড় সোফার উপরে গভীর আলস্যে শুয়ে চোখ বুজে নিঃশব্দে চুরুট টানছে।

চুরুটের পীতাভ ধোয়া মাথার উপরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অদূরে আর একটা সোফায় বসে কৃষ্ণা সেদিনকার দৈনিক সংবাদপত্রটা ওলটাচ্ছে।

সহসা একসময় কৃষ্ণা বলে উঠল, আজকের সংবাদপত্রটা দেখেছ?

কিরীটী চোখ বুজেই জবাব দিল : না, কেন?

বিখ্যাত ডেনটিস্ট ডাঃ চৌধুরীকে কে বা কারা যেন নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে তার সাজারী রুমে। ক্লিনিকে–

কি রকম?

এই দেখ না, কৃষ্ণা সংবাদপত্রটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিল।

কিরীটী হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণার হাত থেকে সেদিনকার দৈনিকখানা নিল। বললে, বল কি, চৌধুরী যে আমার বিশেষ বন্ধু!

বিখ্যাত দন্ত-চিকিৎসক
ডাঃ এন, এন, চৌধুরীর রহস্যময় মৃত্যু

গতকল্য বেলা সাতটার সময় বিখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডাঃ এন. এন. চৌধুরীকে ধর্মতলাস্থ তার শয়নকক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

অতীব নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক ভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। গলার সামনের দিকে একটা তিন ইঞ্চি পরিমাণ ভয়ঙ্কর ক্ষত ও বাম দিককার বুকেতে একটি চার ইঞ্চি পরিমাণ ক্ষত। মনে হয় যেন কোন তীক্ষ্ণ নখরে গলার ও বুকের মাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে। ডাঃ চৌধুরী মাত্র বছর-চোদ্দ আগে জার্মানী থেকে দন্ত চিকিৎসায় পারদর্শী হয়ে আসেন। শহরে দন্তচিকিৎসক হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম ও প্রতিপত্তি ছিল। ধনী পিতার তিনি একমাত্র পুত্র ছিলেন। নিজেও প্রভূত অর্থ উপায় করেছেন। তিনি অবিবাহিত ও সংযমী, অত্যন্ত বিনয়ী স্বাস্থ্যবান সুপুরষ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে দিন পনের আগে চেতলার অবসরপ্রাপ্ত আলিপুর জেলের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট গণনাথ মিত্রের হত্যার কথা মনে পড়ল। তাকেও একদিন প্রাতে তার শয়নকক্ষে ঐরূপ নৃশংস অবস্থায় পাওয়া যায়। তারও গলায় ও বাম দিককার বক্ষে ঐরূপ নৃশংস ক্ষত ছিল। পুলিসের কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে কী বলেন?

কিরীটী সংবাদপত্রটা কৃষ্ণার হাতে ফেরত দিতে দিতে বললে–

হবুচন্দ্র রাজা তার গবুচন্দ্র মন্ত্রী
পথেঘাটে সদা ঘোরে সশস্ত্র সান্ত্রী!
হঠাৎএকদা রাজা ডাকিলেন ‘গবু’!
রাজ্যে এত খুনোখুনি শুনিনি তো কভু!
কহিলেন গবু : তবে শোন মহারাজ,
নিশ্চয় ঘুমায় সান্ত্রী করেনাকো কাজ।
শুনি হবু বলে তবে চক্ষু করি লাল,
মাহিনা দিতেছি তবু একি হীন চাল!
আমি হবু, তবু রাজ্যে একি অনাচার
এখুনি মস্তকচ্যুত করহ সবার।
শুনি গবু বলে তবে, একি মহারাজ;
গরীবের শির লবে একি তব কাজ!

এমন সময় সুব্রত হাসতে হাসতে এসে ঘরে প্রবেশ করল। কার শির নিচ্ছ হে। কার আবার-তোমার?

অপরাধী জানিল না কি দোষ তাহার? বিচার হইয়া গেল তবু?

এসব কি শুনছি হে সুব্রতচন্দ্র? তোমার রাজ্যে কি আজকাল মানুষেই মানুষ খেতে শুরু করেছে?

হ্যাঁ, কন্ট্রোলের চালে মানুষের পেট ভরছে না, তাই মানুষের বুকের মাংস খুবলে খেতে হচ্ছে।

তা তো বুঝলাম, কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী বল তো?

মাথামুণ্ডু এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না, তবে চেষ্টার ত্রুটি করছি না।

.

কয়েকদিন পরে গভীর রাত্রে। শীতের মধ্যরাত্রি। স্বল্প কুয়াশার মৃদু অস্বচ্ছ অবগুণ্ঠনতলে কলিকাতা শহর যেন তন্দ্রানত।

ব্ল্যাক আউটের নিস্তেজ বাতির ম্রিয়মাণ রশ্মিগুলি কুয়াশার মায়াজালে আটকা পড়ে যেন মুক্তির আশায় পীড়িত হয়ে উঠেছে।

কিরীটী শ্যামবাজারে এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বাড়ি ফিরছে।

ট্রাম ও বাস বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তায় লোকচলাচল একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে বললেও চলে। শুধু হেথা-হোথা ফুটপাতের উপরে ও ঝোলানো বারান্দার আশ্রয়ে দু-একজন ভিক্ষুক নিঃসঙ্গ রাত্রির বুকে জীবনের স্পন্দনটুকু জাগিয়ে রেখেছে।

কিরীটী ইচ্ছা করেই গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। হীরা সিংকে বলে দিয়েছিল সে হেঁটেই বাড়ি ফিরবে।

প্রভুর এ ধরনের অদ্ভুত খেয়ালের সঙ্গে হীরা বিশেষ করেই পরিচিত ছিল, তাই বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।

কিরীটী গায়ে লংকোটটা চাপিয়ে পাইপটায় অগ্নিসংযোগ করে মৃদু মৃদু টান দিতে দিতে পথ চলছিল।

স্তব্ধ নির্জন রাত্রির একটা নিজস্ব রূপ আছে। প্রকৃতি সেখানে নিঃশেষে আপনাকে মুক্ত করে দেয়। দুহাতে নিঃস্ব করে আপনাকে বিলিয়ে দেয়।

মানুষের মন যেন সেখানে অনায়াসেই আপনাকে খুঁজে পায়, সেখানে কোন দম্ভ থাকে, কোন প্রশ্ন থাকে না, এইভাবে একাকী আপন মনে রাত্রির নিঃসঙ্গতায় পথ চলতে কিরীটীর বড় ভাল লাগে।

বৌবাজারের কাছাকাছি আমহার্স্ট স্ট্রীটের মোড়ে তখনও একটা পানের দোকানে দুএকজন খরিদ্দারের ভিড়। কিরীটী এগিয়ে চলে।

এত বড় জনকোলাহল-মুখরিত নগরী যেন কোন যাদুমন্ত্রের স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত্রি তখন প্রায় দেড়টা হবে—কিরীটী রসা রোড ও লেক রোডের কাছাকাছি এসে আবার তার পাইপটায় নতুন করে তামাক ভরে অগ্নিসংযোগ করে নিল।

সবে কয়েক গজ এগিয়েছে এমন সময় একটা দীর্ণ আর্ত চিৎকার নৈশ রাত্রির স্তব্ধ নির্জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে জেগে উঠল।

কিরীটী থমকে দাঁড়াল।

দীর্ণ চিৎকারটা যেন সহসা রাত্রির স্তব্ধ সমুদ্রে একটা আকস্মিক শব্দের ঢেউ তুলে সহসাই মিলিয়ে গেল।

কিরীটী ভাবলে, শুনতে ভুল হয়নি তো? অন্যমনস্ক ভাবে সে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করতে লাগল।

আবার সেই চিৎকার।

না, ভুল নয়। এ যে কোন মানুষের বুক-ভাঙা দীর্ণ চিৎকার!

কিরীটী উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়াল। আবার সেই চিৎকার!

মনে হচ্ছে যেন ডান দিককার কোন একটা বাড়ি থেকে আসছে সেই চিৎকারের শব্দ।

ডানদিকে কতকগুলো একতলা, দোতলা, তিনতলা নানা আকারের বাড়ি। ব্ল্যাক আউটের স্তিমিত আলোকে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই প্রতীয়মান হয়।

কিরীটী দ্রুতপদে অনুমানে শব্দটা যেদিক থেকে আসছিল সেইদিক লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল।

একটা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পাশের একটা সরু গলিপথ দিয়ে কে যেন ছায়ার মত দ্রুতপদে এগিয়ে এল।

লোকটার সর্বাঙ্গে কালো রঙের পোশাক। মাথায় একটা কালো রঙের ফেল্ট টুপি। একপাশে ঈষৎ নামানো। লোকটা এসে দ্রুতপদে পথের ধারে একটা গ্যাসপোস্টের নীচে দাঁড়াল। কিরীটী দু-তিন হাত দূরে একটা গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখতে লাগল, অথচ লোকটা কিন্তু কিরীটীকে দেখতে পেল না। লোকটার সর্বাঙ্গ যেন একটা গভীর উত্তেজনায় কাঁপছে। গ্যাসপোস্টের খানিকটা আলো তির্যক গতিতে লোকটার মুখের ডানপাশে এসে পড়েছে।

সেই স্তিমিত আলোয় লোকটার চোখ দুটো যেন কী এক ভয়ঙ্কর ক্ষুধিত জিঘাংসায় আগুনের ভাটার মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মাথার চুলগুলো ডান দিককার কপালে এসে পড়েছে।

একজোড়া পাকানো গোঁফ।

লোকটা পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ঘন ঘন মুখ মুছতে শুরু করল।

এমন সময় পাশের একটা বাড়ি থেকে প্রচও একটা গোলমালের শব্দ শোনা গেল।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা চমকে রাস্তায় নেমে দ্রুতপদে চলতে লাগল এবং ঘন ঘন পিছনপানে তাকাতে লাগল। কিরীটীও নিঃশব্দ পদসঞ্চারে লোকটাকে অনুসরণ করল। লোকটা আরও দ্রুতবেগে রাস্তাটা পার হতে লাগল। কিরীটীও তার চলার বেগ বাড়িয়ে দিল।

কিন্তু কিরীটী লোকটার কাছাকাছি পৌঁছবার আগেই রাস্তার ধারে রক্ষিত একটা সাইকেলে চেপে লোকটা সোঁ সোঁ করে নিমেষে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

কিরীটী যখন সেখানে এসে পৌঁছল, দেখলে সাইকেলটা যেখানে ছিল সেইখানে রাস্তার উপরে কী একটা কাপড়ের মত পড়ে আছে।

নীচু হয়ে কিরীটী জিনিসটা তুলে নিল হাতে।

নিশ্চয়ই লোকটা রুমালটা তাড়াতাড়িতে ফেলে গেছে।

কিরীটী রুমালটা হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে রাস্তার ওপাশে যেখান থেকে তখনও গোলমাল আসছিল সেইদিকে এগিয়ে গেল।

গোলমালটা আসছিল একটা গেটওয়ালা দোতলা বাড়ি থেকে।

বাড়িটার কক্ষে কক্ষে তখন আলো জ্বলে উঠেছে। অনেক লোক চলাফেরা করছে।

কিরীটী গেট খুলে এগিয়ে গেল।

দরজার সামনে অল্পবয়স্ক একটি যুবককে দেখে কিরীটী তাকেই প্রশ্ন করলে, কী ব্যাপার মশাই?

কে আপনি? যুবক প্রশ্ন করলে।

একজন পথিক ভদ্রলোক, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, গোলমাল শুনে দেখতে এলাম, ব্যাপার কী?

কী আর বলব মশাই!…যুবকের কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল।

কিরীটী স্পষ্টই বুঝতে পারলে কোন কারণে যুবক অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

কী, ব্যাপার কী?

ব্যাপার যে কী তা কি আমিই বুঝতে পারছি! ভৌতিক কাণ্ড মশাই!

ভৌতিক কাণ্ড! বলেন কী?

তাছাড়া আর কী? মানুষ যে মানুষকে ওভাবে খুন করতে পারে, এ যে স্বপ্নেরও অতীত।

খুন?

হ্যাঁ, খুন।

পুলিসে সংবাদ দিয়েছেন?

না, দিইনি তো!

ফোন আছে বাড়িতে?

আছে।

চলুন শীগগির পুলিসে একটা ফোন করা যাক।

কিরীটী যুবকের সঙ্গে বৈঠকখানায় এসে ফোনের রিসিভার তুলে নিল, হ্যালো বড়বাজার…

ওপাশ থেকে জবাব এল, হ্যালো, কে?

কে, সুব্রত? কিরীটী প্রশ্ন করলে এপাশ থেকে।

হ্যাঁ, ব্যাপার কী? কিরীটী না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। শীঘ্র এস। ..নং রসা রোডে একজন খুন হয়েছেন।

খুন? এত রাত্রে?

আরে ছাই, এসোই না!

তুমি থাকছ তো?

হ্যাঁ আছি, এস তাড়াতাড়ি। কিরীটী রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

তারপর যুবকের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন, দেখি কোথায় খুন হয়েছে।

আসুন। নিস্তেজভাবে যুবক কিরীটীকে আহ্বান করল।

উপরের একটা ঘরে যুবকের পিছু পিছু কিরীটী এসে প্রবেশ করল।

.

বেশ প্রশস্ত সাজানো-গোছানো একখানা ঘর। মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো। ঘরের একপাশে একখানা দামী খাটে নিভাজ একটি শয্যা বিছানো।

একপাশে একটি টেবিল ও একটি বুকসেলফ, টেবিলের উপরে কাগজপত্র পাকার করা আছে।

একপাশে একটি লোহার সিন্দুক। টেবিলের সামনে একটি গদি-মোডা চেয়ার। টেবিলের উপরে সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা একটি টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। তারই আলোয় ঘরটি আলোকিত।

মেঝেয় কাপেটের উপরে দামী স্লিপিং স্যুট পরা কে একজন উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

পিঠের দিকে স্লিপিং স্যুটটা ছিন্নভিন্ন, রক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠেছে।

কিরীটী এগিয়ে দেখল, পিঠের উপরে প্রকাণ্ড দু-তিনটি গভীর ক্ষত।

মনে হয় কোন এক হিংস্র রক্তপিপাসু জন্তু যেন তীক্ষ্ণ দন্তাঘাতে লোকটার পিঠের মাংস খুবলে নিয়েছে।

উঃ, কী ভয়ানক পৈশাচিক দৃশ্য!

কিরীটী পকেট থেকে টর্চ বের করে ভূপতিত ব্যক্তিকে আলোতে আরও ভাল করে দেখতে লাগল।

একবার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখতে পেল, নাকমুখ দিয়ে রক্তাক্ত ফেনা গড়াচ্ছে।

চোখ দুটো খোলা, যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতে চায় মুখে-চোখে একটা অস্বাভাবিক আতঙ্ক যেন প্রকট হয়ে উঠেছে।

কিরীটী লোকটার বুকে হাত দিয়ে দেখলে, না, লোকটার নিঃসন্দেহে মৃত্যু হয়েছে।

গলার উপরে ও কিসের নীল দাগ! ও যে আঙুলের দাগ বলেই মনে হয়! হ্যাঁ, লোকটাকে কণ্ঠনালী চেপে নিষ্ঠুরভাবে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।

কিন্তু কী ভয়ঙ্কর পৈশাচিকতা, কী দানবীয় নিষ্ঠুরতা!

কিরীটী একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং অদূরে স্থাণুর মত দণ্ডায়মান যুবকের মড়ার মত রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকাল।

চলুন এ ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া যাক।

কিরীটী মৃদুস্বরে যুবককে বললে।

দুজনে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে দুখানা চেয়ার অধিকার করে বসল।

বাইরে তখন চার-পাঁচজন ভৃত্য উঁকিঝুঁকি মারছে।

উনি আপনার কে হন? কিরীটীই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশ্ন করলে।

আমার জ্যেঠামশাই। বিখ্যাত ডাঃ অমিয় মজুমদার।

উনিই ডাঃ অমিয় মজুমদার?

হ্যাঁ।

আপনার নাম?

সুশীল মজুমদার।

এ বাড়িতে আর কে আছেন?

জ্যেঠামশাই ব্রহ্মচারী, চিরকুমার। আমি ছোটবেলায় মা-বাপকে হারিয়েছি, জ্যেঠামশাইয়ের কাছেই মানুষ। যুবকের চোখদুটি ছলছল করে এল। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।

এরা সব?

চাকরবাকর, ঠাকুর, সোফার।

ব্যাপারটা কখন জানতে পারলেন?

আমি জ্যেঠামশাইয়ের পাশের ঘরেই ঘুমোই। জ্যেঠামশাই রাত্রে সাধারণতঃ অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করেন। আজও বোধ হয় তাই করছিলেন। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমটা বুঝতে পারিনি।

আবার চিৎকার শোনা গেল। তখন মনে হল যেন পাশের ঘর থেকেই আসছে, ছুটে ঘরের বাইরে চলে আসি। জ্যেঠামশাইয়ের ঘরের দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখি দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।

অনেক কষ্টে ঠেলাঠেলি করে ও চিৎকার করেও যখন দরজা খুলতে পারছি না, এমন সময় সহসা দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল এবং কে যেন অন্ধকারে ঝড়ের মত আমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েই ছুটে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। ততক্ষণে চাকরবাকরেরাও গোলমাল শুনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। কিন্তু লোকটা সকলকে যেন ঝড়ের মতই ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে আচমকা অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেখেছিলেন লোকটা দেখতে কেমন?

ভাল করে দেখতে পাইনি, তবে মনে হল যেন কালো পোশাক পরা।

কিরীটী একবার চমকে উঠল। তবে কি…

এমন সময় বাইরের রাস্তায় মোটর থামবার শব্দ শোনা গেল।

একটু পরেই সিঁড়িতে কার জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।

সুপার সুব্রত রায় আসছেন। কিরীটী বললে।

সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করল। হ্যালো কিরীটী! ব্যাপার কি?

কিরীটী হাত তুলে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, বস সুব্রত।

ইনি শ্রীযুক্ত সুশীল মজুমদার।..কিরীটী একে একে সুব্রতকে সমস্ত ব্যাপার খুলে বললে।

সুব্রত খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বললে, হুঁ। তারপর সুব্রত পাশের ঘরে গিয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখল। সমস্ত বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল সিন্দুকটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, বন্ধই আছে, কিছু চুরি যায়নি।

ততক্ষণে কয়েকজন লালপাগড়ীও এসে গেছে।

বাড়িটা বেশ প্রশস্ত।

উপরে নীচে সর্বসমেত আটখানি ঘর।

দেখা গেল বৈঠকখানায় একটা কাঁচের জানলা ভাঙা।

জানালার দুপাশে দুটো বাড়ির মাঝখানে একটা সরু গলিপথ।

আশেপাশের বাড়ির অনেকে তখন ঘুম ভেঙে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

বোঝা গেল ওই জানালা-পথেই খুনী বাড়িতে প্রবেশ করেছিল।

বাড়ির ঠাকুর, চাকর, সোফারের জবানবন্দি নিয়ে মৃতদেহ ময়নাঘরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে, দুজন লালপাগড়ী বাড়িতে মোতায়েন রেখে কিরীটী ও প্রত যখন ডাঃ মজুমদারের বাড়ি ছেড়ে পথে বের হয়ে এল রাত্রি তখন পৌনে চারটে।

সুব্রত কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, চল্ তোকে পৌঁছে দিয়ে যাই।

দুজনে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ছুটে চলল।

গাড়িতে আর কোন কথাবার্তা হল না।

গাড়ি এসে টালিগঞ্জে কিরীটীর বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বাইরের ঘরে এসে দুজনে বসে জংলীকে দু কাপ চায়ের আদেশ দিল।

বাইরের ঘরে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় কিরীটী পকেট থেকে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া রুমালটা বের করতেই চমকে উঠল।

সমস্ত রুমালটাই চাপ চাপ রক্তের লাল দাগে ভর্তি।

সুব্রত বিস্মিত ভাবে কিরীটীর হস্তধৃত রুমালটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কী ওটা?

কিরীটী চিন্তিতভাবে জবাব দিল, একটা রক্তমাখা রুমাল।

হুঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু কোথায় পেলি ওটা?

রাস্তায় কুড়িয়ে, একজন তাড়াতাড়িতে রাস্তায় ফেলে গেছে।

মানে?

কিরীটী তখন একে একে সমস্ত কথা খুলে বলল সুব্রতকে।

ধরতে পারলি না লোকটাকে?

না। কিন্তু আমি ভাবছি, এ কি সত্যই সম্ভব? মানুষে মানুষের মাংস খায়? মনে পড়ে দন্ত-চিকিৎসক ডাঃ চৌধুরীর রহস্যময় মৃত্যুর কথা?

কিরীটী বলতে লাগল, দুটো কেসই একেবারে হুবহু মিলে যাচ্ছে না কি?

কি বলতে চাস তুই? প্ৰত অধীরভাবে প্রশ্ন করলে।

ঠিক যা তুই ভাবছিস তাই বলতে চাই, তার চাইতে বেশী কি আর! এই বর্তমান সভ্যতার যুগেও ক্যানিবালিজিম চলে?

অ্যাঁ!

হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী? আদিম যুগে মানুষ যখন ছিল বর্বর, তখন নাকি মানুষে মানুষ খেত। কিন্তু গুহা ছেড়ে তো অনেকদিন তারা লোকালয়ে এসে ঘর বেঁধেছে। হয়েছে সভ্য পরিপাটি। তবে এর অর্থ কি? আর তাছাড়া যদি বলি একটা হোমিসাইডাল ম্যানিয়া, এমনি করে খুনের নেশায় মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে!

তা কি সম্ভব?

অসম্ভব বলে এ দুনিয়াতে কিছুই নেই ভাই। স্পষ্ট আমি দেখেছি লোকটাকে এই রুমালটা দিয়ে মুখ মুছতে।

কিরীটী ভাল করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রুমালটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। সাধারণ ক্যালিকো মিলের একটা রুমাল সাদা রঙের।

রুমালের কোথাও কোন বোপর বাড়ির চিহ্ন নেই। বোধ হয় একেবারে নতুন। একবারও নিশ্চয়ই ধোপা-বাড়ি দেওয়া হয়নি।

তবে রুমালের এক কোণে লাল সুতোয় ছোট্ট করে ইংরাজী K অক্ষরটি তোলা।

লোকটা দেখতে কেমন কিরীটী? ব্রত প্রশ্ন করলে।

এমন সময় জংলী দুহাতে দুটো ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল।

সামনে একটা টিপয়ের উপরে কাপ দুটো নামিয়ে রেখে জংলী ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

একটা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে কিরীটী চুমুক দিয়ে মৃদু একটা শব্দ করলে, আঃ!

কে বলে রে অমৃত সুদূর স্বর্গেতে,
চেয়ে দেখ ভরা এই চায়ের পাত্রেতে!

ভোরের আলো সবে ফুটি-ফুটি করছে। রাতের বিলীয়মান অন্ধকারের অস্বচ্ছ যবনিকাখানি একটু একটু করে নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে।

একটা মৃদু শীতল হাওয়া ভোরের বারতা নিয়ে খোলা জানলা-পথে ঝিরঝির করে এসে প্রবেশ করল।

সুব্রত আবার প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী বাধা দিয়ে বলে উঠল, লোকটা লম্বায় প্রায় ছফুট মত হবে। বলিষ্ঠ পেশল গঠন। দ্রুত চলুন। পরিধানে কালো রঙের গরম সার্জের সুট ছিল। মাথায় কালো রঙের ফেল্ট টুপি। মুখে একজোড়া বড় পাকানো গোঁফ। সামনের দাঁত দুটো উঁচু, নীচের ঠোঁটের উপরে চেপে বসেছে।

তীক্ষ্ণ শিকারী বিড়ালের মত খর-অনুসন্ধানী হিংস্র গোল গোল দুটি চোখ।– মৃদু গ্যাসের আলোয় যেন ভয়ঙ্কর এক শয়তানের প্রতিমূর্তির মতো দেখাচ্ছিল। এখনও যেন তার ক্ষুধিত চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমার চোখের উপর ভাসছে।

মানুষ-আমাদের মতই মানুষ? তবে?

হ্যাঁ মানুষ, তবে আমাদের মত কিনা জানি না। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দিল।

***

বালিগঞ্জ রেল স্টেশনের ধারে কাঁকুলিয়া রোডে প্রকাণ্ড ইমারততুল্য তিনতলা সাদারঙের একখানা বাড়ি।

বাড়ির লৌহ-ফটকের একপাশে কালো পাথরের বুকে সোনালী জলে খোদাই করে লেখা মহানির্বাণ, অন্যপাশে নামফলকে লেখা মহীতোষ রায়চৌধুরী।

মাত্র বছর ছয়েক হল মহীতোষবাবু কলকাতার এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছেন।

মহীতোষবাবুর পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয় অধিবাসীদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না।

কিন্তু অগাধ ধনশালী, চিরকুমার, উচ্চশিক্ষিত, অত্যন্ত অমায়িক বৃদ্ধ মহীতোষ রায়চৌধুরীকে শ্রদ্ধা করত না শহরে এমন একটি লোক ছিল না।

অনাথ আতুর কাঙালের জন্য তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকার লৌহদ্বার সর্বদাই খোলা থাকত।

প্রার্থীকে কখনও কেউ কোনদিন মহীতোষের দ্বার হতে রিক্তহস্তে ফিরতে দেখেনি।

স্কুলের চাঁদার খাতায়, স্থানীয় লাইব্রেরী, সর্বজনীন উৎসবাদি নানা প্রতিষ্ঠানে তাঁর চাঁদার অংশটা সকলকে ডিঙিয়ে যেত।

মুক্তহত উদার প্রকৃতির সদাহাস্যময় মহীতোষ সকলের বন্ধু। এই সব নানাবিধ গুণাবলীতেই শহরবাসীরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর নামকরণ করেছিল রাজা মহীতোষ।

মহীতোষের আধিপত্যও ছিল যথেষ্ট।

স্থানীয় স্কুল সমিতির প্রেসিডেন্ট, লাইব্রেরীর প্রেসিডেন্ট, সভা-সমিতির প্রেসিডেন্ট।

কোন উৎসবই মহীতোষকে বাদ দিয়ে চলে না।

কর্পোরেশনের একজন প্রতিপত্তিশালী কাউনসিলার মহীতোষ। গুজব সামনের মেয়র নির্বাচনে তিনিও একজন প্রার্থী।

মহীতোষের বয়স যে ঠিক কত সেটা অনুমান করা একটু বেশ কঠিন।

দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় ফুট। পেশল বক্ষ, বলিষ্ঠ গঠন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। গোলগাল সদাচঞ্চল দুটি চোখ, দৃষ্টিতে বুদ্ধির প্রখ্য যেন ঠিকরে বের হয়। কপালের দুপাশে একটুখানি টাক দেখা দিয়েছে। ঘন কৃষ্ণকালো চুলের মধ্যে দু-চারটে পাকা চুলও দেখা যায়। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।

মুখের গঠন তীক্ষ্ণ।

নীচের ঠোঁটটা একটু বেশী পুরু ও ভারী। মুখে সর্বদাই যেন খুশীর একটুকরো হাসি জেগে আছে।

সংসারে তাঁর আপনার বলতে কেউ নেই। তবে অনাত্মীয় গোয্যের দল তাঁকে আপনার জনের মত সর্বদাই আঁকড়ে ধরে আছে।

মহীতোষ মিতাহারী, সংযমী ও মিতভাষী।

উপরের তলায় দুখানি ঘর তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের জন্য, বাড়ির বাকি ঘরগুলিতে অনাত্মীয়ের দল ভিড় করে আছে।

ঠাকুর ও চাকর অনেকগুলি।

উপরে তাঁর নিজস্ব দখলে যে ঘর দুখানি, তার একখানি তাঁর শয়নঘর, অন্যখানি লাইব্রেরী। শয়নঘরখানি আকারে মাঝারি।

ঘরের এক কোণে একটা স্পিংয়ের খাটে নিভাঁজ শয্যা বিছানো। খাটের সামনেই একটি টিপয়ে একটা সুদৃশ্য নামী টাইমপিস ও টেলিফোন।

ঘরের মধ্যে প্রকাণ্ড একখানা এনলার্জড় ফটো। তাঁর পিতার।

ঘরে আর কোন আসবাবপত্র নেই। মেঝেতে দামী কাশ্মীরী কার্পেট বিছানো।

শয়নঘরের সংলগ্ন ছোট একটি ঘর আছে, তাতে মহীতোষের আবশ্যকীয় জামাকাপড় ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্রে বোঝাই।

ঘরটি সর্বদাই প্রায় তালা-বন্ধ থাকে।

শয়নঘরের সংলগ্ন বাথরুম আছে।

লাইব্রেরী ঘরখানি আকারে প্রশস্ত। মেঝেটায়ও দামী পুরু কার্পেট বিছানো। আধুনিক কেতাদুরন্ত ভাবে সুদৃশ্য সোফায় সজ্জিত। অদৃশ্য বৈদ্যুতিক বাতিদান থেকে ঘরখানি রাত্রে আলোকিত করার ব্যবস্থা। দু-তিনটি সিলিং ফ্যান। ঘরের চারপাশে সুদৃশ্য কাঁচের আলমারিতে নানা শাস্ত্রের সব বই।

ঘরের একপাশে একখানা সুদৃশ্য সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার উপরে কাগজপত্র, ফাইল প্রভৃতি সাজানো।

সামনে একখানা রিভলভিং গদী-আঁটা চেয়ার।

মহীতোষের বাড়িতে তাঁর দর্শনার্থীর ও দয়াপ্রার্থীর সদাই ভিড়।

কেউ এলে মহীতোষ তার সঙ্গে এই লাইব্রেরী ঘরে বসেই কথাবার্তা বলেন।

অতিথি-অভ্যাগতদের আদর-আপ্যায়নের কোন ত্রুটিই মহীতোষের বাড়িতে হয় না।

সাধারণতঃ সারাদিন ও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত মহীতোয সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেন।

সাড়ে সাতটার পরে কেউ এলে হাজার প্রয়োজনীয় কাজ হলেও তিনি কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেন না।

বাড়ির লোকেরা বলে, মহীতোষ নাকি অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করেন।

মহীতোষের নিজস্ব কাজকর্ম যা কিছু তার প্রিয় পাহাড়িয়া ভৃত্য ঝুমনই করে।

কলকাতার পুলিসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও মহীতোষের যথেষ্ট হৃদ্যতা দেখা যায়।

বিখ্যাত গোয়েন্দা সুপার সুব্রত রায় মহীতোষের একজন পরম বন্ধু।

প্রায়ই সুব্রত মহীতোষের ওখানে আসে ও নানা গল্পগুজবে সময় কাটায়।

সেদিন সন্ধ্যার দিকে মহীতোষের লাইব্রেরী ঘরে বসে দুজনে-সুব্রত ও মহীতোষ গল্প করছিলেন। মহীতোষ বলছিলেন, মানুষের মন সত্যই বড় বিচিত্র সুব্রতবাবু। মানুষ যে ঠিক কী চায় ও কী চায় না তা হয়ত নিজেই সে অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না। আসলে মানুষের মনের মধ্যে দুটো সত্তা আছে, তার মধ্যে একটা থাকে জেগে, অন্যটা থাকে ঘুমিয়ে।

অথচ সবচাইতে আশ্চর্য এই যে, ঘুমন্ত সত্তাকে অবহেলা করবার মত তার মনের জাগরিত আর কোন ক্ষমতাই নেই। অলক্ষ্যে সেই ঘুমন্ত সত্তা প্রভাব বিস্তার করে মানুষের মনের উপরে। এই ঘুমন্ত সত্তাকে ভুলে থাকবার কি চেষ্টাই না আমরা করি!

সুব্রত জবাব দিল, অবিশ্যি যা আপনি বলছেন সবই স্বীকার করি কিন্তু তবু মানুষের সংযম শিক্ষা ও জম্মগত সংস্কার চিরদিনই কি সেই ঘুমন্ত সত্তার উপরে প্রভাব বিস্তার করে না মিঃ চৌধুরী?

স্বীকার করি করে, কিন্তু ঐ যে বললেন জম্মগত সংস্কার-ওটাকে আমি তত importance দিই না। সেটা প্রকৃতি ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক নিয়ে গড়ে ওঠে।

আসলে জম্মগত সংস্কার ওটা একটা মন ভুলানো কথা। মনের সত্যিকারের জোর থাকলে ওটাকে আমরা অনায়াসেই ইচ্ছামত গড়ে তুলতে পারি। তাছাড়া মানুষের জন্মের জন্য তো মানুষ দায়ী নয় সুব্রতবাবু। স্ট্যালিন মুচির ঘরে জম্মেও স্ট্যালিনই হয়েছে, হিটলার হিটলার হয়েছে, জন্ম তত তাদের চরিত্রকে ধরে রাখতে পারেনি।

সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, পারেনি সত্যি বটে, তবু রক্তের ঋণকে কেউ কোনদিন অস্বীকার করতে পারেনি ও পারবে না। যে সংস্কার তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের প্রতি রক্ত-বিন্দুতে সংক্রামিত হয়েছে তার কাছে ধরা সে দিতে বাধ্য-ইচ্ছায়ই হোক বা অনিচ্ছায়ই হোক।

সুব্রতর কথায় মহীতোষবাবু হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন। রক্তের ঋণ! বেশ কথাটা কিন্তু মিঃ রায়। হ্যাঁ ভাল কথা, আপনি একদিন বলেছিলেন আপনার বন্ধু কিরীটী রায়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন, নিয়ে আসুন না তাঁকে একদিন এখানে। ক্রিমিনোলজি (অপরাধ-তত্ত্ব) সম্পর্কে চিরকালই আমার একটা উৎসাহ ও আগ্রহ আছে। অপরাধ-জগতের বিচিত্র ভাবধারা-তার সঙ্গে পরিচয় হবার মধ্যে বুঝি একটা ভয়ঙ্কর মাদকতা আছে।

***

রাত্রি দশটা পাঁচ মিনিটে একটা রাণাঘাট লোকাল ট্রেন আছে। যেসব অফিসফেরত বাবুর দল প্রথম দিককার লোকাল ট্রেনগুলোতে না গিয়ে এই শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরেন, তাঁদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

প্রত্যহই এই ট্রেনটায় বিশেষ ভিড় হয়। অনেক খুচরো ও পাইকারী ব্যাপারী, যারা কলকাতার হাটে-বাজারে শাকসজী, দুধ, ছানা প্রভৃতির বেচা-কেনা করে তাদের সংখ্যাও কম নয়।

একে শীতের ধোঁয়ায় মলিন রাত্রি, তার উপরে সেই সন্ধ্যা থেকে সারাটা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শিয়ালদহের তিন নম্বর প্ল্যাটফরমে রাণাঘাট লোকাল দাঁড়িয়ে আছে।

ট্রেন ছাড়তে তখনও প্রায় বিশ মিনিট বাকি।

প্ল্যাটফরমের স্তিমিত আলোয়, নানাবিধ যাত্রী ও ফেরিওয়ালাদের গুঞ্জনে প্ল্যাটফরমটিতে অদ্ভুত এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

চাই পান, পান ফ্রিগেট, গরম চা, সলটেড বাদাম…

ক্লান্ত অফিস-ফেরতা বাবুর দলের শ্লথ গতি, কারও হাতে ঝুলানো একটি ইলিশ মাছ, কারও হাতে আগরপাড়ার ক্যাম্বিসের ব্যাগে শিয়ালদহের বাজার থেকে কেনা তরিতরকারি, কারও বগলে ভাঁজ করা সেদিনকার দৈনিক পত্রিকাখানা, কারও হাতে রুমালে বাঁধা বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু খাবার।

ব্যাপারীদের কাঁধে শূন্য ঝাকা ও কলসী, মাতায় মলিন গামছা জড়ানো।

সকলেই ট্রেন ধরবার জন্য ব্যস্ত।

আলোহীন অন্ধকার বগাগুলোর মধ্যে ঠেঠেসি করে যাত্রীরা সব বসে, কেউ গল্প করছে, কেউ বিড়ি বা সিগারেট ফুঁকছে। কেউ বা পাশের যাত্রীর সঙ্গে যুদ্ধের খবর আলোচনা করছে।

যুদ্ধ লেগেছে সন্দেহ নেই।

যুদ্ধ। যুদ্ধ! যুদ্ধ!

একটা প্রবল বন্যা যেন ছুটে এসেছে ধনী, নিধন, সাধারণ গৃহস্থ প্রত্যেকের জীবনে।

ধ্বংসের আগুন জ্বলছে দিকে দিকে।

প্রত্যেকের ঘর ও বাহির সেই আগুনের শিখায় ঝলসে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মানুষের নীরব আর্ত চিৎকার জগতের বাতাস ভারী করে তুলেছে।

ঘরে আহার নেই, পরিধানে বসন নেই, পাবলিশার্সদের কাগজ নেই। প্রেসম্যান বই ছাপতে পারে না, দপ্তরী বই বাঁধতে পায় না। যুদ্ধের গোগ্রাসী ক্ষুধার অনলে সব আহুতি দিচ্ছে কিন্তু তবু মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা চলছে বয়ে। আশা, আকাঙক্ষা, দুঃখ, শোক, হাসি সবই আছে। যুদ্ধ যদি আরও দশ বছর চলে এমনিই সব চলবে।

****

ট্রেন ছাড়বার আর মাত্র মিনিট দশেক বাকি আছে।

একখানি সেকেণ্ড ক্লাস কামরা। সেখানেও ভিড়ের অন্ত নেই।

সমগ্র দেহ কালো একটা ভারী ওভারকোটে ঢাকা, মাথায় কালো ফেল্ট হ্যাট একজান যাত্রী এসে কামরার সামনে দাঁড়াল।

দরজার উপরেই একটি কেতাদুরস্ত যুবক দাঁড়িয়েছিল, তিলমাত্র বসবার স্থান নেই, সাতআটজন মাঝখানের জায়গাটুকুতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।

যুবকটি বললে, এ গাড়িতে জায়গা নেই, স্যার।

আগন্তুক তার বলিষ্ঠ মুষ্টিতে গাড়ির হ্যাণ্ডেলটা চেপে ধরে কর্কশ গলায় বললে, কেন?

যুবক জবাব দিল, কেন আবার কী, দেখছেন না সব ঠেসাঠেসি করে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, অন্য কামরা দেখুন।

দেখেছি, সব গাড়িই সমান। যেতে হবে আমাকেও। আগন্তুক জবাব দিল।

কামরার ভিতর থেকে কে একজন জবাব দিলেন, যাবেন তো, কিন্তু ঢুকবেন কোথায়? দেখছেন না তিলমাত্র জায়গা নেই?

আগন্তুক বললে, জায়গা করে নিতে হবে।

এবার একজন রুখে এল, আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি, বলছি জায়গা নেই তবু ঝগড়া করবেন, দেখুন না অন্য কোন গাড়িতে!

এমন সময় গাড়ির শেষ ঘণ্টা বাজল, গার্ড সবুজ আলো দেখিয়ে হুইসেল বাজাল।

আগন্তুক বলিষ্ঠ হাতে সামনের দণ্ডায়মান ভদ্রলোককে একটু ঠেলে কোনমতে গাড়িতে উঠে দাঁড়াল।

গাড়ি তেমনি চলতে শুরু করেছে।

গাড়ি প্রত্যেক স্টেশনে দাঁড়াবে।

ক্রমে স্টেশনে স্টেশনে যাত্রীরা নেমে যেতে লাগল।

ব্যারাকপুরে এসে গাড়ি খালি হয়ে গেল প্রায়।

গাড়িতে তখন আগন্তুক ও যুবকটি।

অন্ধকার শীতের রাত্রি।

টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।

যুবক আর আগন্তুক গাড়ির দুপাশে দুখানা সিট অধিকার করে বসে।

হঠাৎ একসময় আগন্তুক তার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, মুখে তার জ্বলন্ত সিগারেট।

যুবক আনমনে খোলা জানলা-পথে অন্ধকার প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নীরবে বসে।

আগন্তুক নিঃশব্দে এসে যুবকের সামনে দাঁড়াল ও ডান হাতখানি যুবকের কাঁধের উপরে রাখল।

কে? চমকে যুবক মুখ ফেরাল।

চাপা গম্ভীর গলায় আগন্তুক বললে, চুপ! আস্তে-কী নাম তোমার?

আগন্তুকের মুখে জ্বলন্ত সিগারেটের স্তিমিত আলোয় তার উদ্ভাসিত মুখের দিকে সভয়ে তাকালো যুবক।

লোহার মত শক্ত একখানা মুষ্টি যেন যুবকের কাঁধের মাংসপেশীকে সাঁড়াশীর মত আঁকড়ে ধরেছে।

উঃ, কী ভয়াবহ আগন্তুকের মুখখানা!

গোল-গোল দুটি চোখের দৃষ্টি সিগারেটের আগুনের আলোয় যেন কী এক অস্বাভাবিক মৃত্যুক্ষুধায় লকলক করছে। সামনের দিকে উপরের পাটির বড় বড় দুটো দাঁত নীচের পুরু ঠোঁটটার উপরে যেন চেপে বসেছে।

একজোড়া পাকানো গোঁফ।

মাথার টুপিটা একদিকে হেলানো।

মুখের খানিকটা অন্ধকারে অস্পষ্ট, খানিকটা স্তিমিত আলোয় ভয়ঙ্কর একটা নিষ্ঠুরতায় শক্ত কঠিন হয়ে উঠেছে।

যুবকের শরীরে স্নায়ু বেয়ে যেন তীব্র ভয়ের স্রোত সিরসির করে বয়ে গেল; সহসা সে একটা দীণ ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল।

আগন্তুক হাঃ হাঃ হাঃ করে তীব্র বাজের মত হেসে উঠল। সেই ভয়ঙ্কর হাসির শব্দ যেন অদ্ভুত একটা বিভীষিকায় চলন্ত গাড়ির শব্দকে ছাপিয়ে অন্ধকার কামরার মধ্যে প্রেতায়িত হয়ে উঠল।

আগন্তুক তখন দুহাত দিয়ে যুবকের কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। একটা গোঁ গোঁ শব্দ।…

যুবকের সমস্ত মুখখানা নীল হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো যেন ঠিকরে আঁখিকোটর থেকে বের হয়ে আসতে চায়।

আগন্তুকের সমস্ত মুখাবয়বের উপরে একটা পাশবিক নিষ্ঠুরতার পৈশাচিক আনন্দের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে।

দেখতে দেখতে আগন্তুকের বলিষ্ঠ মুষ্টির নিষ্ঠুর লৌহপেষণে হতভাগ্য যুবক গাড়ির গদিতে এলিয়ে পড়ল।

আগন্তুক আবার খলখল করে পৈশাচিক হাসি হেসে উঠল, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! মরেছে! নিঃশেষে মরেছে!

সহসা হঠাৎ পাগলের মত যুবকের বুকের উপরে ঝাপিয়ে পড়ে তীক্ষ্ণ নখরাঘাতে যুবকের বুকের জামা ছিঁড়তে লাগল। গাড়ির গতি মন্থর হয়ে আসছে না!

পাগলের মতই আগন্তুক যুবকের পেশল উম্মুক্ত বক্ষের দিকে তাকাল।

চোখের দৃষ্টিতে একটা দানবীয় লালসা যেন হিলহিল করে উঠল।

যেমন সে নীচু হয়ে যুবকের বুকের মাংসে তার ধারাল দাঁত বসিয়েছে, খানিকটা তাজা রক্ত তার জিহ্বায় এসে লাগল।

যেন একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ে শিকারের বুকে চেপে বসেছে! সহসা এমন সময় গাড়িটা থেমে গেল।

কিন্তু দানবের সেদিকে লক্ষ্য নেই।

আচমকা একটা টর্চের আলোর রক্তিম আভা দানবটার উপরে এসে পড়ল—সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার-ভূত! ভূত!

চকিতে দানবটা পাশের দরজা খুলে অন্ধকারে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এদিকে সেই চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আশেপাশের কামরা থেকে লোক এসে জড়ো হয়েছে। ব্যাপার কী! ব্যাপার কী মশাই!

ঐ কামরার মধ্যে ভূতে মানুষ খাচ্ছে! কে একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে বললে। আর একজন বললে, স্বপ্ন দেখছেন না তো মশাই!

একজন মন্তব্য করলে, গাঁজায় দম চড়িয়েছেন নাকি? কিন্তু সত্যি সত্যি যখন সকলে বাক-বিতণ্ডার পর গার্ডের সঙ্গে আলো নিয়ে কামরাটার মধ্যে এসে প্রবেশ করল তখন সেখানকার সেই ভৌতিক দানবীয় দৃশ্য দেখে সকলেই চমকে উঠল।

হতভাগ্য যুবকের মৃতদেহ তখনো কামরার গদীর উপরে লুটিয়ে পড়ে আছে। বুকের জামা ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। ডান দিককার বুকের মাংস কে যেন নিষ্ঠুরভাবে দাঁত দিয়ে বলে ছিড়ে নিয়ে গেছে।

G.I.P-র পুলিস এল, স্টেশন মাস্টার এলেন, লাশ স্টেশনে নামানো হল, গাড়ি আবার চলল।

পরের দিন সমস্ত দৈনিকে বড় বড় হরফে প্রকাশিত হয়েছে দেখা গেল–

ভয়ঙ্কর নরখাদক দানবের আবিভাব! এই শহরের বুকে এই সভ্য যুগে! হতভাগ্য যুবকের পৈশাচিক মৃত্যু! সেই অদৃশ্য ভয়ঙ্কর নরখাদকের হাতে এই তৃতীয় ব্যক্তির শোচনীয় মৃত্যু!

শহরবাসী অবগত আছেন কয়েক মাসের মধ্যে আলিপুরের অবসরপ্রাপ্ত সুপার ও ডা এন. এন. চৌধুরীর এইভাবে মৃত্যু হয়। তারপর আর একজন বিখ্যাত ডাক্তার অমিয় মজুমদারের মৃত্যু হয়। এই যে শহরের বুকে অবাধে নরহত্যালীলা চলেছে এর শেষ কোথায়? ঘটনাগুলি হতে স্পষ্টই মনে হয়, বুঝিবা কোন নরখাদক এই শহরের বুকে হত্যালীলা করে বেড়াচ্ছে। আবার কি সেই বন্য বর্বর যুগ ফিরে এল? পুলিসের কর্তৃপক্ষ কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন? সমগ্র শহরবাসী আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। এইভাবে যদি নরখাদক আরও কিছুদিন এই শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, তবে যে শহরবাসীর মধ্যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তা কি পুলিসের কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছেন না? ইত্যাদি ইত্যাদি।

***

কিরীটী, সুব্রত মহীতোষবাবু ও তাঁর এক বিশিষ্ট বন্ধু সমর বসু সকলে বিকেলের দিকে মহীতোষের লাইব্রেরী ঘরে বসে চা পান করতে করতে আলাপ-আলোচনা করছিল।

সমরবাবু বলছিলেন, উঃ, এ কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার শহরের বুকে চলেছে বলুন তো সুব্রতবাবু? প্রত্যেক শহরবাসীর মনে যে একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক উপস্থিত হয়েছে তা কি বুঝতে পারছেন না?

বুঝেই বা কি করছি বলুন, মিঃ বসু! চেষ্টার তো ত্রুটি করছি না।

কিন্তু এও কি সম্ভব? মহীতোষ বলতে লাগলেন, মানুষ তো মানুষের মাংস খেতে পারে না! তবে কি সেই জনকথার কোন রাক্ষসেরই আবির্ভাব হল এই শহরে? ভয়ে রাত্রিতে আমার ভাল করে ঘুমই হয় না আজ দুদিন থেকে।

কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, দরজায় খিল দিয়ে শোন তো?

মহীতোষ বললেন, তা আবার বলতে! কথায় বলে সাবধানের মার নেই!

কিন্তু সত্যি আপনার কী মত বলুন তো কিরীটীবাবু? সমরবাবু প্রশ্ন করলেন।

সেও একটা মানুষ, তবে abnormalবলতে পারেন। আমি স্বচক্ষে তাকে দেখেছি। কিরীটী বললে।

সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন, সে কি!

হ্যাঁ! কিন্তু আজকের মত এসব আলোচনা থাক। চল সুব্রত। উঠলাম মিঃ চৌধুরী। নমস্কার।

কিরীটী সুব্রতকে নিয়ে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে মহীতোষ ও সমরবাবু বসে।

হঠাৎ মহীতোষবাবু বললেন, এই কিরীটী রায় নোকটা অসাধারণ বুদ্ধিমান বলে শুনেছি, তবে অহমিকা বড় বেশী।

সমরবাবু কোন জবাব দিলেন না, চুপ করে বসে রইলেন।

***

সেই রাত্রে।

কৃষ্ণা সুব্রতদের ওখানে নিমন্ত্রণ খেতে গেছে। আজ আর ফিরবে না রাত্রে।

কিরীটী একাকী নিজের শয়নঘরে একটা সোফায় হেলান দিয়ে টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় গভীর মনোযোগের সঙ্গে ক্রিমিনোলজির একখানি বই পড়ছে। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো বড় ঘড়িতে ঢং করে রাত্রি একটা ঘোষণা করলে।

কিরীটী সোফা হতে উঠে পাশের টেবিলে বইটা রেখে আড়মোড়া ভাঙল। উঃ, অনেক রাত্রি হয়ে গেছে! আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ভোলা জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।

বাইরে চন্দ্রালোকিত নিঃশব্দ রজনী যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তার মোড়ে কৃষ্ণচূড়ার গাছের পাতায় পাতায় আলোছায়ার লুকোচুরি।

রাত্রির নিঃশব্দ হাওয়া ঝিরঝির করে বইছে।

সহসা পশ্চাতে কার ভারী গলার স্বরে কিরীটী বিদ্যুতের মত চমকে ফিরে দাঁড়াল।

কিরীটী রায়!

কে?

চাঁদের আলোর খানিকটা ঘরের মধ্যে এসে ঈষৎ আলোকিত করে তুলেছে।

অস্পষ্ট আলোছায়ায় ঘরের ওপাশের দেওয়াল ঘেঁষে কালো ওভারকোট গায়ে মাথার একপাশে হেলানো কালো ফেল্টের টুপি।

কে? কে ও দাঁড়িয়ে? কিরীটী রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সামনের দিকে চেয়ে রইল।

চকিতে মনের কোণে ভেসে ওঠে রসা রোডের কিছুদিন আগেকার একটা মধ্যরাত্রির কথা।

বসতে পারি কিরীটীবাবু? আগন্তুক প্রশ্ন করল।

কিরীটী নির্বাক।

কথ বলবার সমগ্র শক্তিই যেন তার কণ্ঠ হতে লুপ্ত হয়েছে। আগন্তুক একটা সোফা টেনে নিয়ে বসল।-সত্যি মিঃ রায়, এই নিশুতি রাত ও বাইরের ঐ চাঁদের আলো-এর মধ্যে যেন একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। বসুন, আপনি যে দাঁড়িয়েই রইলেন! কতদূর থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম!

আমার বাড়িতে আপনি ঢুকলেন কি করে? কিরীটী রুদ্ধ বিস্ময়ে প্রশ্ন করল।

আগন্তুক এবারে হাঃ হাঃ করে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠল, কিরীটীবাবু, আপনি অপরাধতত্ত্বের একজন মস্তবড় পণ্ডিত শুনেছি। এককালে আপনার নেশা ছিল অপরাধীদের অপরাধতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা। ঘরের দরজাটা একটা লোহার তালা এঁটে বন্ধ করলেই কি গৃহপ্রবেশ অসম্ভব হয়ে গেল? একটা তুচ্ছ লোহার তালাই হল বড় আর মানুষের বুদ্ধিটা একেবার মিথ্যা হয়ে যাবে! যাকগে সেকথা। তালা আটা থাকলেও দরজায় গৃহপ্রবেশের উপায় আমার জানা আছে।

কিরীটী নিঃশব্দে একখানি চেয়ারের উপরের উপবেশন করে গা এলিয়ে দিল।

হ্যাঁ, নিজেকে এমনি করে শিথিল না করতে পারলে কি গল্প জমে কখনও,-বিশেষ এমনি নিশুতি রাতে!…নিশুতি রাত। শুধু আবছা রহস্যময় চাঁদের আলো! কেউ কোথাও জেগে নেই, সবাই ঘুমিয়ে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই কেন? কেন-কেন আমি ঘুমোতে পারি। না? চোখ বুজলেই একটা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা যেন আমায় অষ্টবাহু মেলে অক্টোপাশের মত আঁকড়ে ধরে! শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আমি উঠে বসি শয্যার উপরে। শুধু রক্ত-তাজা লাল টকটকে রক্ত যেন অজস্র ঝরনার মত আমার সর্বাঙ্গে আগুন ছড়াতে থাকে। বুকের মধ্যে একটা শয়তান মোচড় দিয়ে ওঠে। একটা লালসা, একটা বন্য বর্বর ক্ষুধা দেহের রক্তবিন্দুতে যেন দানবীয় উল্লাসে নাচতে থাকে। আমি এই হাত দিয়ে গলা টিপে মানুষ খুন করি। এই যে দেখছেন তীক্ষ্ণ ধারালো উপরের দুটো দাঁত, এর সাহায্যে তাজা মানুষের মাংস আমি ছিড়ে খাই। আপনাদের বর্তমান রহস্যের মেঘনাদ, নরখাদক রাক্ষস আমিই। আমাকে ধরুন, আমায় খুন করুন!…আগন্তুক গভীর উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগল।

কিরীটী নির্বাক হয়ে শুধু বসে রইল।

হঠাৎ আগন্তুক সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, পারলেন না, হেরে গেলেন। জানি কেউ আমায় ধরতে পারবে না। আমার এই রাক্ষসের মুখোশটা টেনে খুলে কেউ আমায় চিনতে পারবে না। কিন্তু আমি অপেক্ষা করব; তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করব কিরীটী! খুলে রাখব। আমার ঘরের দুয়ার বন্ধু। তুমি এসে প্রবেশ করবে বলে। তারপর দুটি হাত তোমার সামনে প্রসারিত করে দিয়ে বলব, বন্ধু! এই আমাকে ধর! হার মেনেছি!

ঝড়ের মতই আগন্তুক দরজা ঠেলে ঘরের বাইরে চলে গেল।

অন্ধকার ঘরের মধ্যে একা শুধু বসে রইল তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী কিরীটী রায়।

ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি দুটো ঘোষণা করল।

কিরীটী চোখ দুটো একবার রগড়ে নিল। এতক্ষণ একটা স্বপ্ন দেখছিল না তো!

***

হঠাৎ সেদিন বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীটে এক বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতার দোকানে। প্রায় দীর্ঘ নয় বৎসর বাদে সহপাঠী ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কিরীটীর দেখা হয়ে গেল।

ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী কলিকাতা ইউনিভারসিটির একজন নামকরা ছাত্র। বি. এসি পাস করে সে কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. পাস করে। পরে মনোবিজ্ঞানে এম. এ. পাস করে। বিলাতে তিন বৎসরকাল অধ্যয়ন করে সাইকাব্রিকস্ট হয়ে আসে। যুদ্ধ বাধবার মাত্র মাস ছয়েক আগে সে ফিরে আসে।

অত্যন্ত খেয়ালী প্রকৃতির। এতদিন বসেই ছিল, হঠাৎ আবার কী খেয়াল হওয়ায় কলকাতায় মাস দুই হল এসে একটা ক্লিনিকস্ খুলে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। দুমাসেই বেশ নাম হয়েছে তার শহরে।

বহুকাল বাদে দুই বন্ধুর দেখা। দুজনে গিয়ে এক রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল, চা খেতে খেতে নানা সুখ-দুঃখের গল্প চলতে লাগল।

কলেজ-লাইফে কিরীটী ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। আর অমিয় ছিল শান্তশিষ্ট ভাবুক প্রকৃতির।

কিরীটীকে অমিয় কিরাত বলে ডাকত, আর কিরীটী অমিয়কে কুনো বলে সম্বোধন করত।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অমিয় বললে, তুই তো আজকাল মস্ত বড় একজন গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিস কিরাত। কাগজে কাগজে তোর নাম।

কিরীটী জ্বলন্ত সিগারেটে একটা মৃদু টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গম্ভীর স্বরে বললে, হ্যাঁ, গোয়েন্দা নয়, রহস্যভেদী। কিন্তু তোর খবর কি বল তো? সত্যিই ডাক্তারী করবি নাকি? চিরদিন তো রবি ঠাকুরের কবিতা আর যত রাজ্যের মনোবিজ্ঞানের বই পড়ে কাটালি!

ডাক্তারী করব মানে? রীতিমত শুরু করেছি। বিনি ফিসে একটা মাথা খারাপের গোষ্ঠী পাওয়া গেছে।

মানে?

মানে আর কি! বালিগঞ্জে আমাদের পাশের বাড়িতে তারা থাকে। সমস্ত ফ্যামিলিটাই পাগল, কতা থেকে শুরু করে ছেলেগুলো পর্যন্ত।

বলিস কী? কতা ক্ষ্যাপা, গিন্নী ক্ষ্যাপা, পাগল দুটো চেলা, সেথা সাত পাগলের মেলা!

আর বলছি কী! সামনের রবিবারে আয় না, আলাপ করিয়ে দেব ভদ্রলোক আবার শীঘ্রই পুরীতে হাওয়া বদলাতে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের নাম রায়বাহাদুর গগনেন্দ্রনাথ মল্লিক। জেল ডিপার্টমেন্টে মোটা মাহিনায় চাকরি করতেন। কিছুকাল আলিপুর জেলের ও পোর্টব্লেয়ারে সুপারিন্টেন্টে ছিলেন। গত মহাযুদ্ধে লোহালক্কড়ের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থও জমিয়েছিলেন। অবিবাহিত। বয়স এখন বোধ করি ষাটের কাছাকাছি হবে। সংসারে পোষ্যের মধ্যে চারটে ভাইপো। এই ভাইপোদের শিশুবয়সে মা-বাপ মারা যায় এবং এরা এদের এই বুড়ো কাকার কাছেই মানুষ।

বড় রণধীর বি.এস-সি পাস করে বাড়িতেই বসে আছে। বছর দুই হল বিবাহও করেছে, ছেলেমেয়ে নেই। বয়স প্রায় ত্রিশের মত। মেজ সমীর আই. এ. পর্যন্ত পড়ে আর লেখাপড়া করেনি। বাড়িতে বসে আছে। বয়স প্রায় সাতাশ। সেজ অধীর, বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে, বি. এ. পাস করে বসে আছে। সবার ছোট কিশোর, বছর চৌদ্দ বয়স, বাড়িতেই পড়াশুনা করে।

বুড়ো গগনেন্দ্রনাথ অসুস্থ, হার্টের ব্যারামে ভুগছেন। সর্বদাই বাড়িতে বসে থাকেন। অত্যন্ত খিটখিটে বদমেজাজী, অসাধারণ প্রতিপত্তি এই বুড়োর ভাইপোদের উপর।

ভাইপোরা বাড়ি থেকে এখনও এক পাও কোথাও বের হয় না। সর্বদাই বাড়ির মধ্যে বুড়োর দৃষ্টির ভিতরে আছে।

কারও বাড়িতে জোরে কথা বলবার উপায় নেই, হাসবার উপায় নেই। সবাই গম্ভীর চিন্তাযুক্ত। একটা কঠিন শাসন-শৃঙ্খলা যেন বাড়ির সব কটি প্রাণীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধন দিয়ে পঙ্গু নিশ্চল করে রেখেছে।

ভাইপোরা খাবেদাবে, ঘুরবে, বেড়াবে, দাঁড়াবে, চলবে, ঘুমুবে সব বুড়োর সৃষ্টিছাড়া বাঁধাধরা আইনে। এতটুকু কোন ব্যতিক্রম হবে না এমনি কঠোর শাসন বুডোর।

সবার ছোটটাই রীতিমত hallucination-এ ভুগছে।

বাড়ির মধ্যে কেবল একমাত্র বড় ছেলের বৌ নমিতা দেবী যেন ওদের গণ্ডির বাইরে।

এক বিচিত্র আবহাওয়া! বিচিত্র পরিস্থিতি!

বুড়ো হঠাৎ একদিন রাত্রে অসুস্থ হয়ে পড়ায় পাশেই থাকি বলে বাড়িতে আমার ডাক পড়েছিল। কী জানি কেন বুড়ো আমাকে যেন একটু স্নেহের চোখেই দেখে।

একমাত্র আমাকেই সকলের সঙ্গে মিশতে দেয়।

কিন্তু ছেলেগুলো দীর্ঘকাল ধরে ঐ অদ্ভুত শাসনগণ্ডির মধ্যে থেকে থেকে মানসিক এমন একটা সদা-সশঙ্কিত ভাব হয়েছে যে, কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে বা দুদণ্ড আলাপ করতে পর্যন্ত ভয়ে শিউরে ওঠে।

কী করে যে অতগুলো প্রাণী একটা কুৎসিত গণ্ডির মধ্যে অমন ভাবে দিনের পর দিন আটকে রয়েছে ভাবলেও আশ্চর্য হয়ে যাই।

আশ্চর্য তো! কিরীটী বললে, এ যুগে এও সম্ভব?

Mentally সবকটা লোকই ও-বাড়ির unbalanced, সকলেই একটা মানসিক উত্তেজনার মধ্যে আছে অথচ বিদ্রোহ করবার মত কারও সাহস নেই।

কিরীটী বললে, আমিও বর্তমানে একটা হোমিসাইডাল ম্যানিয়াকের পিছনে ঘুরছি ভাই। দেখি আসছে রবিবার চেষ্টা করব যেতে।

***

কিন্তু কিরীটীর আর রবিবার যেতে হল না।
সহসা শনিবার সকালে বন্ধুর এক চিঠি পেল।

পুরী-স্বর্গধাম
১৩ ডিঃ, ৪৩

প্রিয় কিরাত,

হঠাৎ গগনবাবুর অনুরোধে পুরী চলে এলাম। সকলে স্বর্গধাম হোটেলে এসে উঠেছি। বেশ লাগছে। কলকাতার ধুলো বালি রোগের বাইরে প্রকৃতির এই গম্ভীর পরিস্থিতিতে মনের সব কটি দুয়ারই যেন খুলে গেছে। সকালে বিকালে শুধু সমুদ্রে বিরাট রূপ নয়নভরে দেখি। কখনও ভয়ঙ্কর, কখনও স্নিগ্ধ, কখনও শান্ত….সে এক অপূর্ব। আয় কটা দিন থেকে যাবি, আমি একটা আলাদা ঘর নিয়েছি, সেখানেই থাকতে পারবি। আসবি তো রে! ভালবাসা রইল।

তোর কুনো

 ২. ঘনীভূত

নীল! নীল! নীল।

পুরীর সাগর।

কী একটা বিরাট অপূর্ব সীমাহীন অনন্ত বিস্ময়।

বিশ্বপ্রকৃতি যেন বিরাট এক নীলাম্বরী গায়ে জড়িয়ে অসীমের মাঝে ড়ুব দিয়েছে।

অকুল পারাপারহীন নীলাঞ্জনে দৃষ্টি মিগ্ধ হয়ে আসে।

অসীম নীলাকাশ যেন স্নেহে আকুল অসীম বারিধির শান্ত শীতল বক্ষে নিঃস্ব করে আপনাকে আপনি উজাড় করে ফেলে দিয়েছেন। শুধু হেরি এক বিপুল মহান নীলিমা! যেদিকে চক্ষু ফিরাই! এ কি অপূর্ব! মহাবিস্ময়ে সমগ্র ইন্দ্রিয়কে মুগ্ধ করেছে!

কিরীটী মুগ্ধ হয়ে গেল।

একদিন মাত্র এখানে এসেছে সে, কিন্তু একটি দিনেই যেন তার সমগ্র মনখানি মুক্ত অবাধ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। কাজকর্ম চিন্ত সব কোথায় চলে গেছে।

গতকাল রাত্রি প্রায় বারোটা পর্যন্ত এই সমুদ্রের ধারে বালুবেলার উপরে সে বসে বসে কাটিয়েছে।

অনেক রাত্রে যখন শুতে যায়, দু-চোখের নিদ্রালু ভারী পাতার সঙ্গে যেন অদ্ভুত এক স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে।

স্বৰ্গৰ্বার হোটেল থেকে সাগরের বেলাভূমি মাত্র একরশি পথ দুরে। একতলার খোলা বারান্দায় দাঁড়ালে সাগরের বিপুল রূপ দু-চোখের দৃষ্টি জুড়ে ভাসতে থাকে।

সারাটা রাত এক অদ্ভুত চাপা গুম গুম গর্জন। যেন সাত-সাগরের অতলতলে কোন এক লৌহকারার অন্তরালে অনাদিকালের বন্দী দৈত্য মুক্তির লাগি লৌহকপাটের গায়ে মাতা খুঁড়ে খুঁড়ে গর্জন করছে।

বিরামহীন ছেদহীন সে গর্জনধ্বনি।

বিশেষ করে রাত্রির অন্ধকারে বিশ্বচরাচর যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, সমুদ্রের কান্না যেন কী এক করুণ বেদনায় সাগরবেলায় কেঁদে কেঁদে ফেরে।

ছোট মাঝারি বড় কালো কালো ঢেউগুলো শুভ্র ফেনার মুকুতা-কিরীট মাথায় পরে সাগরবেলার করুণ বেদনায় কেবলই আছড়ে আছড়ে পড়ে।

মাটির কাছে বারিধির সেই চিরন্তন মিনতি, ওগো বন্ধু, ওগো আমার শান্ত মাটি, আমায় গ্রহণ কর! আমায় ধন্য কর! আমায় পূর্ণ কর।

একজন পাগল সদাচঞ্চল খেয়াল খুশিতে উদ্দাম বাঁধনহারা, অন্যজন শান্ত-ধীর।

***

স্বর্গদ্বার হোটেল।

হোটেলটি একজন উড়িষ্যাবাসী বাঙালী ভদ্রলোকের। সাগরের প্রায় কোল থেকেই উঠেছে স্বর্গদ্বার হোটেলটি।

আরাম ও পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে সত্যই প্রশংসনীয়। ঘরগুলি খোলামেলা, পরিপাটী সাজানো-গোছানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুপ্রশস্ত।

হোটেলটি সর্বসমেত দোতলা।

উপরে ও নীচে অনেকগুলি ঘর।

সর্বদাই হোটেলটি নানাজাতীয় লোকের ভিড়ে ভর্তি থাকে। একতলা ও দোতলায় খোলা বারান্দা। সেখানে সোফা, আরাম-কেদারা প্রভৃতিতে বসবার বন্দোবস্ত আছে।

উপরে ও নীচে দুটি খাবার ঘর।

গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ভাইপোদের নিয়ে নীচেরই কয়েকখানি ঘরে বসবাস করছেন।

কিরীটী ডাঃ অমিয়র সঙ্গে একই ঘরে থাকবার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে।

গগনেন্দ্রনাথ সর্বসমেত পাঁচখানি ঘর নীচের তলায় ভাড়া নিয়েছিলেন। একখানিতে তিনি থাকেন। তাঁর ডান দিককার ঘরে রণধীর সস্ত্রীক, বাঁয়ের ঘরে কিশোর, তার পাশের ঘরে সমীর এবং তার পাশের ঘরে অধীর।

কোন ঘরের সঙ্গে কোন ঘরের যোগাযোগ নেই, প্রত্যেক ঘরের সঙ্গে আলাদা আলাদা সংলগ্ন ছোট্ট একটি বাথরুম আছে। তাছাড়াও একটি সকলের ব্যবহারের জন্য বড় স্নানঘর আছে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াত করতে হলে বারান্দা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়।

রেলিং দেওয়া প্রশস্ত বারান্দার সামনেই প্রশস্ত একটি বাঁধানো চত্বর, চত্বরের সীমানায় লোহার রেলিং, তারপরেই সদর রাস্তা, রাস্তার নীচে সাগরের বেলাভূমি।

গগনেন্দ্রনাথের ফ্যামিলি ছাড়াও নীচের তলায় আরো তিনজন বাস করেন।

কিরীটীদের পাশের ঘরেই থাকেন বারীন রায় নামে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয়। দীর্ঘ ছয় ফুট, বলিষ্ঠ গঠন। এত বয়স হয়েছে তবু শরীরের গাঁথুনি দেখলে বিস্মিত হতে হয়। মাথায় সাদা চুল ব্যাক-ব্রাশ করা। দীর্ঘলম্বিত ধবধবে সাদা দাড়ি।

চোখে সোনার ফ্রেমে কালো কাঁচের চশমা। চোখের গোলমাল আছে বলে তিনি রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করেন। অতি সৌম্য প্রশান্ত চেহারা, হাসিখুসী আমুদে লোক। অত্যন্ত রসিক।

ভদ্রলোক অবিবাহিত, বাংলার বাইরে পাণ্ডববর্জিত মুলুকে কোথায় কোন্ বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনা করে এতকাল কাটিয়েছেন। কার্য থেকে বিশ্রাম নিয়ে এখন দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

বেশ সচ্ছল অবস্থা।

তাছাড়া বারীনবাবুর পাশের ঘরে যতীন ঘোষ বলে এক ভদ্রলোক থাকেন।

ভদ্রলোক চিররুগ্ন। অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে, স্বাস্থ্যকর জায়গায় কেবল ঘুরে ঘুরে বেড়ান।

তাঁর পাশের ঘরে থাকেন তরুণী কুমারী ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী।

মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. পাস করে বিলেত থেকেও ধাত্রীবিদ্যার ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন।

লাহোর মেডিকেল কলেজে ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপনা করেন।

বড়দিনের ছুটিতে পুরীতে বেড়াতে এসেছেন।

বয়স প্রায় সাতাশ-আটাশ বৎসর হবে। রোগা ছিপছিপে গড়ন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল পরিষ্কার।

টানা টানা দুটি স্বপ্নময় চোখ।

সুশ্রী মুখখানি জুড়ে একটা কমনীয়তা যেন ঢল ঢল করে।

ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ।

আমাদের নীচের তলার বাসিন্দাদের নিয়েই ঘটনা, তাই উপরের বাসিন্দাদের এখানে বৃথা বর্ণনা করে কারো বিরক্তিভাজন হতে চাই না। গগনেন্দ্রনাথের ভাইপোদেরও এখানে একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার।

রণধীর মল্লিকের বয়স ত্রিশের মধ্যে আগেই বলেছি। বেশ মোটাসোটা নাদুসনুদুস চেহারা। গায়ের বর্ণ গৌর, নাক চোখ মুখে কোন বুদ্ধির প্রাধ্য নেই বটে, তবে শিশুর মত একটা সহজ সরলতা বিরাজ করে।

অত্যন্ত শান্ত, গোবেচারী নিরীহ, আরামপ্রিয়। মিতভাষী চোখের দৃষ্টিতে একটা সদা-সশঙ্কিত ভাব। একান্ত নির্জনতাপ্রিয়। বেশীর ভাগ সময়ই বই পড়ে কাটায়।

মেজো সমীরের বয়স প্রায় সাতাশের কাছাকাছি হবে।

ভাইদের মধ্যে সমীরেরই গাত্রবর্ণ সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল। ভাইদের মধ্যে সব চাইতে বেশী লম্বা, রোগাটে গড়ন, ধীর শান্ত নমনীয়।

চোখ দুটি টানা-টানা, গভীর আঁখিপল্লবের নীচে সমুদ্রে নীল জলের মত গভীর নীলাভ শান্ত উদাস দৃষ্টি। চোখের কোল দুটি সর্বদাই ছলছল করে। মাথার কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। বিস্ত, এলোমেলো। উন্নত খড়গের মত বাঁকা নাসিকা যেন উদ্ধত বিস্ময়ে মুখের উপরে ভেসে আছে।

পাতলা লাল দুটি ঠোঁট, মুক্তা-পংক্তির মত শুভ্র একসারি দাঁত।

মুখখানি সদাই বিষণ্ণ, চিন্তাযুক্ত। যেন একখানি জলভরা মেঘ। বেশীর ভাগ সময়ই চুপচাপ একা একা বসে কী যেন ভাবে।

সেজো বা তৃতীয় অধীর বেশ বলিষ্ঠ গঠন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল-শ্যাম। চোখমুখে একটা উদ্ধত দৃষ্টি। কথা একটু যেন বেশীই বলে, কিন্তু ব্যবহারে একটা যুদ্ধ-ক্লান্ত সশঙ্কিত ভাব। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যে।

সর্বকনিষ্ঠ কিশোর। রুগ্ন পাংশু চেহারা।

মনে হয় চিরদিন শুধু রোগেই কেবল ভুগছে।

চোখেমুখে একটা ভীত সশঙ্কিত ভাব। দেখলে করুণা হয়।

এ বাড়ির বৌ বিনতা।

এক কথায় যেন একখানি লক্ষ্মীর সচল প্রতিমা।

চোখেমুখে একটা উদ্ধত বুদ্ধির প্রখ্য।

বুড়ো গগনেন্দ্রনাথের সর্ববিধ সেবার কাজ হাসিমুখে সে-ই করে। দিবারাত্র ছায়ার মতই বুড়োর আশেপাশে ঘোরে।

সমীর সব সময়ই বৌদিকে সাহায্য করে।

প্রকাণ্ড এক রূদ্ধকারার মধ্যে বিনতা যেন আলোর একটুখানি আভাস। গভীর বেদনার মাঝে একফোঁটা আঁখিজল।

এ বাড়ির সকলের মধ্যে যে শঙ্কার একটা কালো ভয়াবহ ছায়া থমথম করছে তার মাঝে যেন একটা আশার বিদ্যুৎ-শিখা এই বিনতা।

বিনতা বড় গরীবের মেয়ে। মামার দয়ায় মামার বাড়িতেই চিরকাল অবহেলা অনাদরে মানুষ।

জন্মাবধি তার ব্যথার সঙ্গেই পরিচয়। আশ্রয় তার চিরসাথী, হাসি তার কেউ নয়।

কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে তীক্ষ্ণ মেধাবী।

নিজের অক্লান্ত চেষ্টায় স্কলারশিপ নিয়ে বি. এ. পাস করে লাহোরে এক স্কুলে চাকরি নিয়ে যায়। মাঝখানে কিছুদিন নার্সিংও পড়েছিল। গগনেন্দ্রনাথ তখন লাহোর সেন্ট্রাল জেলে সুপারিনটেনডেন্ট। বিনতা থাকত গগনেন্দ্রনাথেরই পাশের একতলা ছোট্ট বাড়িটায়। কেমন করে যে রণধীরের সঙ্গে বিনতার আলাপ হল, কাকার দুর্জয় শাসনের গণ্ডি ডিঙিয়ে কেমন করে যে সেই আলাপ গভীর হতে গভীরতর হল এবং শেষটায় বিনতা স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রণধীরের পিছু পিছু বধূবেশে গগনেন্দ্রনাথের পাষাণ-প্রাচীরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল সে আজও এক বিস্ময়।

বাইরে থেকে এ বাড়ির যে ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিক আবহাওয়া, যেটা কোনদিনই বিনতার চোখে ধরা পড়েনি, আজ সেইটাই বিনতার সর্বাঙ্গে যেন সুকঠিন লৌহ-শৃঙ্খলের মতই তাকে জড়িয়ে ধরল এ বাড়ির মধ্যে পা দেওয়ার কিছুকালের মধ্যেই।

শীঘ্রই চিরস্বাধীন বাধাহীন মন তাঁর হাঁপিয়ে উঠল।

ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিক এ বাড়ির আবহাওয়া। যেন একটা দুর্জয় গোলকধাঁধা। এখানে সব কিছু একজনের বাঁধাধরা সুকঠিন নিয়মের মধ্যে চলে।

যেন একটা প্রকাণ্ড অজগর সাপের বিষাক্ত দৃষ্টির তলায় সকলে সম্মোহিত পঙ্গু হয়ে আছে।

এখানে জীবনের স্পন্দন নেই, আছে মৃত্যুর গভীর নীরবতা। এখানকার বাতাসে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। হাঁফ ধরে।

পুরীতে এসে অবধি গগনেন্দ্রনাথ বেশীর ভাগ সময়ই তাঁর ঘরের সামনে বারান্দায় একটা আরামকেদারার উম্বরে দামী সাদা শাল গায়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকেন, তাঁর আশেপাশে বাড়ির আর সকলে বসে থাকে।

মাঝে মাঝে গগনেন্দ্রনাথ সমুদ্রের তীরে বেড়াতে যান; সঙ্গে সবাই যায়। আবার সন্ধ্যার পরে একত্রে সবাই হোটেলে ফিরে আসে।

দিনমণি একটু আগে সাগরজলে আবির গুলে অস্ত গেছেন। সাগর-কিনারে বালুর ওপরে সাগরজলের দিকে নিমেষহারা দৃষ্টি মেলে একাকী নীরবে বসে আছে প্রতিমা।

কোলের উপরে পড়ে আছে রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতাখানা।

মাথায় আজ সে সাবান দিয়েছিল, রুক্ষ বিস্ত চুলগুলি হাওয়ায় উড়ছে। পরিধানে তার আজ গেরুয়া রঙের একখানা খদ্দরের শাড়ি, গায়ে ডিপ আকাশ-নীল রঙের হাতকাটা ব্লাউজ।

প্রতিমা দেখছিল, সন্ধ্যার ধূসর ম্লান ছায়া একটু একটু করে সারা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে।

সমুদ্রের নীল জল কালো হয়ে উঠছে।

আজ যেন সমুদ্র বড় বেশী উতলা।

আবছা আলোয় কালো কালো ঢেউগুলি শুভ্র ফেনার মালা গলায় দুলিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ছুটে আসছে।

প্রতিমা গান গাইছিলঃ

ওগো কোন্ সুদূরের পার হতে আসে,
কোন্ হাসি কান্নার ধন।
ভেবে মরে মোর মন,
ভেসে যেতে চায়
এই কিনারার সব চাওয়া সব পাওয়া।

বাঃ, চমৎকার গান তো আপনি! কী মিষ্টি আপনার গানটি।

চমকে প্রতিমা ফিরে তাকাল।

সন্ধ্যার ঘনায়মান আঁধারে তার ঠিক পশ্চাতে বালুবেলার উপরে যেন দীর্ঘ এক অস্পষ্ট ছায়ার মতই দাঁড়িয়ে আছে সমীর। যেন খাপ-খোলা একখানা বাঁকা তলোয়ার।

কে, সমীরবাবু?

সমীর প্রতিমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল, বললে, হাঁ। কিন্তু আমার নাম আপনি জানলেন কি করে? আপনার নাম তো আমি জানি না!

প্রতিমা মৃদু হাসলে, তারপর স্মিতভাবে, বললে, আপনি আমার নাম জানেন না সমীরবাবু, কিন্তু আমি আপনার নাম জানি। আমার নাম প্রতিমা গাঙ্গুলী, পেশা ডাক্তারী। বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন যে?

বসব? কণ্ঠে যেন একরাশ মিনতির বেদনা ঝরে পড়ল।

কী অসহায়, করুণ!

হ্যাঁ, বসুন না। আপনাকে এই হোটেলে প্রথম দিন থেকে দেখা অবধিই আপনার সঙ্গে আমার আলাপ করবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আপনারা কারো সঙ্গে কথাও বলেন না, মেশেনও না। খাবার ঘরে যান, চুপচাপ খেয়ে চলে আসেন।

সমীর ততক্ষণে প্রতিমার অল্প একটু দূরে সাগরবেলার উপরে বসে পড়েছে। প্রতিমা বলছিল, কেন আপনারা কারো সঙ্গে মেশেন না, কথা বলেন না সমীরবাবু?

সমীর চুপ করে বসে রইল।

সমীরবাবু, এই চমৎকার জায়গায় এসেও আপনারা ঘরের মধ্যেই বসে থাকেন। কেমন করে থাকেন? ভাল লাগে? বাইরে আসতে কি ইচ্ছে হয় না? আমি তো এখানে আসা অবধি এক মুহূর্তও ঘরে থাকতে পারি না। সমস্ত মন যেন কেবলই বাইরে ছুটে আসে।

হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে করে প্রতিমা দেবী, কিন্তু কই পারি না তো! কেন পারি না? কেন বাইরে আসতে পারি না আমি বুঝতে পারি না, একটা প্রবল নিষেধ যেন ঘরের মধ্যে আমায় পিছু টেনে রাখে, আমার সমস্ত গতিকে নষ্ট করে দেয়।

চলে আসবেন বাইরে, যখন মন চাইবে।

মন তো বাইরে ছুটে আসতে সব সময়ই চায় প্রতিমা দেবী। বলতে পারেন, কেমন করে ঘর ছেড়ে বাইরে আসতে হয়? সমীর বলল।

কী সরল প্রশ্ন!

প্রতিমা ডাঃ চক্রবর্তীর মুখে এদের সব কথাই শুনেছিল।

শুনে সে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এও কি সম্ভব নাকি?

সে বলেছিল ডাঃ চক্রবর্তীকে, কেন এরা সব ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয় না? কেন এরা বিদ্রোহী হয়ে বাইরে ছুটে আসে না?

ডাঃ চক্রবর্তী জবাব দিয়েছিলেন, একদিন হয়তবা এরা বিদ্রোহী হতে পারত, কিন্তু আজ আর তারা পারবে না। মনের সে শক্তি আজ ওরা নিঃশেষে হারিয়েছে। আজ শুধু নিরুপায় বেদনায় ছটফট করবে, কিন্তু প্রতিকার তার করতে পারবে না। একদিন নয়, দুদিন নয়, দীর্ঘদিনের এই সম্মোহন—আজ আর এর থেকে তো ওদের নিস্তার নেই ডাঃ গাঙ্গুলী!

কেন নেই ডাঃ চক্রবর্তী? প্রতিমা প্রশ্ন করেছিল।

আমার ওদের সঙ্গে বেশ কিছুদিনের পরিচয়, অমিয় বলতে লাগল, কৌতূহলবশেই একটু একটু করে গগনেন্দ্রনাথের পূর্ব ইতিহাস আমি সংগ্রহ করেছি। প্রথম জীবনে গগনেন্দ্রনাথ লোকটা জেলের কয়েদীদের রক্ষী ছিলেন। দিনের পর দিন একদল অস্বাভাবিক অপরাধীদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ওঁর মনের সহজ প্রবৃত্তিগুলো একটু একটু করে বিকৃত হয়ে গেছে। হয়ত গগনেন্দ্রনাথ মনে মনে নিষ্ঠুরতা ভালবাসতেন না। কিন্তু যেহেতু তাকে জেলের কয়েদীদের রক্ষী হতে হয়েছিল, কর্তব্যের খাতিরেই হোক বা আইনের খাতিরেই হোক নিত্যনিয়মিত একদল অস্বাভাবিক লোকের সঙ্গে মিশে মিশে, ভেড়ার মত সর্বদা তাদের আইনের নাগপাশে বেঁধে রেখে চালনা করতে করতে হয়ত বা মনে মনে নিজের অজ্ঞাতেই একদিন অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিলেন। এক কথায় অন্যের উপরে ক্ষমতা প্রয়োগ করবার হয়ত একটা দুর্মদ উম্মাদ কামনা চিরদিনই ওঁর অবচেতন মনের মধ্যে সুপ্ত বস্তুর মত ঘুমিয়ে ছিল। একদিন হয়ত সেই অবচেতন মনের অলঙ্ঘ্য ইঙ্গিতেই জেলের কয়েদীদের রক্ষার কাজ বেছে নিয়েছিলেন প্রয়োজন হিসাবে, মনের অবচেতন লালসার তৃপ্তিসাধন করতে।

মনোবিজ্ঞানে বলে, আমাদের অবচেতন মনে অনেক সময় অনেক অদ্ভুত বাসনাই গোপন থাকে। ক্ষমতা প্রয়োগের একটা দুর্বার বাসনা, একটা পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা, ধ্বংস করবার একটা বন্য বর্বর আদিম ইচ্ছা-ঐসব প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম মানব-প্রবৃত্তি-আজওঁ ওগুলো আমাদের সভ্যতার চাকচিক্যের অন্তরালে আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। আদিম বর্বর যুগের সেই বন্য নিষ্ঠুরতা, উন্মাদ প্রলোভন, পাশবিকতা—আজ আমরা সভ্যতার আবরণে সেটা ঢেকে রাখতে অনেক কায়দা-কানুন শিখেছি বটে, স্বীকার করি, কিন্তু তবু সেই আদিম বর্বর অবচেতন প্রবৃত্তিগুলি যখন আমাদের মনে প্রবল হয়ে ওঠে, তখন আমাদের একান্ত অজান্তেই আমরা নিরুপায় হয়ে ধরা দিতে বাধ্য হই সেই সব প্রকৃতির হাতে। কোথায় ভেসে যায় আমাদের সভ্যতা, এত কষ্টে অর্জিত শিক্ষার গিল্টির আবরণ। মনের সেই চিরন্তন আদিম বর্বরতা ক্ষুধার্ত লালসায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।

দুঃখের বিষয় আজ আমরা আমাদের জীবনের সব কিছুতেই যেন সেই আদিম বন্য বর্বর প্রবৃত্তির প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। জাতীয় জীবনে, রাজনীতিতে, সমাজে, রাষ্ট্রে, সভ্যতায়। দয়া হতে, ভ্রাতৃত্ব হতে আজকের এই মনুষ্যত্বের এটা একটা রিঅ্যাকশন। আজকের এইসব চলিত নীতিগুলো দেখে অনেক সময় মনে হয় বুঝি খুব সঠিক চিন্তাপূর্ণ ও মঙ্গলজনক একটা গভর্মেন্ট গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে সে গভর্মেন্ট একদিন জোর করে চালু করা হয়েছিল, ভয় ও নিষ্ঠুরতার উপরে তার ভিত্তি উঠেছিল গড়ে। সেদিনকার সেই ভয় ও নিষ্ঠুরতার ভিত্তিতে গড়া গভর্মেন্টই আজ আমাদের মনের চিরন্তন আদিম ও ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতাকে মনের সভ্যতার গিল্টি-করা দরজাটা খুলে বাইরে বের করে দিয়েছে। তাই তো আজ জগতে জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে এত হানাহানি, এত রক্তারক্তি, এত যুদ্ধবিগ্রহ।

ইঙ্গ-আমেরিকা আজ চিৎকার করছে বটে, জার্মানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যই তাদের জগতে এক শান্তিময় জীবনধারা নিয়ে আসা। জার্মানীই যেন এইসব যত দুঃখ ও অমঙ্গলের মূল। কিন্তু মনে মনে ব্রিটিশ, জার্মানী, জাপান সবাই একই দলের পথিক। শুধু বিভিন্ন কর্মধারা মাত্র। ভাল করে ভেবে দেখুন দিকি, প্রকৃতপক্ষে পশুর চাইতে বেশী কি? খুব delicately balanced- একমাত্র উদ্দেশ্য বেঁচে থাকা। খুব দ্রুত এগিয়ে চলাও যেমন জাতি ও দেশের পক্ষে ক্ষতিকর, পেছিয়ে থাকাও তাই। কেবল বেঁচে থাকতে হবে, দ্রুতও নয়, অতি শ্লথও নয়, মাঝামাঝি। দেশ বা জাতি সেও তো সমষ্টিগত মানবই।কথায় কথায় অনেক দূরে চলে এসেছি।

ডাঃ চক্রবর্তী একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, আমার মনে হয়, গগনেন্দ্রনাথ বহুকাল ধরে বহু লোকের উপরে প্রভুত্ব করে করে, মানুষের উপরে অত্যাচার নিষ্ঠুরতা করে, বেদনা দিয়ে দিয়ে, আজ ওঁর মনের সহজ প্রবৃত্তিই গড়ে উঠেছে ঐ বেদনা দেওয়া ও অত্যাচার করার মধ্যে। সেই প্রাগৈতিহাসিক পাশবিক বর্বর আনন্দ, শুধু আগের মতো শারীরিক বেদনা দেওয়ার পরিবর্তে দিচ্ছে মানসিক বেদনা। এ ধরনের মনোবিকার খুব বড় একটা বেশী দেখা যায় না। আর এদের সঙ্গে যুদ্ধ করাও বড় কঠিন। সে চায় অন্যের উপরে তার প্রভুত্ব থাকবে। এবং সেই প্রভুত্বের দোহাই দিয়ে অন্যের উপরে করবে সে অত্যাচার। এতেই তার আনন্দ।

প্রতিমা বলেছিল, এটা কি পাশবিক নয়, এইভাবে অত্যাচারের মধ্য দিয়ে আনন্দ ভোগ করা?

নিশ্চয়ই। ডাঃ চক্রবর্তী বলেছিলেন, কিন্তু সবচাইতে মজা হচ্ছে, অত্যাচারী এখানে বুঝতেই পারছে না কী সে করছে, এখানে সে তার অবচেতন মনের দ্বারা চালিত হচ্ছে।

প্রতিমা এরপর জিজ্ঞাসা করেছিল, কিন্তু কাকার এই অত্যাচার থেকে ভাইপোরা নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে না কেন আঃ চক্রবর্তী?

ডাঃ চক্রবর্তী জবাব দিয়েছিলেন, ওইখানেই তো আপনার ভুল ডাঃ গাঙ্গুলী। তারা তা পারে না। একটা মুরগীকে একটা ঘরের মধ্যে সাদা চক দিয়ে মেঝের উপরে একটা লাইন টেনে, মুরগীর ঠোঁটটা সেই সাদা লাইনের উপরে রেখে দিলে যেমন তার মনে হবে সেই লাইনের সঙ্গেই সে বাঁধা পড়েছে, আর সে নড়তে পারবে না, গগনেন্দ্রনাথের ভাইপোদেরও মনের অবস্থা ঠিক তাই, তাদের সম্মোহিত করেছে যে সে ছাড়া আর তাদের উপায় নেই, মুক্তি নেই।

আচ্ছা এই যে একটা পরিস্থিতি, এ তো অতগুলো লোকের পক্ষে ভয়ঙ্কর অমঙ্গলজনক। প্রতিমা বললে।

নিশ্চয়ই, সেকথা একবার বলতে, হাজারবার!

প্রতিমা রুদ্ধস্বরে বলেছিল, তবে তো এই শয়তান বুড়োকে খুন করাই উচিত। ওই শয়তানকে খুন করতে পারলে এখনও হয়ত ওদের বাঁচবার আশা আছে। এখনও হয়ত ওদের মনের সব কিছু মরে শুকিয়ে যায়নি। এখনও হয়ত ওদের মনের মাঝে আলো আসে, ফুল ফোটে।

কী বলছেন আপনি প্রতিমা দেবী? বিস্মিত কণ্ঠে ডাঃ চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন। ঠিকই বলছি, দশজনের মঙ্গলের কাছে একজনের মৃত্যু সে তো বড় বেশী কথা নয়, এর মধ্যে অন্যায় কী-ইবা আছে? একবার ঐ বেচারীদের কথা ভেবে দেখুন তো ডাঃ চক্রবর্তী। দিনের পর দিন দীর্ঘকাল ধরে কী যাতনাটাই না তারা সহ্য করছে!

প্রতিমা নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে গিয়েছিল, সমীরের কথা তার যেন এতক্ষণ মনেই ছিল না। সহসা সমীরের ভয়চকিত কণ্ঠস্বরে ও চমকে উঠল, আমি যাই, অনেক রাত হল।

কাকা হয়ত খুজবেন।

বসুনা না আর একটু! প্রতিমা বললে।

না না, আমি যাই। একটা ভয়ঙ্কর অস্বস্তিতে যেন সমীরের কণ্ঠস্বর ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে, সহসা সে মাতালের মত অস্থির পদে টলতে টলতে চলে গেল।

সেই অন্ধকারে বালুবেলার মধ্যে বসে সমীরের ক্রমঅপস্রিয়মাণ গতিপথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সহসা কেন জানি না প্রতিমার চোখের কোল দুটি জলে ভরে এল।

সাগরে বুঝি জল উঠেছে, সহসা একটা ঢেউ এসে প্রতিমার পায়ের অনেকখানি ও লুণ্ঠিত শাড়ির আঁচলটা ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

অল্প দূরেই কিরীটীর হাওয়াইন গিটারের মধুর সুর সমুদ্রে সাগরবেলায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রতিমা আকাশের দিকে অশ্রুসজল দৃষ্টি তুলে তাকাল। কালো আকাশের বুকে হীরার কুচির মত নক্ষত্রগুলি জ্বলছে আর জ্বলছে।

নীচে সাগর তেমনিই ঢেউয়ে ঢেউয়ে মাতামাতি করে চলেছে। উদ্দামতারও বিরাম নেই, গর্জনেরও বিরাম নেই।

***

স্বর্গদ্বার হোটেলের নীচের তলায় বসবার ঘরে তখন অনেকেই জমায়েত হয়েছে। রাত্রি পৌনে আটটা।

ঘরের এক কোণে গগনেন্দ্রনাথ একটা আরাম-কুরসীর উপরে গায়ে একটি দামী শাল জড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন। পাশেই আর একটা চেয়ারে বসে বিনতা উল বুনছে, তার অল্পদূরে বসে বই পড়ছে রণধীর, তার পাশে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে কিশোর চোখ বুজে পড়ে আছে। অধীর গগনেন্দ্রনাথ বাঁপাশে বসে একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন আনমনে। ঘরের অন্যদিকে যতীনবাবু ও বারীনবাবু মুখোমুখি বসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন। অল্পদুরে একখানা সোফার উপরে বসে ডাঃ চক্রবর্তী কী একটা মোটা ডাক্তারী বই পড়ছেন।

সমীর এখনও এল না? গগনেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন যেন কতকটা আপন মনেই। দিনদিনই সে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছে। কপালে ওর অনেক দুখ আছে।

এমন সময় ক্লান্তপদে সমীর এসে ঘরে প্রবেশ করল।

গগনেন্দ্রনাথ একবার আড়চোখে সমীরের দিকে তাকিয়ে ধীর গভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে সমীর?

সমীর নীরবে মাথা নীচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইল।

কী, জবাব দিচ্ছ না কেন? একসঙ্গে সব বেড়িয়ে ফিরছিলাম, কোথায় তুমি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলে?

সমুদ্রের ধারে বেড়াচ্ছিলাম কাকা। মৃদুস্বরে সমীর জবাব দিল।

বেড়াচ্ছিলে? অত্যন্ত অসংযমী ও উজ্জ্বল হয়ে উঠছ তুমি দিন দিন সমীর। কিছুদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করছি, গতিটা তোমার ক্রমে অবাধ হয়ে উঠছে। ধ্বংসের মুখে তুমি ছুটে যাচ্ছ সমীর।

আমি–, সমীর যেন কী বলতে যাচ্ছিল প্রত্যুত্তরে।

গগনেন্দ্রনাথ প্রবল বিরক্তির সুরে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, যাক, তর্ক করো না। দোষী হয়ে দোষ ঢাকবার মত পাপ বা অন্যায় আর নেই। কার হুকুমে তুমি এতক্ষণ বাইরে ছিলে?

এমন সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী এসে ঘরে প্রবেশ করল, ঘরে ঢুকবার পথেই গগনেন্দ্রনাথের শেষের কথাগুলি তার কানে গিয়েছিল, সে সমীরের দিকে স্তব্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে চেয়ে রইল।

গগনেন্দ্রনাথ তীক্ষ্ণকণ্ঠে আবার প্রশ্ন করলেন, কী, চুপ করে আছ কেন, জবাব দাও? এত স্বাধীনতা তোমার কোথা থেকে এল? এত দুঃসাহস তোমার কেমন করে হয়?

প্রতিমা আর সহ্য করতে পারল না। তার মনের মধ্যে যেন আগুন জ্বলছিল, সে এবারে এগিয়ে এল, গগনবাবু, উনি আমার সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন, আমিই ওকে আটকে রেখেছিলাম; দোষ এতে যদি কিছু হয়ে থাকে তবে আমার, ওঁর নয়।

গগনেন্দ্রনাথ তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিলেন, আপনি কে আমি জানি না। কিন্তু আপনি যেই হোন, আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে একজন তৃতীয় পক্ষের মাথা ঘামানোটা আমি আদপেই পছন্দ করি না। দয়া করে আর আপনি আমার ভাইপোদের সঙ্গে মিশে কুপরামর্শ দিয়ে উচ্ছন্ন দেবেন না।

এসব আপনি কী যা খুশি তাই বলছেন গগনবাবু! তীব্র প্রতিবাদের সুরে প্রতিমা জবাব দিল।

অসহ্য ক্রোধে ও অপরিসীম লজ্জায় তার সমগ্র মুখখানা তখন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।

প্রতিমার কথার কোন জবাব না দিয়ে গম্ভীর স্বরে সমীরের দিকে তাকিয়ে গগনেন্দ্রনাথ বললেন, শোন সমীর, এভাবে উচ্ছন্নে যেতে তোমায় আমি দেব না। এ ধরনের অন্যায় যদি আবার কোনদিন তোমার দেখি তবে এমন ব্যবস্থা আমি করব যে, সারা জীবনের চোখের জলেও তোমার মুক্তি মিলবে না। এ অসহ্য! একেবারে অসহ্য এই অমার্জনীয় ঔদ্ধত্য। তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে লক্ষ্য করে আদেশের সুরে বললেন, চল সব ঘরে!

একটা তীব্র কুটিল দৃষ্টি প্রতিমার দিকে হেনে গগনেন্দ্রনাথ ধীরপদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন, তার পিছু পিছু অন্য সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত মাথা নীচু করে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল।

প্রতিমাও একপ্রকার ছুটে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

ঘরের অন্য সব প্রাণী স্তম্ভিত বিস্ময়ে স্থাণুর মতই যে যার জায়গায় নীরবে বসে রইল।

***

সেই রাত্রে।

রাত্রি বোধ করি দেড়টা হবে। কিরীটীর চোখে ঘুম নেই।

অমিয় তার শয্যার উপরে শুয়ে অঘোরে নাক ডাকাচ্ছে।

কিরীটী একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের পিছনদিকের জানালার সামনে এসে দাঁড়াল।

বাইরে অন্ধকার প্রকৃতি কালো আকাশের ছায়ায় যেন চোখ বুজে পড়ে আছে।

সমুদ্রের একটানা গুম গুম গর্জন রাত্রির স্তব্ধ অন্ধকারের দু-কূল ছাপিয়ে যেন কানের কাছে এসে আছড়ে পড়ছে।

সহসা তার কানে এল কারা যেন পাশের ঘরেই চাপা উত্তেজিত স্বরে কী আলোচনা করছে।

না না, এ অসম্ভব। এই পরাধীনতার নাগপাশ, দিনের পর দিন এই অকথ্য অত্যাচার সত্যি আর সহ্য হয় না। প্রাণ আমার হাঁপিয়ে উঠেছে। এভাবে আর বেশীদিন থাকলে বুঝি পাগল হয়ে যাব আমি! অধীর–

মেজদা, এমনি করে অধীর হয়ো না ভাই। আর কটা দিনই বা বুড়ো—কতকাল আর বাঁচবে!

না না, বুড়োর মৃত্যুর আশায় দিন গুনে গুনে আর পারি না। ইচ্ছে করে দুহতে সব ভেঙে মুচড়ে যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাই।

কিন্তু যাবি কোথায়? পেট চলবে কী করে?

পেটের ভাবনা ভাবছিস তুই অধীর! ভিক্ষে করে খাব, তবু এ আর সহ্য হয় না। ভেবে দেখ তুই, ওকে খুন করা ছাড়া আর আমাদের মুক্তির উপায় নেই। ওকে খুন করা উচিত—ও মরুক। ও মরুক। এখন ওর পক্ষে মরণই মঙ্গল।

ছি ছি, এসব কী তুমি বলছো মেজদা?

অনেক দুঃখে, অনেক কষ্টেই বলছি। শীঘ্র যদি ও না মরে, আমিই নিজে হাতে ওকে এই পৃথিবী থেকে সরাব। হ্যাঁ, আমিই সরাব। এবং তার উপায়ও ভেবে রেখেছি। কেউ জানবে, কেউ সন্দেহমাত্র করতে পারবে না। অথচ নিঃশব্দে কাজ হাসিল হবে। শোন্ কী উপায় আমি ভেবেছি……

তারপর আর শোনা গেল না।

কিরীটী গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

পাশের ঘরেই অধীর থাকে।

কিন্তু…

***

দিন-দুই প্রতিমা কতকটা যেন ইচ্ছা করেই ওদের ধার দিয়ে গেল না। এড়িয়ে এড়িয়ে বেড়াল।

কিন্তু আচমকা আবার সেদিন আবছা ভোরের আলোয় সমুদ্র-কিনারে সমীরের সঙ্গে প্রতিমার দেখা হয়ে গেল।

সমুদ্রের বালুবেলায় একাকী সমীর দাঁড়িয়ে আছে।

পরিধানে ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি।

মাথার চুল এলোমেলো রুক্ষ, সাগর-হাওয়ায় আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

যেন এক বিষাদের প্রতিমূর্তি।

করুণায় প্রতিমার হৃদয় দ্রব হয়ে এল। আহা, কী অসহায়। প্রতিমা আর নিজেকে রোধ করে রাখতে পারলে না, এগিয়ে এল, নমস্কার সমীরবাবু।

কে? চমকে সমীর ফিরে দাঁড়াল।

সেই প্রভাতের প্রথম আলোয় প্রতিমার দিকে তাকিয়ে সমীরও মুগ্ধ হয়ে গেল।

কী সুন্দর! কী স্নিগ্ধ!

সত্যিই প্রতিমাকে সে-সময় বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল।

সাগর-নীল রঙের একখানি ছাপা মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়ি পরিধানে। গায়ে সাদা রঙের জরির কাজ-করা ব্লাউজ। মাথার চুলগুলি এলোমেলো করে কাঁধের উপর হেলে রয়েছে।

পায়ে শ্রীনিকেতনের চপ্পল।

মুগ্ধবিস্ময়ে সে সমীরের দিকে তাকিয়ে। যেন সাগরলক্ষ্মী সাগর-শয্যা হতে এইমাত্র নিদ্রা ভেঙে বালুবেলার উপরে এসে দাঁড়িয়েছে। সত্যি কি সুন্দর আপনি, প্রতিমা দেবী! বড় ভাল লাগে আপনাকে আমার। মুগ্ধকণ্ঠে সমীর বললে।

সহসা প্রতিমার মুখখানা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। কিন্তু চকিতে সে আপনাকে সামলে নিল, সেদিনকার ঘটনার জন্য সত্যই আমি বড় দুঃখিত ও লজ্জিত সমীরবাবু। তারপরই স্বরটাকে গাঢ় করে বললে, কেন—কেন আপনি এ অত্যাচার সহ্য করছেন? ও শয়তানের খপ্পর থেকে বের হয়ে আসুন! পুরুষমানুষ আপনি, এ দুর্বলতা কেন?

কিন্তু সমীর প্রতিমার কথায় যেন স্বপ্লেখিতের মত সজাগ হয়ে উঠল, না না, আপনি যান। আপনি এখান থেকে যান। আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আমি আপনার সঙ্গে আর কথা বলতে চাই না। ভয়চকিত কণ্ঠস্বরে কথাগুলি বলতে বলতে একপ্রকার ছুটেই যেন কতকটা সমীর হোটেলের দিকে চলে গেল।

স্তব্ধ-বিস্মিত প্রতিমার দু-চোখের কোলে জল উপচে উঠল। আহা, সমুদ্রের বুকে কে অদৃশ্য শিল্পী তুমি রক্তরাঙা আবির মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দিয়েছ।

এ কি নয়নাভিরাম অপূর্ব দৃশ্য!

হে অদৃশ্য শিল্পী, আমার প্রণাম গ্রহণ কর।

***

সেই দিন সন্ধ্যায়।

আজ আর গগনেন্দ্রনাথ সমুদ্রের ধারে সান্ধ্যভ্রমণে বের হননি। সকলেই যে যাঁর বসবার ঘরে বসে আছেন।

কিরীটীও আজ সন্ধ্যায় বের হয়নি, কেননা মাথাটা তার সেই দুপুর থেকে বিশ্রীরকম ধরে আছে।

ঠিক হয়েছে আগামী কাল সকালে সে কোণারক দেখতে যাবে।

দু-চার দিন পরে ফিরবে।

রণধীর সে-ঘরে নেই, নিজের ঘরে শুয়ে আছে।

বিনতা সামনে বসে উল দিয়ে কী একটা বুনছিল, ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি আটটা ঘোষণা করল।

বিনতা হঠাৎ যেন চমকে দাঁড়াল, কাকা, আপনার ওষুধ খাবার সময় হল, ওষুধটা নিয়ে আসি গে!

গগনেন্দ্রনাথ চোখ বুজে ঝিমোচ্ছিলেন, মৃদুস্বরে বললেন, যাও। কিন্তু ওষুধ খাবার সময় আমার আধঘণ্টা আগেই হয়েছিল। তোমাদের কি আর সেদিকে খেয়াল আছে। তোমাদের সকলের যে আজকাল কী হয়েছে, তোমরাই তা জান। সময়মত ওষুধটাও দিতে যদি না পার, বললেই তো হয়, আমার নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করব। কারও সাহায্যেই আমার দরকার নেই।

বিনতা বিনা বাক্যব্যয়ে ঔষধ আনতে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। রাগে অপমানে একটা নিষ্ফল বেদনায় তার সমগ্র অন্তরাত্মা তখন গর্জাচ্ছে।

চোখ ফেটে জল আসতে চায়।

বিনতার ঘরেই সাধারণত সব ঔষধপত্র থাকত।

সে যখন ঘরে এসে প্রবেশ করল, রণধীর তখন একটা চেয়ারের উপরে শুয়ে আলোয় কী একখানা বই পড়ছে।

ঔষধ কাঁচের গ্লাসে ঢেলে নিয়ে যেতে যেতে একবার আড়চোখে স্বামীর প্রতি চেয়ে বিনতা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। গগনেন্দ্রনাথকে ঔষধ খাইয়ে বিনতা ঔষধের গ্লাসটা রাখতে ঘরে ফিরে এল।

রণধীর তখন বইখাতা কোলের উপরে নামিয়ে রেখে কী যেন ভাবছিল।

বিনতা তার সামনে এসে দাঁড়াল।

কে, বিনতা? রণধীর প্রশ্ন করলে।

হ্যাঁ, আমি। কিন্তু তুমি কি আজও এমনি করে নিশ্চিন্তই থাকবে?

রণধীর চমকে সোজা হয়ে বসে বিনতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করল, কী হয়েছে বিনতা?

কী হয়েছে? নতুন করে কী আর হবে? ওগো, আমি আর সহ্য করতে পারি না, যেখানে হোক চল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই—এখুনি, এই মুহূর্তে। কান্নায় বিনতার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।

রণধীর রীতিমত চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু কী সে জবাব দেবে এ প্রশ্নের?

কী ভাবছ? আর কতকাল এমনি ভাবে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করব? ওগো, তুমি কি সত্যিই পাষাণ? এইভাবে কষ্ট দেবে বলে কি তুমি বিয়ে করেছিলে?

বিনতা, স্থির হও। কোথায় যাব বল? এ আশ্রয় ছেড়ে গেলে পথে পথে আমাদের অনাহারে ঘুরে বেড়াতে হবে। এই যুদ্ধের দুর্মূল্যের বাজারে কেমন করে দিন চালাব?

চলবে। কেন তুমি ভাবছ, আমি আবার চাকরি নেব।

তোমার রোজগারে আমাকে জীবনধারণ করতে হবে? এর থেকে কি তাও ভাল নয়?

না।

বিনতা কিছুক্ষণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরে গম্ভীর স্বরে বললে, বেশ, তবে তুমি থাক তোমার ঐ অত্যাচারের ঐশ্বর্য নিয়ে, আমি চলে যাব। দু-মুঠো অন্নের আমার অভাব হবে না জেনো।

বিনতা ধীর শান্তপদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

রণধীর ব্যাকুল স্বরে ডাকলে, বিনতা, শোন-শোন!

কিন্তু বিনতা ফিরে এল না।

***

রাত্রি প্রায় পৌনে নটা।

সকলে এবার খেতে যাবে।

কিশোর একটা শোফার উপরে ক্লান্তভাবে শুয়ে ঝিমোচ্ছিল, সকলেই উঠে দাঁড়াল কিন্তু কিশোর উঠল না।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ডাকলেন, কিশোর, ওঠ। খেতে চল।

আমি আজ আর খাব না কাকা। আবার বোধ হয় আমার জ্বর হয়েছে।

গগনেন্দ্রনাথ কিশোরের সামনে এসে তার কপালে হাত দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। তবে যাও, নিজের ঘরে শুয়ে থাক গিয়ে।

কিশোর কী এক করুণ মিনতিভরা দৃষ্টিতে গগনেন্দ্রনাথের ভাবলেশহীন মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করল, একা একা আমার কোণের ঘরে শুতে বড় ভয় করে কাকা!

ছেলেমানুষী করো না কিশোর, শুতে যাও।

এখন একটু এখানেই থাকি, তোমরা খেয়ে এস, তারপর আমি যাবখন।

তীব্রস্বরে গগনেন্দ্রনাথ এবারে ডাকলেন, কিশোর?

সভয়ে ত্রস্ত কিশোর উঠে দাঁড়াল।

বিনতা কিশোরের সামনে এগিয়ে এল, চল কিশোের, আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, তাহলে তো ভয় করবে না!

গগনেন্দ্রনাথ গম্ভীর শান্ত স্বরে বলে উঠলেন, না। কেউ ওর সঙ্গে যাবে না। ও একাই যাবে। যাও কিশোর, শুতে যাও। ধীরপদে মাথা নীচু করে একপ্রকার টলতে টলতেই কিশোর ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

নিজের ঘরে এসে কিশোর অন্ধকারেই শয্যার উপরে কোনমতে লুটিয়ে পড়ল।

সত্যিই তার তখন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

বসবার ঘরে বারীনবাবু এক কোণায় বসেছিলেন, হঠাৎ তিনি গগনেন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে, কিশোর চলে গেলে বললেন, সত্যি হয়ত ও ভয় পায় একা একা শুতে, গগনবাবু। হাজার হোক ছেলেমানুষ তো।

গগনেন্দ্রনাথ তীব্রভাবে ফিরে দাঁড়ালেন, নিজের কাজ নিজে করুন মশাই, অন্যের কাজে মাথা ঘামাবার তো কোন দরকার নেই আপনার!

বারীনবাবুও তীব্রস্বরে জবাব দিলেন, সত্যি, আপনার মত অভদ্র আমি দেখিনি।

তীব্র ব্যঙ্গের স্বরে গগনেন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, তাই নাকি!

তারপরই কিছুক্ষণ বারীনবাবুর চোখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঘর হতে বের হয়ে যাবার জন্য ফিরে দাঁড়ালেন এবং চলতে চলতে কতকটা আত্মগতভাবে বলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না। মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি। সবই আমার মনে আছে। কোন মুখ আমি ভুলিনি।

***

প্রতিমা এতক্ষণ স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল ও শুনছিল।

ওঁরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই সে চুপিসাড়ে পায়ে পায়ে গিয়ে কিশোরের ঘরে প্রবেশ করল।

পায়ের শব্দে কিশোর চমকে প্রশ্ন করলে, কে? কে?

চুপ, চেঁচিও না। আমি প্রতিমা। প্রতিমা কিশোরের শয্যার পাশটিতে এসে দাঁড়াল।

কিশোর মৃদুস্বরে বললে, ডাঃ গাঙ্গুলী?

কিশোরের শয্যার পাশটিতে বসে, কিশোরের রোগতপ্ত কপালে হাত বুলোতে বুলোতে গভীর স্নেহের সঙ্গে প্রতিমা বললে, আমাকে তুমি প্রতিমাদি বলেই ডেকো কিশোর। আমার কোন ছোট ভাই নেই, তুমিই আমার ছোট ভাইটি। কেমন, তুমি আমার ভাই হতে তো?

হব।

তুমি বলছিলে একা একা নাকি তোমার এ ঘরে শুতে ভয় করে, কেন তোমার ভয় করে ভাই? প্রতিমা প্রশ্ন করলে।

কি জানি প্রতিমাদি, সত্যি আমার বড় ভয় করে। মনে হয় এই ঘরের আশপাশে অন্ধকারে কারা যেন সব লুকিয়ে আছে। যত রাত্রি বাড়তে থাকে তারা সব আমার বিছানার চারপাশে এসে ভিড় করে দাঁড়ায়। অন্ধকার থেকে চাপা গলায় ফিসফিস করে কারা যেন আমাকে ডাকে। আমি শুনতে পাই, দিনের বেলাতেও তারা আমাকে ডাকে। তারা গান গায়, তারা হাসে, তারা কাদে।

পাগল ছেলে! ও তোমার মনের ভুল। ওসব কিছু না।

বললে তুমি বিশ্বাস করবে না প্রতিমাদি, তাদের আমি খুব ভাল করে দেখতে পাই না বটে, কিন্তু তারা আমার চারপাশে সর্বদা ঘোরে, আমাকে চাপা গলায় কেবলই ডাকে, তা টের পাই।

এবারে আর দেখো ডাকবে না। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা ওষুধ এনে দিচ্ছি। প্রতিমা নিজের ঘরে গিয়ে একটা ভেরনল ট্যাবলেট নিয়ে এসে কিশোরকে খাইয়ে দিল। শীঘ্রই কিশোরের চোখের পাতায় ঘুম নেমে এল।

ঘুম আসছে প্রতিমাদি, ঘুমোই। কতদিন আমি ভাল করে ঘুমোই না।

সস্নেহে প্রতিমা জবাব দিল, হ্যাঁ, ঘুমোও।

অনেকদিন পরে সেরাত্রে কিশোর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল।

***

পরের দিন খুব প্রত্যুষে কিরীটী কোণারক দেখতে চলে গেল, এখানকার আবহাওয়ায় মনটা তার সত্যিই বড় বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রতিমা নিজের ঘরে বসে কি একখানা মনোবিজ্ঞানের বই পড়ছিল, ডাঃ চক্রবর্তী এসে ঘরে ঢুকল, চলুন প্রতিমা দেবী, সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে আসি।

প্রতিমা বই রেখে উঠে দাঁড়াল, চলুন।

বেরুবার পথে হঠাৎ প্রতিমার সমীরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল, সমীর যেন প্রতিমাকে দেখে কি বলবার জন্য একটু এগিয়ে এল, কিন্তু প্রতিমা সেদিকে লক্ষ্য না করে হনহন করে এগিয়ে গেল। আজ দুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথের শরীরটা অসুস্থ। বসবার ঘরে কাল থেকে আর আসেন না। সর্বদাই তাঁর ঘরের সামনে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে গায়ে কমলালেবু রঙের একটা শাল জড়িয়ে বসে থাকেন। মেজাজটা আরও খিটখিটে হয়ে উঠেছে। হোটেলের চাকর-খানসামাদের পর্যন্ত নানা কাজের খুঁত ধরে চেঁচামেচি করেন। খাবার ঘরে যান বটে, কিন্তু এক গ্লাস দুধ ও কিছু ফল খেয়ে উঠে আসেন।

কিশোরের সকালের দিকে জ্বর থাকে না বটে, কিন্তু সন্ধ্যার পরেই একটু ঘুষঘুষে জ্বর। আসে। চোখ মুখ গা হাত পা জ্বালা করে। অমিয় ও প্রতিমা কিশোরকে ভাল করে পরীক্ষা করে গোপনে গোপনে কি ঔষধপত্র দিচ্ছে। গগনেন্দ্রনাথ জানতে পারলে আর রক্ষা থাকবে না তা ওরা ভাল করেই জানে। ঠিক বলবেন, অনধিকার চর্চা!

***

আজ দুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথও যেমন বিকেলে কোথাও বেড়াতে বের হন না, ভাইপোদেরও যেতে দেন না বাইরে। সর্বদাই তারা ছায়ার মত গগনেন্দ্রনাথের চারপাশে ভিড় করে থাকে। প্রত্যেকের মুখের উপরে যেন একটা বিষাদের কালো মেঘ থমথম করে।

***

সেদিন সকাল থেকেই আকাশের বুকে একটা পাতলা কালো মেঘের যবনিকা দুলছে।

সাগর হয়েছে যেন একটু বিশেষ চঞ্চল।

সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া বইছে বাঁধনহারা।

সাগরের বুকে ঢেউয়ের সে কি মাতামাতি!

বড় বড় উঁচু কালো ঢেউগুলি যেন সাদা দাঁতের পংক্তি বের করে সমগ্র বিশ্বদুনিয়াকে গিলবার জন্য ক্ষুধিত লালসায় শত বাহু বাড়িয়ে বহুঙ্কারে ছুটে এসে বালবেলার উপরে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। দ্বিপ্রহরের দিকে হোটেলের উপরতলায় সকলেই প্রায় সেদিনকার সমুদ্রের সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে সাগরকিনারে চলে গেলেন।

গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ঘরের সামনে আরামকেদারায় চুপটি করে বসে আছেন।

কিশোর তার ঘরে শুয়ে, বাকি সবাই গগনেন্দ্রনাথের চারপাশে বসে। হঠাৎ একসময়ে গগনেন্দ্রনাথ ভাইপোদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, তোমরাও আজ সব সমুদ্র দেখে এস। দুদিন তোমরা ঘরের মধ্যে আটকা আছ। যাও, সবাই ইচ্ছামত বেড়িয়ে এস। কিন্তু দেখো, সন্ধ্যা পর্যন্ত যেন বাইরে থেকো না।

কাকার কথা শুনে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এ শুধু আশ্চর্যই নয়, অভাবনীয়ও বটে।

এমনি করে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আজ পর্যন্ত জ্ঞানত এর আগে কোনদিন তাদের মিলেছে কিনা তারা মনে করতে পারে না।

বদ্ধ ঘরের বদ্ধ হওয়ায় তীব্র অনুশাসনের গণ্ডির মধ্যেই তারা আবদ্ধ।

সকলেই একে একে উঠে দাঁড়াল। কেননা অসম্ভব অভাবনীয় হলেও কাকার আদেশ বা অনুমতিকে অবহেলা করার মত তাদের কারো দুঃসাহস নেই।

সমীরই সবার আগে গায়ে পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। কয়েকদিন হল সমর রায় নামে একজন কবি ও আটিস্ট এসে বারীনবাবুর পাশের ঘরখানি অধিকার করেছে।

সমরবাবুর বয়েস ছাব্বিশ-সাতাশের বেশী হবে না। রোগা লিকলিকে দেহের গঠন। মাথাভর্তি এলোমেলো ঝাকড়া ঝাকড়া বাবরী চুল কাধের উপরে লুটিয়ে আছে। গায়ের রং কালো। চোখমুখ বেশ তীক্ষ্ণ তবে একটা মেয়েলী ঢং আছে। চোখে পানে, একটা সরু সিল্কের কারের সঙ্গে গলদেশে দোদুল্যমান।

সমরবাবু অতি-আধুনিক কবি। রবীন্দ্র-শেষ যুগে যেসব কবি আপনাতে আপনি দ্যুতিমান, নক্ষত্রনিচয় রবি-প্রতিভাকে স্নান করে দেবার দুর্বার বাসনায় উচ্চকণ্ঠে সগৌরবে আপনাদের বিজয়-দুন্দুভি পিটছেন, সমর রায় তাঁদেরই একজন।

রবীন্দ্রনাথ নাকি কোন একজন অতি আধুনিক কবির কবিতা পড়ে বলেছিলেন, অমুকের কবিতা যদি কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন, তবে সত্যিই তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।

জানি না কেউ বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন কিনা তাঁকে।

সমীর চিরদিনই কবিতার ভক্ত। সমরবাবু একজন কবি শুনে তার মনটা সহজেই সমরবাবুর দিকে একটু ঝুঁকেছিল।

দূর থেকে সমরবাবুর উদাস বধূ কৈ বধূ কৈ ভাব সমীরের মনে একটা বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিল সন্দেহ নেই।

সে সমরবাবুর সঙ্গে আলাপ করবার জন্য সুযোগ খুঁজছিল।

সমীর যখন কাকার আদেশে হোটেল থেকে সাগরের দিকে বেড়াতে যাবার জন্য বেরুচ্ছে, হঠাৎ দরজায় সমরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

সমরবাবুও তার খাতা ও ঝরনা কলম নিয়ে তখন সমুদ্রের দিকে চলেছেন।

দুজনের দরজার গোড়ায় দেখা হতেই সমীর হাত তুলে সমরবাবুকে নমস্কার জানাল। সাগরের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সহজেই দুজনের আলাপ-পরিচয় জমে উঠল।

সমীর বলছিল, আপনি যে একজন কবি তা আমি শুনেছি সমরবাবু, কোন্ কোন্ কাগজে আপনি কবিতা লেখেন?

সমরবাবু জবাব দিলেন, সব কাগজেই প্রায় লিখি।

তবু?

যেমন ধরুন, পথহারা পাখী, কবরখানা, কসাইঘর, কারা-প্রাচীর-সব পত্রিকাতেই আমি লিখি।

ভারতবর্ষ প্রবাসীর সঙ্গে সমীরের পরিচয় আছে বটে কিন্তু সমরবাবু বর্ণিত কাগজগুলোর নাম দু-একবার শুনলেও চোখে দেখার সৌভাগ্য তার কোনদিনও হয়নি, অতএব সে চুপ করেই পথ চলতে লাগল।

সহসা একসময় আবার সে প্রশ্ন করলে, এখানে এসে অবধি নতুন কোন কবিতা আপনি লেখেননি সমরবাবু?

হ্যাঁ, একটা লিখছি, শুনবেন? এখনও কিন্তু শেষ হয়নি।

হ্যাঁ, বলুন না?

তবে শুনুন, সমর চলতে চলতেই কবিতা আওড়াতে শুরু করলেন। কবিতার নাম :

পুরীর সমুদ্র

হে সমুদ্র? তুমি কি একটা পাখী,
পশু না হংসডিম্ব?
কিংবা রেলের লাইন, কাঁটা তারের বেড়া
জেলের কয়েদীদের চোখের জল।
তুমি কার বেদনা দীর্ঘশ্বাস;
কার ছেঁড়া চটিজুততা!
কিংবা কোন কেরানীর হেঁড়া পাতলুন!
পথিকের ক্ষয়ে যাওয়া শুক্‌তলা,
যুদ্ধের ধূসর তাঁবু
তোমার গর্জনে শুনি সৈনিকের মার্চ,
যেন পায়ে অ্যামুনিশন বুট।
কিংবা রাইফেল মেসিনগান
বোমারু হাওয়াই জাহাজ!
আমি হতবাক!

সমরবাবু হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, এই পর্যন্তই লিখেছি, বাকি এখনও লেখা হয়নি, ভাব তো সব সময় মাথায় আসে না। ভাব বা প্রেরণা মনের একটা অস্বাভাবিক ক্ষণমুহূর্ত। কিন্তু কেমন লাগল কবিতাটা আপনার সমীরবাবু?

সমীর বোকার মতই যেন হঠাৎ বলে ফেললে, বেশ। কিন্তু বুঝলাম না তো!

সমরবাবু সোল্লাসে বলে উঠলেন, বোঝেননি তো? ঐখানেই আমাদের অতি আধুনিক কৃতিত্ব। আমাদের কবিতা ভাবীকালের জন্য। এই যে প্রতীক্ষিত বেদনা, এর একটা বিপুল রূপ—এ তো সকলের চোখে ধরা পড়বার নয়!

***

ঘরের মধ্যে খাটের উপরে শুয়ে ডাঃ চক্রবর্তী সমগ্র দেহখানি একটা কম্বলে ঢেকে কি একখানা বই পড়ছিল।

ভিতরে আসতে পারি কি? বাইরে থেকে প্রতিমার গলা শোনা গেল।

ডাঃ চক্রবর্তী শশব্যন্তে উঠে বসল শয্যার উপর, আসুন প্রতিমা দেবী।

প্রতিমা হাসতে হাসতে এসে ঘরে প্রবেশ করল। তারপরই ডাঃ চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বললে, এ কি, অসময়ে বিছানায় শুয়ে যে?

শরীরটা সকাল থেকেই যেন কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, আবার ম্যালেরিয়া জ্বর আসছে কিনা বুঝতে পারছি না। অমিয় বললে।

প্রতিমা হাসতে হাসতে বললে, ডাক্তার মানুষের অসুখ, এ তো ভাল নয়! কই দেখি। আপনার নাড়ীটা?

নাড়ী দেখে প্রতিমা বললে, না, জ্বর নেই, তবে pulseটা একটু rapid, চলুন সমুদ্রের ধারে একটু হাওয়ায় বেড়িয়ে আসবেন, হয়ত ভাল লাগতে পারে।

অমিয় জামাটা গায়ে দিতে দিতে উঠে দাঁড়াল, চলুন।

হোটেল থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে দুজনে সমুদ্রের কিনারে কিনারে বালুবেলার উপর দিয়ে হেঁটে চলল।

অনেকটা দূর গিয়ে অমিয় বললে, আসুন প্রতিমা দেবী, এখানে একটু বসা যাক।

***

রণধীর ও অধীর দুজনে হোটেল থেকে বের হয়ে গেল। পিছু পিছু বিনতাও বের হয়ে গেল।

একমাত্র কিশোর শুধু গেল না, নিজের ঘরে শুয়ে রইল।

***

ধীরে ধীরে দিনের আলো নিভে আসছে।

দিনের শেষের রক্তিমাভ শেষ সূর্যরশ্মি সমুদ্রের নীল জল লাল করে তুলেছে।

অমিয় প্রতিমার দিকে ফিরে বললে, জুর বোধ হয় এসে গেল প্রতিমা দেবী, বড্ড শীতশীত করছে। আমি ফিরে যাই।

প্রতিমা শশব্যন্তে উঠে দাঁড়ালেন, আমিও সঙ্গে যাচ্ছি চলুন।

না না, অমিয় প্রতিবাদ করে উঠল, আমি একাই যেতে পারব, আপনার মিথ্যে কষ্ট করতে হবে না।

কষ্ট! এতে আবার কষ্ট কি বলুন তো?

না না, আমি একাই ফিরে যাচ্ছি।

অমিয় চলে গেল। প্রতিমা সাগরের দিকে চেয়ে গুনগুন করে গাইতে লাগল।

আমার দিন ফুরাল, ব্যাকুল বাদল সাঁঝে,
বনের ছায়ায় জল ছল ছল সুরে
হৃদয় আমার কানায় কানায় পুরে
ক্ষণে ক্ষণে ঐ গুরু গুরু তালে
গগনে গগনে গভীর মৃদঙ্গ বাজে।
কোন দুরের মানুষ কেন এলো কাছে
মনের আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে,
বুকে দোলে তার বিরহ-ব্যথার মালা,
গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা
মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি
হার মানি তার অজানা মনের মাঝে।

প্রতিমা দেবী?

কে? প্রতিমা চমকে ফিরে তাকাল, ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে সমীর।

সমীরবাবু! আসুন, বসুন। বলে প্রতিমা আবার অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

আমি আমার সেদিনকার ব্যবহারের জন্য সত্যই অনুতপ্ত প্রতিমা দেবী। আমাকে ক্ষমা করুন। কুণ্ঠিত স্বরে সমীর বললে।

ক্ষমা! কী বলছেন আপনি সমীরবাবু? আপনি তো কোন অন্যায়ই করেন নি। সত্যিই আপনার কাকা যখন আপনাদের অন্যের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না…

সত্যি প্রতিমা দেবী, মাঝে মাঝে যে আমার কী হয়, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যায় মাথার মধ্যে। সত্যি এ বাঁধন আমার অসহ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি নিরুপায়, মুক্তির

কোন পথই খুঁজে পাই না..কী আমি করব বলতে পারেন?

চলে আসুন সমীরবাবু, ঘরের বাঁধন ছিড়ে চলে আসুন। আমি তো ভেবে পাই না, কী করে দিনের পর দিন এই শাসন সহ্য করে আসছেন। আমি হলে এতদিন পাগল হয়ে যেতাম, না হয় আত্মহত্যা করতাম।

হয়ত শেষ পর্যন্ত আর কিছুদিন এভাবে থাকতে হলে আত্মহত্যাই আমাকে করতে হবে। আমি বড় ক্লান্ত।

পুরুষমানুষ আপনি, আত্মহত্যা করবেন কেন? ছিঃ ছিঃ, ওসব কথা কল্পনায়ও মনে স্থান দেবেন না। এ অত্যাচারকে আপনার জয় করতে হবে। মনে সাহস আনুন।

সত্যি এ বাঁধন আমি ছিড়ে ফেলব। এমনি করে কেউ কোনদিনই আমাকে বলেনি। কিন্তু …, সহসা সমীর গভীর আগ্রহে প্রতিমার একখানা হাত চেপে ধরে বললে, আমি পারব, তুমি যদি আমার সহায় হও প্রতিমা! তুমি যদি আমার পাশে এসে দাঁড়াও! বলবল প্রতিমা, তুমি আমার সহায় হবে! আজই আমি এর একটা মীমাংসা করব।

ধীরে ধীরে প্রতিমা তার ধৃত হাতখানা ছাড়িয়ে নিল, সমীর! বললে প্রতিমা, আমি তোমার সহায় হলেই কী তুমি জয়ী হতে পারবে?

পারব। সত্যি তোমার মুখের দিকে চাইলে যেন আমার মনে সাহস আসে, নিজেকে যেন খুঁজে পাই। তারপর হঠাৎ উঠে পড়ে সমীর বললে, এখুনি আমি চললাম প্রতিমা। মনে হঠাৎ যা উঠেছে, এখনি যদি এর সংশোধন না করি, আবার আমি সাহস হারিয়ে ফেলব। আমি যাই। সমীর দ্রুতপদে স্থানত্যাগ করে চলে গেল।

সমীরের ক্রম অপস্রিয়মাণ গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহসা গভীর স্নেহে প্রতিমার চোখের কোল দুটি জলে ভরে উঠল।

***

যতীনবাবু নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে কি একটা মাসিকের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। সহসা ওপাশের বারান্দা থেকে কি একটা গোলমালের আওয়াজ কানে এল। উনি মুখ তুলে দেখলেন, একটা খানসামা দ্রুতপদে বারান্দা অতিক্রম করে কিশোরের ঘরের দিকে চলে গেল। যতীনবাবু বুঝলেন, কোন কারণে আবার গগনেন্দ্রনাথ খানসামার উপরে চটে গেছেন। তিনিই বোধ হয় তাকে গালাগাল দিচ্ছিলেন। চেয়ে দেখলেন, গগনেন্দ্রনাথ একটা শাল গায়ে দিয়ে নিত্যকারের মত ইজিচেয়ারটার উপর হেলান দিয়ে বসে আছেন। আচ্ছা মাথা খারাপ যাহোক! যতীনবাবু আবার পড়ায় মনোনিবেশ করলেন; কেননা এ ধরনের ব্যাপার রোজই প্রায় দুচারবার হয়।

***

বারীনবাবু বেড়াতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যতীনবাবুর ঘরের সামনে দাঁড়ালেন, যতীনবাবু!

কে, বারীনবাবু? আসুন।

চলুন না সাগরের ধার থেকে একটু বেড়িয়ে আসা যাক।

এখুনি যাবেন? আর একটু বেলা পড়লে গেলে ভাল হত না?

হাতঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে বারীনবাবু বললেন, বেলা আর আছে কই, সোয়া চারটে বাজে। শীতকালের বেলা, তারপর আবার মেঘে মেঘে সন্ধ্যা হতে বেশী দেরিও হবে না।

বেশ চলুন।

যতীনবাবু উঠে জামাটা গায়ে চাপিয়ে বারীনবাবুর সঙ্গে ঘর থেকে বের হলেন।

গগনেন্দ্রনাথ তখনও একই ভাবে চেয়ারটার উপরে চুপটি করে শাল গায়ে জড়িয়ে বসে আছেন।

বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে বারীনবাবু উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললেন, আজ কেমন আছেন গগনবাবু?

গগনেন্দ্রনাথ জবাবে ঠিক কি যে বললেন তা শোনা বা বোঝা গেল না বটে, তবে বারীনবাবু মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকিয়ে বললেন, দেখলেন যতীনবাবু, লোকটা সত্যিই কি অভদ্র! শরীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, ঝাজাল স্বরে জবাব দিলেন, বেশ আছি। সত্যি, এত অভদ্র আমি, জীবনে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

যতীনবাবু চলতে চলতেই মৃদুস্বরে জবাব দিলেন, একে ভদ্রলোকের বেশ খিটখিটে মেজাজ, তারপর আবার অসুস্থ। গভর্নমেন্টে যাঁরা চাকরি করেন তাঁরা বুড়ো হয়ে পেনশন নেবার পর এইরকম খিটখিটে বদমেজাজী হন।

তার কারণ কি জানেন? বেশীর ভাগ বুড়োরাই আমাদের দেশে activelife ছেড়ে দেবার পর dispeptic হয়ে পড়েন। ফলে ভাল করে রাত্রে ঘুম হয় না, খিটখিটে হয়ে ওঠেন। বারীনবাবু জবাব দিলেন।

কিন্তু আপনিও তো বুড়ো হয়েছেন বারীনবাবু! আপনি তো কই খিটখিটে মেজাজের হননি? যতীনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ও থিওরিটা কিন্তু আমি মানতে পারলাম না বারীনবাবু।

কিন্তু এক-আধজনকে নিয়েই তো আর সকলকে বিচার করা চলে না যতীনবাবু! হাসতে হাসতে বারীনবাবু জবাব দিলেন।

ওঁদের সঙ্গে পথেই হোটেলের কিছু আগে ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর দেখা হয়ে গেল।

চক্রবর্তী তখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলের দিকে ফিরে আসছে।

অমিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে বারীনবাবু প্রশ্ন করলেন, ডাক্তার, অসুস্থ নাকি?

অমিয় কোনমতে জবাব দিলে, হ্যাঁ, জ্বর হয়েছে।

অমিয় দ্রুতপদে হোটেলে গিয়ে প্রবেশ করল।

পথে সমীরবাবুর সঙ্গেও ওঁদের দুজনের দেখা হল। সমীর তখন দ্রুতপদে হনহন করে হোটেলের দিকে ফিরছে।

ডাক্তার ডাকলেন, কিন্তু সমীর কোন জবাব দিল না ওদের ডাকে। সমীরের মাথার মধ্যে তখন উত্তেজনার আগুন জ্বলছে।

বারীনবাবু সমীরের অপস্রিয়মাণ দেহের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বললেন, পাগল! গুষ্টিসুদ্ধই পাগল!

***

বেলা প্রায় চারটে-পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীর একা একা হোটেলে ফিরে এল।

কাকার সঙ্গে দেখা করে সে দ্রুতপদে নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল এবং জামা কাপড় সমেতই নিজের শয্যার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে রইল।

মাথার মধ্যে তখন তার দপদপ করছে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রণধীরের স্ত্রী বিনতা ফিরে এল, এবং খুড়শ্বশুরের সঙ্গে কী খানিকটা কথাবার্তা বলে রণধীরের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।

***

সমীর কিন্তু হোটলের দোরগোড়া পর্যন্ত এসে আর হোটেলে প্রবেশ করল না। সাগরের কিনারে গিয়ে বসে রইল।

সে যখন হোটেলে ফিরে এল তখন প্রায় সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। সমীরের ফিরে আসবার কিছু আগেই বারীনবাবু ও যতীনবাবু হোটেলে ফিরে আসেন।

***

সন্ধ্যা প্রায় ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে এল এবং হোটেলে ফিরে সটান নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।

***

সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছটার সময় সকলে এসে খাবার ঘরে ঢুকলেন চা খাবার জন্য।

চা খেতে বসে হঠাৎ বিনতা বললে, কাকা তো চা খেতে এলেন না!

সকলেই একবার মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলো, কেননা চিরন্তন নিয়মের এ একটা ব্যতিক্রম।

রণধীর একজন হোটেল-ভৃত্যকে গগনেন্দ্রনাথকে চা পান করতে আসবার জন্য ডাকতে পাঠালে।

অল্পক্ষণ বাদেই চাকরটা দ্রতপদে ফিরে এল, তার সারা মুখে একটা ভীতত্রস্ত ভাব।

বিনতা জিজ্ঞাসা করলে, কিরে, বাবুকে ডেকেছিস?

মু কিছি বুঝি পারিলি নাহি। মু ডাকিলি, বাবু কড়কিছি কহিলে নাহি। আপন আসি দেখন্তু।

সে কি রে! সকলে উঠে দাঁড়াল এবং একসঙ্গে ঘর ত্যাগ করে সকলেই চলে গেল।

একটু পরেই একটা গোলমালের শব্দ শুনে প্রতিমা সেখানে গিয়ে হাজির হল।

সকলে স্তম্ভিত বিস্ময়ে গগনেন্দ্রনাথকে ঘিরে চারপাশে হতবুদ্ধির মত দাঁড়িয়ে আছে।

সকলের মুখেই একটা ভীত্যন্ত ভাব।

ব্যাপার কি, রণধীরবাবু? প্রতিমা ব্যগ্র-ব্যাকুল কণ্ঠে শুধাল।

কী জানি, বুঝতে পারছি না কিছু, দেখুন তো-ডাকছি সাড়া দিচ্ছেন না।

প্রতিমা শশব্যন্তে ভাল করে পরীক্ষা করতেই তার মুখখানা কালো হয়ে গেল, ধীর মৃদুস্বরে বললে, উনি আর বেঁচে নেই, মারা গেছেন।

সকলেই সমস্বরে বললে, সে কি!

কি করে যে এমনি ভাবে হঠাৎ গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু হল কেউ ভেবে পেল না।

প্রতিমা বললে, শুধু হর্টফেল করে মারা গেছেন। আগে থেকেই তো হার্টের অসুখে ভুগছিলেন।

কিন্তু আশ্চর্য, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুকে কেউ এক ফোটা চোখের জলও ফেললে না।

সকলেই যেন ভয়ানক নিশ্চিন্ত হয়েছে।

একটা যেন ভূতের বোঝা এতদিন তারা বয়ে বেড়াচ্ছিল, তার থেকে যেন সকলে মুক্তি পেয়েছে।

অমিয় যখন ব্যাপারটা শুনল, রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে দশটা হবে, সে-ও এল দেখতে। মৃতদেহ ভাল করে পরীক্ষা করেও তার মনটা যেন খুতখুত করতে লাগল।

***

দিন-দুই বাদে কিরীটী কোণারক থেকে ফিরে এল।

গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ শুনে সে-ও স্তম্ভিত হয়ে গেল।

কয়েকদিনের ঘটনাগুলি তার মনের মাঝে এসে নানা চিন্তার জট পাকাতে লাগল।

৩. মীমাংসার সুত্র

সেদিন সন্ধ্যায় সমুদ্রের কিনারায় বসে কিরীটী ও ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল-গগনেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু সম্পর্কে।

কিরীটী বললে, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় একথা কেন তোর মনে হচ্ছে কুনো?

দেখ কিরাত, আমি একজন ডাক্তার। মৃতদেহ আমি সেরাত্রে ভাল করেই পরীক্ষা। করেছিলাম এবং বুড়োর ডান হাতের উপরে কি দেখেছিলাম, জানিস?

কি?

ছোট একটি রক্তবিন্দু ও হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ ফোটাবার দাগ। একটা pinpoint puncture! সেটা দেখেই আমার মনে কি একরকম সন্দেহ হয়। তাছাড়া আর একটা জিনিস সে-রাত্রে ঘটেছিল। আমি যখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসি, কুইনাইন খাবার জন্য আমার ডাক্তারী ব্যাগটা খুলতে গিয়ে দেখি, ব্যাগের মধ্যে আমার 2.5 c.c.হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা নেই। জ্বরে তখন আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথা বনবন করছে। তবুও একবার ব্যাগটা খুঁজলাম, কিন্তু সিরিঞ্জটা পেলাম না। বুঝতে পারলাম না সিরিঞ্জটা কোথায় গেল, কেননা এখানে আসা অবধি সিরিঞ্জটা আমি একদিনও ব্যবহার করিনি। কিন্তু আশ্চর্য হলেও, সে ব্যাপার নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে শুয়ে পড়লাম কম্বল মুড়ি দিয়ে। তারপর রাত্রি প্রায় দশটার সময় গগনবাবুর মৃতদেহ দেখে আবার ঘরে এসে শুই, এবং রাত্রি তিনটের সময় আবার আর এক দফা কাঁপিয়ে জ্বর আসে।

পরের দিন জ্বর ছাড়লে সকালে মুখ ধুতে উঠে দেখি আমার ব্যাগের উপরেই সিরিঞ্জটা রয়েছে এবং সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতেই বুঝতে পারলাম, সিরিঞ্জটা ব্যবহৃত হয়েছে। তখন স্পষ্টই বুঝতে পারলাম, সিরিঞ্জটা কেউ নিয়েছিল, আবার রাত্রে কোন একসময় ফিরিয়ে রেখে গেছে।

কিন্তু সিরিঞ্জটা কে নেবে? কেনই বা নেবে? আচমকা তখন গগনেন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। নানা চিন্তায় আমার মাথা ঘুরতে লাগল।

বিকেলের দিকে সিরিঞ্জটা নিয়ে শহরের একজন কেমিস্টের কাছে গিয়ে সিরিঞ্জের মধ্যে অবশিষ্ট পদার্থটা পরীক্ষা করাতেই দেখা গেল, সেটা ডিজিটসি।

সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা বিদ্যুৎ-চমকের মত মনে এল। গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন; তবে কি কেউ overdose ডিজিটসিন ইজেক্ট করে তাকে হত্যা করেছে?

পাগলের মতো হোটেলে ফিরে এলাম, কেননা আমার ডাক্তারী ব্যাগে এক শিশি ডিজিটকসিন ছিল, কিন্তু আশ্চর্য, হোটেলে ফিরে এসে ব্যাগের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও সে ডিজিটসিনের শিশিটা পেলাম না। ভেবে দেখ, গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন, এক্ষেত্রে তাকে একটা overdose ডিজিটকসিন দিয়ে মারা কত সহজ!

কিরীটী এতক্ষণ গভীর মনোেযোগর সঙ্গে অমিয়র কথা শুনছিল, এখন বললে, হুঁ, ব্যাপারটা আগোগোড়াই সন্দেহজনক! কিন্তু তুই কি একথা কাউকে বলেছিস কুনো?

না। তবে একবার ভেবেছিলাম পুলিসে একটা সংবাদ দেব, কিন্তু পরে সাত-পাঁচ ভেবে তোর অপেক্ষায় বসে আছি। তোর কি মত এখন তাই ব! বলে অমিয় কিরীটীর মুখেরদিকে তাকাল।

আচ্ছা ধরে নিচ্ছি, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, কোন foul play আছে, কিন্তু কে খুন করতে পারে? কিরীটী প্রশ্ন করল।

খুন এক্ষেত্রে ভাইপোদেরই মধ্যে কেউ করতে পারে। গগনেন্দ্রনাথের অত্যাচারে প্রত্যেকেই দিনের পর দিন সহ্যের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছেছিল। এক্ষেত্রে বুড়োকে তাদের কার পক্ষেই খুন করাটা অসম্ভব নয়। দীর্ঘদিন একটা tension-এর মধ্যে থেকে থেকে মনের এমন একটা unsecured অবস্থা এসেছিল, যেখানে হঠাৎ ঝোকের মাথায় খুন করাটা এমন কিছুই নয়।

সত্যিই কি সত্য ব্যাপারটা জানতে চাস অমি? তাহলে কিন্তু পুলিসের সাহায্য নিতে হবে, এখানকার থানা-ইনচার্জ কে জানিস?

হ্যাঁ জানি, খোঁজ নিয়েছি, একজন বাঙালী ভদ্রলোক। কটকেই ডোমিসাইলড। নাম অমরেন্দ্রনাথ মিত্র।

পরের দিন অমরবাবুর সঙ্গে দেখা করে কিরীটী ও অমিয় সমগ্র ব্যাপার আলোচনা করল। সমগ্র ব্যাপারটা শুনে অমরবাবু অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

ফলে ঠিক হল, ডাঃ চক্রবর্তীর evidence-এর উপরে নির্ভর করে ব্যাপারটার একটা investigation করা হবে। রীতিমত আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান শুরু হল।

রণধীর প্রথমটা অত্যন্ত আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু আইনের যুক্তিতে বাধ্য হয়েই তাকে ঘটনার স্রোতে আপনাকে অসহায়ের মত ছেড়ে দিতে হল।

***

অমরবাবুর উপস্থিতিতেই কিরীটী কাজ শুরু করলে। প্রথমে সে প্রত্যেকের (যারা যারা হোটেলের নীচের তলায় ছিলেন) জবানবন্দি নিতে শুরু করলে। প্রথমেই ডাক পড়ল রণধীরের।

কিরীটী প্রশ্ন করতে শুরু করল, আপনার নাম রণধীর মল্লিক?

হ্যাঁ।

আপনি সর্বশেষ কখন আপনার কাকাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান?

আমি বেড়িয়ে ফিরে এসে কাকাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাই। কাকার সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে যখন নিজের ঘরে গিয়ে হাতঘড়িটা খুলে শুয়ে পড়ি, তখন আমার মনে আছে বেশ স্পষ্টই ঘড়িতে চারটে পঁয়ত্রিশ মিনিট।

সময়টা আপনার ঠিক মনে আছে?

আছে।

তারপর আর আপনি আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করেননি?

না।

অর্থাৎ আপনি বলতে চান যে আপনার কাকা মৃত জানবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত হোটেলে ফিরে আসা থেকে আর আপনার কাকার সঙ্গে দেখা হয়নি?

না।

বেশ, আপনি বেড়িয়ে এসে ঘরের মধ্যে গিয়ে শুয়েছিলেন কেন?

আমার শরীরটা ভাল ছিল না, মাথাটাও ধরেছিল, তাই।

আপনি যখন ঘরে শুয়েছিলেন, আপনার সঙ্গে আর কারো দেখা হয়েছিল?

হ্যাঁ, প্রায় মিনিট পনের বাদে আমার স্ত্রী এসে আমার ঘরে ঢোকে।

আপনার স্ত্রী আপনাকে কাকার সম্পর্কে কোন কথা বলেছিলেন?

না।

আপনার ঠিক মনে আছে?

হ্যাঁ।

চা খেতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গেই ছিলেন কী সেই ঘরে?

হ্যাঁ।

আপনাদের দুজনের মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিল জানতে পারি কী?

না, বলতে আমার অত্যন্ত আপত্তি আছে, কেননা সে-সব কথা সম্পূর্ণ আমাদের জীবনের নিজস্ব ব্যাপার।

আচ্ছা আপনি যখন ফিরে এসে কাকার সঙ্গে দেখা করেন, তখন তাকে কোন প্রকার অসুস্থ বা অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়েছিল?

যতদূর মনে পড়ে, না।

আপনার কাকার শরীরটা কয়েকদিন থেকে অসুস্থ ছিল?

হ্যাঁ।

আপনার কাকার সম্পত্তি কী ভাবে ভাগ হবে, জানেন কিছু?

হ্যাঁ–আমরা সব কজন ভাই সমানভাবে পাব।

আপনি আপনার কাকাকে ভালবাসতেন?

না।

কাকার ব্যবহারে আপনি দিনের পর দিন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন নিশ্চয়ই?

তা কতকটা হচ্ছিলাম বৈকি।

আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?

না। তাছাড়া এটাকে আপনারা এভাবে ধরছেনই বা কেন? বুড়ো মানুষ, হাটের ব্যারামে ভুগছিলেন-হঠাৎ হার্টফেল করে মৃত্যু হয়েছে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ডাঃ চক্রবর্তী যে কেন ব্যাপারটাকে সন্দেহের চোখে দেখলেন, বুঝতে পারছি না। মিথ্যে একটা familyকে হয়রান করে আপনাদের লাভই বা কি? তাছাড়া যিনি আমাদের প্রতিপালক, তিনি যতই খারাপ হোন না কেন, আমরা কেউ তাকে খুন করতে পারি এ কথাটা ভাবাও কি বাতুলতা নয় মিঃ রায়!

আপনি এখন যেতে পারেন, রণধীরবাবু। সমীরবাবুকে পাঠিয়ে দিন।

রণধীর ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

কিরীটী একটা কাগজে কতকগুলো কি নোট করে নিল।

সমীর এসে ঘরে প্রবেশ করল।

অত্যন্ত রুক্ষ বিষণ্ণ তার চেহারা। চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। চোখে একটা ভয়চকিত চঞ্চল দৃষ্টি!

অত্যন্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন।

আসুন সমীরবাবু, বসুন। কিরীটী আহ্বান করলে সমীরকে। সমীর সামনের চেয়ারটার উপরে বসে পড়ল।

সমীরবাবু, আপনাকে কতকগুলো কথা জিজ্ঞাসা করব, আশা করি যথাযথ জবাব দেবেন।

বলুন?

আপনি সর্বশেষ কখন আপনার কাকাকে জীবিত দেখেছিলেন?

প্রায় তখন পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিট হবে।

সঠিক সময়টা আপনি জানলেন কি করে?

আমার রিস্টওয়াচটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে কাকার সঙ্গে যখন কথা বলি তখন কাকার হাতঘড়িটা দেখে সময় মিলিয়ে নিই।

হুঁ। আচ্ছা সেই সময় আপনার কাকাকে দেখে কোনরূপ অসুস্থ বা কোনপ্রকার অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়েছিল?

না।

আপনার কাকার সঙ্গে আপনার কি কথাবার্তা হয়েছিল?

তখনকার আমার মনের অবস্থা অত্যন্ত উত্তেজিত ও অস্থির ছিল। দীর্ঘকাল ধরে কাকার শাসনের মধ্যে থেকে আমি পাগল হয়ে উঠেছিলাম। এ ভয়ঙ্কর অবস্থা আর আমার সহ্য হচ্ছিল না। আমি কাকার সঙ্গে একটা শেষ বোঝাপড়া করবার জন্যই এসেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন কথাই আমার বলা হয়নি, তার সামনে এসেই সবটুকু সাহস আমার উবে গিয়েছিল-আমার কোন কথাই আর কাকাকে বলা হল না, ফিরে এলাম নিজের ঘরে।

আপনি যখন বেড়াতে বের হন, তখন কে আপনার সঙ্গে ছিল?

আমি যখন বের হচ্ছি, হোটেলের গোড়াতেই আমার সমীরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়, আমরা দুজনে একসঙ্গে সমুদ্রের ধার ধরে হাঁটতে থাকি। দুজনে কথা বলতে বলতে অনেকটা পথ যাবার পর কিছুকষণ এক জায়গায় বসে গল্প করি, তারপর আমি সেখান থেকে উঠে আসি। পথে ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি সমুদ্রের ধারে বসে গান গাইছিলেন। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে গল্প করবার পর আমি হোটেলে ফিসে আসি।

ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ?

সামান্য দিনের। মৃদুস্বরে সমীর জবাব দেয়।

হুঁ। আচ্ছা সমীরবাবু, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীকে আপনার কী রকম মনে হয়?

চমৎকার। শিক্ষিতা ও অত্যন্ত রুচিসম্পন্না।

ডাঃ গাঙ্গুলীকে আপনার খুব ভাল লাগে, না সমীরবাবু?

কিরীটীর প্রশ্নে সহসা সমীরের সমগ্ৰ মুখখানা সিঁদুরের মত রাঙা হয়ে উঠল, সে কিরীটীর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিপথ থেকে আপনার দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

কিরীটী আবার প্রশ্ন করলে, সেদিন বিকেলে আপনাদের মধ্যে—মানে আপনার ও ডাঃ গাঙ্গুলীর মধ্যে ঠিক কি ধরনের কথাবার্তা হয়েছিল সমীরবাবু?

মাপ করবেন মিঃ রায়, সে কথাগুলো একান্তই আমাদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

আপনার কাকার সম্পর্কে কোন কথা হয়েছিল কি?

হ্যাঁ, হয়েছিল।

কী ধরনের কথা?

এমন বিশেষ কিছু নয়, এবং আমার মনেও নেই তা।

হুঁ। আচ্ছা আপনার কাকাকে আপনি খুব ভালবাসতেন, না?

মোটেই না, বরং বলতে পারেন ভয় করতাম।

আপনার কাকার ব্যবহার আপনার প্রতি কী রকম ছিল?

বলতে পারি না।

আপনি আপনার বর্তমান জীবনধারার প্রতি একান্ত বীতস্পৃহ হয়ে উঠেছিলেন সমীরবাবু, কেমন না?

তা হয়েছিলাম।

আচ্ছা আপনার কাকার হত্যা সম্পর্কে, যদি ধরে নেওয়া হয় তাকে হত্যাই করা হয়েছে, কাউকের সন্দেহ করেন?

না।

আচ্ছা আপনার কাকার এই আকস্মিক মৃত্যু স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক বলে আপনার মনে হয়?

বলতে পারি না।

তবু?

স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। একে তিনি বৃদ্ধ হয়েছিলেন, তারপর হার্টের ব্যারামে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন। মরবার দুদিন আগে palpitation অত্যন্ত বেড়েছিল।

আপনার কাকাকে ঔষধপত্র খাওয়াত কে?

সাধারণত বৌদিই কাকার দেখাশুনা করতেন ও ঔষধপত্র খাওয়াতেন, তবে মাঝে মাঝে আমিও করতাম।

আপনি জানতেন যে, আপনার কাকা নিত্য হার্টের অসুখের জন্য যে ঔষধটা ব্যবহার করতেন তার মধ্যে ডিজিটকসিন ছিল?

না, আমি তো ডাক্তার নই।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন; দয়া করে অধীরবাবুকে পাঠিয়ে দিন এ ঘরে।

নমস্কার। সমীর উঠে দাঁড়াল।

নমস্কার।

কিরীটী টেবিলের উপরে রক্ষিত খাতাটায় কী কতকগুলো নোট করছিল মাথাটা নীচু করে, ধীরে ধীরে অধীর এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

কিরীটী মুখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অধীরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে–সামনে বসুন। আপনি শ্রীযুক্ত অধীর মল্লিক?

অধীর চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে বললে, হাঁ।

অধীরবাবু, আপনাকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করব, আশা করি আপনি তার যথাযথ সত্যি জবাব দেবেন।

নিশ্চয় দেব। কী জানতে চান বলুন?

বেশ, আপনার কথা শুনে সুখী হলাম। আচ্ছা অধীরবাবু, আপনার কাকার এই আকস্মিক মৃত্যু, এটা স্বাভাবিক বলে আপনার মনে হয়, না অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয়?

অত্যন্ত স্বাভাবিক। যাঁরা এই সামান্য সাধারণ ব্যাপারের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক কিছুর ধারণা করছেন, তাদের মতের সঙ্গে আমি একমত নই।

কেন?

কেন আবার কী, বুড়ো মানুষ, দীর্ঘকাল ধরে হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন, মারা গেছেন হার্ট ফেল করে, এতে অস্বাভাবিক বা আশ্চর্য হবার কী আছে?

কিন্তু আপনার মতের সঙ্গে একজন বিচক্ষণ ডাক্তার মত মেলাতে পারছেন না, তার ধারণা আপনার কাকার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।

কেন?

তার কারণ আপনার কাকার হাতে তিনি ইনজেকশনের দাগ দেখেছিলেন। তাছাড়া তার মেডিকেল ব্যাগের মধ্যে এক শিশি ডিজিটসিন ছিল, সেটা ও একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ তার ব্যাগ থেকে আপনার কাকার মৃত্যুর দিন খোয়া যায়! সিরিঞ্জটা পরদিন পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু ঔষধের শিশিটা এখনও পাওয়া যায়নি। ডিজিটসিন তীব্র বিষ। ডাঃ চক্রবর্তীর ধারণা, ডিজিটসিন overdose-এ কাকার শরীরে প্রবেশ করিয়েই তার আকস্মিক মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। সোজা কথায় বলতে পারেন, তাকে খুন করা হয়েছে। আমাদেরও বিশ্বাস তার সে ধারণা নির্ভুল।

অধীর খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল।

হঠাৎ আবার কিরীটী প্রশ্ন করলে, আপনি সেদিন কখন বেড়িয়ে ফেরেন অধীববাবু?

প্রায় পাঁচটা দশ হবে।

হুঁ। ঠিক সময়টা আপনার মনে আছে কি করে?

আমি হোটেলে ফিরেই খাবার ঘরে গিয়ে খানসামার কাছে এক পেয়ালা চা চাই; খাবার ঘরের ওয়াল-ক্লকের দিকে আমার নজর পড়ে, তাতে তখন পাঁচটা বেজে পনের মিনিট।

বেশ। আপনি বেড়িয়ে ফিরে এসে আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করেছিলেন?

না।

বেড়িয়ে ফিরবার পর থেকে সন্ধ্যাবেলা চা পান করতে যাবার আগে পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন?

আমার নিজের ঘরে শুয়েছিলাম।

বেশ। আচ্ছা অধীরবাবু, আমি কোণারকে যাবার আগের রাত্রে আপনার ঘরে, রাত্রি তখন প্রায় দেড়টা হবে, কার সঙ্গে আপনি কথা বলছিলেন? কে সে?

কিরীটীর প্রশ্নে অধীর যেন সহসা অত্যন্ত চমকে উঠল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, মেজদার সঙ্গে।

সমীরবাবুর সঙ্গে?

হ্যাঁ।

আপনার মেজদা কী বলছিলেন, মানে কী সম্পর্কে কথা হচ্ছিল আপনাদের দুজনের মধ্যে?

আমার মনে নেই।

কার সম্পর্কে কথা হচ্ছিল, তাও কি মনে নেই?

না। সঠিক আমার মনে নেই।

এবার কিরীটী তীক্ষ্ণ গম্ভীর স্বরে বললে, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন অধীরবাবু। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন তো, আপনি সত্যি কথা বলছেন, আপনার মনে নেই?

অধীর চুপ করে বসে রইল, চোখ নীচু করেই।

শুনুন অধীরবাবু, কিরীটী রায়ের সঙ্গে বোধ হয় আপনার পরিচয় নেই, তাহলে এভাবে মিথ্যে কথা বলতে সাহস পেতেন না। আপনার সেদিকার কথা হয়ত মনে না থাকতে পারে, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, আপনাদের সে-রাত্রে যে কথাবার্তা হয়েছিল তার কিছু কিছু আমার কানে গিয়েছিল, দুর্ভাগ্যই হোক আর সৌভাগ্যই হোক। আপনাদের মধ্যে কেউ বলছিলেন, না, এ আর সহ্য হয় না, ভেবে দেখ তুই, ওকে খুন করা ছাড়া আর আমাদের মুক্তির উপায় নেই। ওকে খুন করাই উচিত। ও মরুক, ও মরুক। এখন ওর পক্ষে মৃত্যুই মঙ্গল। এবং সেই একই ব্যক্তি এ কথাও বলেছিলেন, আমি নিজে হাতেই ওকে এই পৃথিবী থেকে সরাব। হ্যাঁ, আমিই সরাব এবং তার উপায়ও আমি ভেবেছি। কে এ কথাগুলি সেরাত্রে বলেছিলেন অধীরবাবু, এবং কাকেই বা এ পৃথিবী থেকে সরাবার ষড়যন্ত্র হচ্ছিল?

উত্তেজনায় ভয়ে তখন অধীরের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে, সে কোনমতে একটা ডোক গিলে অতি মৃদু ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বললে, মেজদা কথাগুলো বলছিল, কিন্তু আপনি কি বিশ্বাস করেন আমরা তাকে খুন করেছি?

খুন করেছেন এমন কথা তো আমি বলছি না অধীরবাবু! কিন্তু কথাগুলো…

মিঃ রায়, আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাকার শাসনে নিষ্পেষিত হয়ে, এমন মানসিক অবস্থা আমাদের হয়েছিল যে, কখন কোন উত্তেজনার মুহূর্তে যদি কিছু আলোচনা করে থাকি সেটা কি সত্যি হবে? মানুষ যখন যা মনে ভাবে তাই কি সে করে বা করতে পারে? মনে মনে কখনও খুন করবার কথা ভাবলেই কি খুন করা যায়, আপনি মনে করেন মিঃ রায়?

কিন্তু করা কি একেবারেই অসম্ভব অধীরবাবু?

না না, এ আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমরা আবোল-তাবোল কিছু উত্তেজনার মুখে আলোচনা করলেও, সেটাকে সত্যতায় পরিণত করবার কল্পনাও করিনি।

আপনি এখন যেতে পারেন অধীরবাবু। আপনার বৌদিকে একটিবার দয়া করে পাঠিয়ে দিন।

***

বিনতা দেবী এসে ঘরে প্রবেশ করল।

কিরীটী মুখ তুলে একটিবার বিনতা দেবীর দিকে তাকাল।

মুখের দিকে চাইলে মনে হয় যেন প্রবল একটা ঝড় ওর মনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে।

মাথার চুল রুক্ষ মুখখানা শুকিয়ে গেছে।

কিরীটী বললে, বসুন বিনতা দেবী।

বিনতা ধীরে ধীরে সামনের চেয়ারটার উপরে বসল।

বিনতা দেবী, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই, আশা করি সঠিক জবাব পাব।

আমার সাধ্যমত আপনার প্রশ্নের জবাব দেব, মিঃ রায়।

আপনি সেদিন বিকেলে কখন ফিরে আসেন?

সাড় চারটের পর, পাঁচ-দশ মিনিট এদিক ওদিক হতে পারে।

আপনি শেষ কখন আপনার খুড়শ্বশুরকে জীবিত অবস্থায় দেখেছিলেন?

বেড়িয়ে ফিরে আসবার পর আমি কাকার সঙ্গে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে কথা বলি, তারপর আমার স্বামীর ঘরে চলে যাই। চা খেতে যাবার আগে পর্যন্ত সেই ঘরেই আমরা দুজনে ছিলাম।

কি কথা হয়েছিল আপনার সেই সময় কাকার সঙ্গে?

বিশেষ কিছুই নয়, তারই শরীর সম্পর্কে দু-একটা কথা হয়েছিল।

সেই সময় তাকে কোনপ্রকার অসুস্থ বা কোনরকম অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয়েছিল?

না।

আপনার শ্বশুরের শুশ্রুষা ও ঔষধপত্র দেওয়ার কাজ আপনিই বরাবর করতেন শুনেছি?

হ্যাঁ, তার কারণ বি. এ. পাস করে চাকরি নেওয়ার আগে আমি কিছুদিন নার্সিং শিখেছিলাম।

তাহলে ডাক্তারী আপনি কিছু কিছু জানেন বলুন?

তা একটু-আধটু জানি বললে বিশেষ ভুল হবে না মিঃ রায়। আমার এক মামাতো ভাই ডাক্তার ছিল, সে-ই আমাকে সাধারণ ডাক্তারী ও নার্সিং সম্পর্কে ছোটোখাটো অনেক কিছু শিখিয়েছিল এবং একসময় আমারও নার্সিং শিখবার প্রবল আগ্রহ ছিল।

হ্যাঁ, ভাল কথা, যে ঔষধের শিশিটা থেকে তিনি ঔষধ খেতেন সেটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

হ্যাঁ, শিশিটা ভেঙে গিয়েছিল তাই ফেলে দেওয়া হয়েছে।

আচ্ছা আপনার খুড়শ্বশুর যে ঔষধটা প্রত্যহ খেতেন তার হার্টের ব্যারামের জন্য, তার মধ্যে ডিজিটসিন ছিল জানতেন?

না।

ডিজিটসিন posion-তা জানেন?

জানি।

আপনার স্বামী ও আপনি দুজনেই গগনেন্দ্রনাথের শাসনের আওতায় হাঁফিয়ে উঠেছিলেন?

সুস্থ ব্যক্তি মাত্রেরই সে অবস্থা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে এ বাড়ির বিষাক্ত আবহাওয়ায় থেকে থেকে আমার স্বামীর মনটা যেন আগাগোড়া শুকিয়ে গিয়েছিল। তিনিও যে একজন মানুষ এবং তাকে বাঁচাতে হলে যে মানুষের মত বাঁচা প্রয়োজন, সে কথা তাকে হাজারবার বুঝিয়েও বোঝাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত এই বিষাক্ত আবহাওয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি এ বাড়ি ও আমার স্বামীকে ছেড়ে চলে যাব, এ কথাও কয়েকদিন আগে আমার স্বামীকে বলেছিলাম, যাতে করে তার ঘুমন্ত মনটা সাড়া দেয়।

আপনার কাকার মৃত্যুটা স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক বলে মনে হয়?

স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। ডাঃ চক্রবর্তীর যুক্তি মানতে আমি রাজী নই। তাছাড়া তার মৃত্যুতে এরা সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে; এত দীর্ঘদিন অশান্তির পর আজ যদি এরা। শাস্তি একটু পেয়েই থাকে, সে শান্তিটা আপনি নষ্ট করতে এভাবে উদ্যত হয়েছেন কেন মিঃ রায়? এরা তো আপনার কোনও অনিষ্ট করেনি। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, দিনের পর দিন এরা কী মানসিক যাতনাই সহ্য করেছে! মিঃ রায়, আপনাকে মিনতি জানাচ্ছি, এ প্রহসন বন্ধ করুন। এদের একটু শান্তিতে থাকতে দিন।

শুনুন বিনতা দেবী, আমি বিশেষ কোন একটা ঘটনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখানে এসেছিলাম এবং এখানকার ঘটনা দেখে কেবলই আমার মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা যোগসুত্র আছে। তাছাড়া সত্যের পূজারী আমি, এমন কথা এখনও প্রমাণ হয়নি বা আমি বলিনি যে, আপনাদের মধ্যেই কেউ না কেউ দোষী। তাছাড়া সত্যিই যদি গগনেন্দ্রনাথ খুন হয়েই থাকেন, তবে কি সমাজের পক্ষে, জনসাধারণের পক্ষে এটা একটা প্রকাণ্ড দোষ নয়? খুনীকে নির্বিবাদে সকলের মধ্যে বিচরণ করতে দেওয়াটা কি দোষের নয়? ব্যাপারটা আমি শুধু আপনাদের দিক থেকে বিচার করছি না, করছি ব্যাপক ভাবেই। তাছাড়া এরকম একটা সন্দেহ যখন উঠেছেই, তখন সেই সন্দেহ নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে সন্দেহটাকে মিটিয়ে নেওয়াটাই কি মঙ্গলজনক নয়? আচ্ছা এখন আপনি যেতে পারেন। কিশোরকে একটিবার দয়া করে এ ঘরে পাঠিয়ে দেবেন, তাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।

বিনতা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

কিরীটী নিশ্চিন্ত ভাবে খাতার মধ্যে কতকগুলো কি নোট করতে লাগল।

ভীতচকিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে রুগ্ন এক বালক এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকাল, কী নাম তোমার খোকা? ঐ চেয়ারেই বস। কিশোর চেয়ারের উপরে বসে পড়ল।

আমার নাম?

হ্যাঁ, কী নাম তোমার?

দাঁড়ান। হ্যাঁ, আমার নাম কিশোর।

কিশোর! বাঃ, বেশ নামটি তোমার! তোমাকে সব চাইতে কে বেশী ভালবাসে কিশোর?

ভাল আমাকে কেউ বাসে না। আমি একা একা ঘরে শুয়ে থাকি। বড্ড ভয় করে আমার। সারারাত কারা যেন আমার বিছানার চারপাশে ঘোরে। তারা কেবলই আমাকে ডাকে। ওদের কাছে তো আমি যাব না-ওরা নিশ্চয়ই কাকার মত কেবল আমাকে বকবে। এই বড় বড় ছুরি তাদের হাতে, আমাকে নিশ্চয়ই তারা খুন করবে। তারাই, তারাই কাকাকে মেরে ফেলেছে। সেদিন আমার ঘরে তাদের একজন এসেছিল, সাদা ধবধবে পরীর মত পোশাক পরা। এমন সময় শুনলাম ডাঃ চক্রবর্তী যেন আমাকে ডাকছেন।

কবে দেখেছিলে তুমি?

কেন, যেদিন কাকা মারা যায়। সেই সাদা পরীদের একজন আমার ঘরেও আমাকে মারতে এসেছিল।

কখন?

বিকেলবেলা! আমি তখন ঘুমিয়ে আছি, আমার ঘরে এসে ঢুকেছিল।–আমি যাই। তারা। এখুনি হয়ত আবার এসে পড়বে। কিশোর এন্তে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।

বস বস, ভয় নেই। আমরা তো আছি।

না না, আমি প্রতিমাদির কাছে যাই, সে আমাকে বড্ড ভালবাসে। বলো না কিন্তু ওকথা কাউকে। প্রতিমাদি মানা করে দিয়েছে। না, আমি যাই। কিশোর একপ্রকার যেন দৌড়েই ঘর ছেড়ে চলে গেল।

কিরীটী একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস নিল।

***

এরপর ডাক পড়ল সমরবাবুর।

কিরীটী সমরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, আপনার নাম?

সমর রায়। আধুনিক কবি সমর রায়ের নাম শোনেননি?

দুর্ভাগ্য আমার, শুনিনি তো? তা সে যা হোক, আপনি এখানে মানে পুরীতে বেড়াতে এসেছেন?

হ্যাঁ।

গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন আপনি এই হোটেলেই ছিলেন?

ছিলাম।

আপনি ও সমীরবাবু সেদিন বিকেলে একসঙ্গে বেড়াতে বের হন?

তা হয়েছিলাম বোধ হয়।

বোধ হয় তো মানে?

কত লোকের সঙ্গেই তো কত সময় আমরা বেড়াতে বের হই, সব কি আর মনে থাকে, সেটা মনে করে রাখাই আমার কাজ?

এবার জবাব দিলেন দারোগাবাবু, মশাই, আপনাকে যা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তার ঠিক ঠিক জবাব দিন। আপনি সমীরবাবুর সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছিলেন কিনা?

হ্যাঁ।

কতক্ষণ সমীরবাবু আপনার সঙ্গে ছিলেন?

তা প্রায় আধ ঘণ্টাটাক হবে।

হুঁ, আপনি কখন হোটেলে ফিরে আসেন?

বারীনবাবু ও যতীনবাবুদের সঙ্গেই ফিরে আসি, তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে।

গগনেন্দ্রনাথকে যখন মৃত আবিষ্কার করা হয়, তার আগে কিছু জানতে পেরেছিলেন কি?

না। খাবার সময়ও যেমন তাকে বারান্দায় চেয়ারের উপরে একা চুপটি করে বসে থাকতে দেখেছিলাম, ফেরার সময় তেমনিই তাকে দূর থেকে বসে থাকতে দেখি।

বেড়িয়ে ফিরে এসে সাড়ে ছটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?

নিজের ঘরে।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন। বারীনবাবুকে একটিবার পাঠিয়ে দিন।

নমস্কার। সমর ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

প্রশান্ত সৌম্য চেহারার বারীনবাবু হাসতে হাসতে এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

কিরীটী সসম্ভ্রমে বারীনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, বসুন। আপনবার নামই বারীন…

আজ্ঞে আমার নাম বারীন্দ্র চৌধুরী।

আপনি এখানে বেড়াতে এসেছেন?

হ্যাঁ। চাকরি থেকে বিশ্রাম নেওয়া অবধি এইভাবে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

আপনি কোথায় চাকরি করতেন?

পাঞ্জাবে লুধিয়ানার এক কলেজে।

বহুকাল আপনি সেখানেই ছিলেন?

হ্যাঁ। প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছরেরও বেশী হবে।

বাংলাদেশে আপনি কতদিন ফিরেছেন?

তাও প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল বৈকি!

বাংলায় এসে কোথাও আপনি স্থায়ীভাবে নিশ্চয়ই বসবাস করেননি?

না, বসবাস করবার কোথাও স্থায়ীভাবে আর ইচ্ছা নেই, একা মানুষ, ঘুরে ঘুরে বেড়াতেই ভাল লাগে।

গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন আপনি কখন বেড়াতে বের হন?

আমি ও যতীনবাবু সোয়া চারটের সময় বেড়াতে বের হই।

আবার কখন ফিরে আসেন?

বোধ হয় সাড়ে পাঁচটার পর আমি, যতীনবাবু ও সমরবাবু ফিরে আসি।

বেড়াতে যাবার আগে আপনি হোটেলেই ছিলেন?

হ্যাঁ, আমার নিজের ঘরে। এখানে একটা কথা বললে বোধ হয় অন্যায় হবে না। বেলা তখন বোধ করি পৌনে চারটে কি চারটে হবে-ওদিককার বারান্দায় গগনবাবু যেখানে বসেছিলেন তারই কাছে একটা গোলমাল শুনি এবং দেখি একজন সাদা উর্দি পরা খানসামা ছুটে পালাচ্ছে কিশোরের ঘরের দিকে। গগনবাবু অত্যন্ত খিটখিটে প্রকৃতির লোক ছিলেন, চাকরবাকরদের প্রায়ই গালাগালি দিতেন। ওই রকমেরই কিছু হবে বলে আমার মনে হয় সেদিনকার ব্যাপারটাও।

আপনি ঠিক স্পষ্ট দেখেছিলেন সাদা উর্দি পরা ছিল লোকটার?

হ্যাঁ, স্পষ্ট দেখেছিলাম।

আপনি দেখছি রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করেন, চোখের অসুখ আছে নাকি কিছু?

না, চোখ আমার ভালই; তবে আলোটা তেমন সহ্য হয় না।

আচ্ছা বারীনবাবু, সেই খানসামাটাকে আপনি চিনতে পেরেছিলেন?

না, লোকটা দৌড়ে চলে গেল, তেমন চিনতে পারিনি।

ওঃ, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন, যতীনবাবুকে একটিবার পাঠিয়ে দেবেন কি?

নিশ্চয়ই। নমস্কার। বারীনবাবু চলে গেলেন।

***

আসুন যতীনবাবু, ওই চেয়ারটায় বসুন। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে যতীনবাবু বললেন, নিশ্চয়ই, করুন। আমার দ্বারা যদি আপনাদের তদন্তের কোন সাহায্য হয় আমি সর্বদাই তার জন্য প্রস্তুত আছি।

আচ্ছা সেদিন বিকেলে আপনি বারীনবাবুর সঙ্গে বেড়াতে যাবার আগে একটা কোন গোলমাল শুনেছিলেন?

হ্যাঁ, আমি তখন আমার ঘরে বসে বই পড়ছিলাম।

কাউকে আপনি দেখেছিলেন?

হ্যাঁ, একজন খানসামাকে দৌড়ে যেতে দেখেছিলাম।

আপনি তাকে চিনতে পেরেছিলেন?

না। তবে আমরা যখন বেড়াতে বের হচ্ছি, দূর থেকে দেখেছিলাম বিনতা দেবী গগনবাবুর সঙ্গে কি কথা বলছেন।

.

এরপরই প্রতিমা গাঙ্গুলী এলো।

আপনার নামই ডাঃ গাঙ্গুলী? বসুন। কিরীটী বললে।

প্রতিমা চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে বললে, হ্যাঁ।

আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই প্রতিমা দেবী।

বলুন?

ঐদিন আপনি কখন বেড়াতে বের হন?

বেলা প্রায় সোয়া তিনটে হবে।

বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রের ধারে সমীরবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল?

হ্যাঁ।

কী ধরনের কথাবার্তা আপনাদের হয়েছিল বলতে বাধা আছে কি?

তা একটু আছে। কেননা আমাদের দুজনের নিজস্ব সে-সব কথা। এ কেসের সঙ্গে কোন সম্পর্কই নেই।

আপনার সঙ্গে সমীরবাবুর কতদিনের আলাপ?

এখানে এসেই আলাপ হয়।

সমীরবাবু লোক কেমন বলে আপনার মনে হয়?

ভালই। প্রতিমার মুখখানা সহসা কেন না-জানি রাঙা হয়ে উঠল।

কিরীটী মনে মনে হাসতে হাসতে আবার প্রশ্ন করলে, ভালই মানে? আপনার তাকে ভাল লাগে, বলুন?

এ প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য কি, মিঃ রায়?

আচ্ছা কখন আপনি হোটেলে ফিরে আসেন?

সন্ধ্যা প্রায় ছটার সময়।

আপনি প্রথমে গগনেন্দ্রনাথের মৃতদেহ পরীক্ষা করে বলেন যে তিনি মারা গেছেন?

হ্যাঁ।

আচ্ছা আপনি যখন গগনেন্দ্রনাথের দেহ পরীক্ষা করেন, তার কতক্ষণ আগে তার মৃত্যু হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?

ঘণ্টাখানেক আগেই বলে মনে হয়েছিল।

তাহলে আপনার ডাক্তারী মতে গগনেন্দ্রনাথকে মৃত আবিষ্কৃত হবার এক ঘণ্টা আগে তার মৃত্যু হয়েছিল?

হ্যাঁ, তাই।

আপনারা, মানে আপনি, বারীনবাবু ও সমরবাবু একসঙ্গে বেড়িয়ে ফিরেছিলেন?

হ্যাঁ।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।

***

পরের দিন যতীনবাবু কিরীটীর ঘরে এসে বললেন, মিঃ রায়, আপনার সঙ্গে একটা বিশেষ কথা ছিল।

বলুন?

যতীনবাবু পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে কিরীটীর হাতে দিতে দিতে বললেন, এই সিরিঞ্জটা আমি গগনবাবু যেদিন মারা যান, সেদিন একজনকে ঘরের পিছনদিককার জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে দেখি। আগের দিন রাত্রে কয়েকটা বাজে কাগজের সঙ্গে আমার একটা জরুরী চিঠি বাড়ির পিছনদিকে ভুলে ফেলে দিয়েছিলাম, পরদিন সকালবেলা যখন সেটা খুঁজতে যাই, হঠাৎ সামনের দিকে আমার একটা জানালা খোলার শব্দে নজর পড়ায় দেখতে পাই, অধীরবাবু তার ঘরের পিছনদিককার জানালা থেকে এটা ফেলে দিলেন। তিনি আমাকে দেখতে পাননি কিন্তু আমি তাকে স্পষ্ট দেখেছিলাম, পরে কৌতূহল হতে গিয়ে দেখি একটা সিরিঞ্জ। কাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম এটা হয়ত আপনার কাজে লাগতে পারে, তাই এটা আপনাকে দিতে এসেছি।

আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ যতীনবাবু, একটা সন্দেহ আমার মিটল।

 ৪. আলোকের সন্ধানে

কিরীটীর বসবার ঘর।

রাত্রি তখন প্রায় পৌনে নটা হবে।

খাওয়াদাওয়া সকলের হয়ে গেছে, কিরীটী একটা খোলাখুলি আলোচনা করবার জন্য সকলকেই তার ঘরে আহ্বান করেছে। রণধীর, বিনতা দেবী, সমীর, অধীর, কিশোর, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী, ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী, বারীন চৌধুরী, যতীনবাবু, সমর রায় ও স্থানীয় থানাইনচার্জ অমরেন্দ্রবাবু।

***

কিরীটী বলছিল, ভদ্রমোহদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আজ রাত্রে আপনাদের এখানে কেন আমি ডেকে পাঠিয়েছি জানেন? একটা খোলাখুলি আলোচনা করবার জন্য। একটা কথা সর্বাগ্রে আপনাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত, ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর মতের সঙ্গে আমিও একমত। অর্থাৎ গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাকে খুন করা হয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং আমি তা প্রমাণ করব। কিন্তু করবার আগে আমি সকাতরে অনুনয় জানাচ্ছি, যদি আপনাদের মধ্যে কেউ কোন কথা গোপন করে থাকেন তবে আমাকে এখনও বলুন।

কিন্তু সকলেই স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল, কারও মুখে কোন কথা নেই।

বেশ তবে শুনুন, গম্ভীর স্বরে কিরীটী বলতে শুরু করল, প্রথম থেকে চিন্তা করে দেখতে গেলে, ডাঃ চক্রবর্তীর মতামতটা অবহেলা করলে চলবে না। তিনি তার মতটা চিন্তা করেই দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন এই হত্যাকাণ্ড দলবদ্ধভাবে হয়েছে, না কোন একজনের দ্বারাই হয়েছে। কথা হচ্ছে মানসিক উত্তেজনার ফলে কেউ কাউকে খুন করতে পারে কিনা? ডাঃ চক্রবর্তী, আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, আপনার এ বিষয়ে মতামত কি?

ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, হ্যাঁ, তা হতে পারে, অত্যন্ত মানসিক চিন্তা বা উত্তেজনার ফলে খুন করা কিছুই অসম্ভব নয়।

কিরীটী জবাব দিল, সেরকম মানসিক উত্তেজনা এঁদের সকলেরই ছিল। বহুদিন ধরে এঁরা প্রত্যেকে এদের জীবনের সঙ্গে অন্যের জীবনের তুলনামূলক পার্থক্যটা সব সময় রূঢ় ভাবেই দেখতেন। রণধীরবাবুর মনের অবস্থা যা ছিল, সমীরবাবুরও তাই। একটা মানসিক বিদ্রোহ তিল তিল করে বহুদিন ধরে নিরন্তর একটা মানসিক উত্তেজনার ফলে গড়ে উঠেছে। অধীরবাবুর মানসিক অবস্থাটাকে apathy বলা চলে, কিন্তু কিশোরের অবস্থা আপনার কি বলে মনে হয় ডাঃ চক্রবর্তী?

মানসিক অবস্থা তার ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডাঃ চক্রবর্তী বলতে লাগলেন, সে ইতিমধ্যে Schizophreniaর symptoms দেখতে শুরু করেছিল। তার জীবনের প্রতি রূঢ়তা ও নির্বিমুখতা তাকে নিরন্তর পীড়িত করছিল। এক কথায় যাকে suppression বলা চলে, তা থেকে সে ক্রমে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছিল। তার মন সব অদ্ভুত deluison বা স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করছিল। সে নিজেকে কখনো কখনো শত্রু ও ভয়ঙ্কর সব লোকেদের দ্বারা পরিবেষ্টিত দেখত। এটা বিশেষ চিন্তার কথা। কেননা এই ধরণের মনের অবস্থা থেকেই অনেক সময় খুন করবার একটা প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। এখানে suferer খুন করে খুন করবার জন্য নয়। নিজেকে অত্যাচার থেকে বাঁচাবার জন্য। ওদের মানসিক বিকারের দিক থেকে বিচার করে দেখতে গেলে এটা খুবই rational–স্বাভাবিক।

হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করলে, তবে কি তোমার মনে হয় ডাক্তার, কিশোরই তার কাকাকে খুন করেছে?

সকলেই উদগ্রীব হয়ে উঠল, প্রত্যেক ভাইয়ের মুখেই যেন একটা ভীতি-চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

কিন্তু আর একটা কথাও এই সঙ্গে ভাবতে হবে কিরীটী, যেভাবে সাজিয়ে খুন করা হয়েছে, ততখানি জ্ঞান বা মনের গঠনশক্তি কিশোরের ছিল কিনা সন্দেহ। অবশ্য এ ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্তেরা খুব সহজ ও সাধারণ ভাবেই খুন করে। ভেবেচিন্তে চাতুর্যের সঙ্গে করে না, যেটা এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। সে যদি খুন করত, তবে একটা spectacular ভাবেই খুন করত-যা এক্ষেত্রে হয়নি।

কিরীটী আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা খুন হবার পর, তোমার কি মনে হয় ডাক্তার, বাকি সবাই জানতে পেরেছিল?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ। আমার মনে হয় এঁরা জানতেন এবং সেটাই আমার মনে সর্বপ্রথম সন্দেহের উদ্রেক করে। এমন ধরনের একদল ভীতু লোক ইতিপূর্বে আমি দেখিনি। এদের দেখলেই মনে হয়, যেন এরা প্রত্যেকেই ইচ্ছা করে কিছু গোপন করে রেখেছেন।

তাই যদি হয়, কিরীটী জবাব দিল, তবে এঁদের মুখ দিয়েই বলিয়ে নেব আসল ব্যাপারটি কি?

ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, অসম্ভব। তা তুমি পারবে না।

না, অসম্ভব নয়। তুমি হয়ত জান না, সাধারণ কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই এঁদের মুখ দিয়ে আমি অনেক সত্য কথা ইতিপূর্বে বের করি নিয়েছি এবং বাকি সত্যটুকুও আজকের আলোচনার মধ্য দিয়ে বলিয়ে নেব। মোটামুটি ভাবে সাধারণত মানুষ সত্য কথাই বলতে চায় বা বলেও থাকে।

তার কারণ মিথ্যা কথা বলবার চাইতে সত্য কথাটা বলা অনেক সহজ। কেননা সত্য কথা বলতে ভাবতে হয় না বা চিত্ত করতে হয় না, আপনা থেকে যেন আপনিই বের হয়ে আসে। তুমি একটা মিথ্যা কথা বলতে পার, দুটো বা তিনটি বলতে পার, কিন্তু কেবলই অনবরত একটার পর একটা শুধু মিথ্যা কথাই বলে যেতে পার না। সেটা অসম্ভব।

সত্য একসময় তোমার অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবেই এবং তখুনি সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে এদের প্রশ্ন করে ও খোঁজ নিয়ে যতটুকু জেনেছি, তার থেকে মোটামুটি ভাবে কতকগুলো point খাড়া করেছি। যেমন :

১। গগনেন্দ্রনাথ তাঁর হার্টের ব্যারামের জন্য প্রত্যহ নিয়মিত ভাবে এমন একটা ঔষধ খাচ্ছিলেন, যার মধ্যে একটা ingredient হচ্ছে ডিজিট্যালি।

২। ডাঃ চক্রবর্তীর একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ তার মেডিকেল ব্যাগ থেকে খোয়া যায় সেদিন।

৩। গগনেন্দ্রনাথ তার ফ্যামিলির কাউকে বাইরের কোন তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে মিশতে দিতে একেবারেই পছন্দ করতেন না ও কোথাও বের হতে দিতেন না।

৪। কিন্তু ঐদিন বিকালে সকলকেই বাইরে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং হোটেলে তিনি একা ছিলেন।

৫। সমীরবাবু তার জবানবন্দিতে প্রথমে বলেছিলেন তিনি বেড়িয়ে যখন ফিরে আসেন তখন ঠিক সময় কত তা তিনি জানতেন না, কেননা তার ঘড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে বলেন, তিনি তাঁর কাকার হাতের রিস্টওয়াচ দেখে সময় ঠিক করে নেন।

৬। ডাঃ চক্রবর্তী ও কিশোর পাশাপাশি ঘরে থাকতেন।

৭। সাড়ে ছটার সময় চা খাবার জন্য যখন সকলে প্রস্তুত তখন সবাই খাবার ঘরে বসে, তবু একজন ভৃত্যকে গগনেন্দ্রনাথকে চা খেতে আসবার জন্য ডাকতে পাঠানো হয়েছিল।

৮। গগনেন্দ্রনাথ একদিন বলেছিলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না, মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি, সব আমার মনে আছে। সব মুখই আমার মনে আছে।

যদিচ আমি প্রশ্নগুলো, কিরীটী বলতে লাগল, আলাদা আলাদা ভাবে টুকেছি, তথাপি একসঙ্গে সব কটি point বিচার করা যায়। যেমন প্রথম দুটো পয়েন্ট, গগনেন্দ্রনাথ তার হৃদরোগের জন্য নিয়মিত ভাবে একটা ঔষধ পান করতেন, যার মধ্যে একটা ingredient ছিল ডিজিট্যালিন। ডাঃ চক্রবর্তীর একটু হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ খোয়া যায়। ঐ দুটো পয়েন্টই এই কেসে আমার মনকে সর্বপ্রথম সন্দেহাম্বিত করে তোলে। আমার আর এখন বলতে বাধা কিছুই নেই যে, এই দুটি প্রশ্ন আমার বিচারে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এবং অমিল বলে মনে হয়। বুঝতে পারছেন না আপনারা বোধ হয় আমি কি বলতে চাচ্ছি। শীঘ্রই সব আমি বুঝিয়ে দেব। শুধু এইটুকুই সকলে মনে রাখুন, উপরিউক্ত এই দুটি point আমার কাছে মনে হয়, যার মীমাংসা সর্বপ্রথম হওয়া প্রয়োজন এই কেসে। সকলেরই জবানবন্দি আমি নিয়েছি, এখন সেই জবানবন্দি থেকে যেটুকু তথ্য আপনাদের সকলের মুখ থেকে আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি সেই সম্পর্কেই আলোচনা করা আমাদের এই মিলনের মুখ্য উদ্দেশ্য।

কিরীটী একটুখানি থেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করলে, গোড়া থেকেই শুরু করছি। সর্বপ্রথম সমীরবাবুর কথাই বিচার করে দেখা যাক। তার পক্ষে তার কাকার জীবন নেওয়া সম্ভব ছিল কিনা? তিনি একদিন গভীর রাত্রে তার ভাই অধীরবাবুর সঙ্গে তাদের কাকার জীবন নেওয়ার সংকল্প করছিলেন আমি তা নিজের কানে শুনেছিলাম। আমি জানি সেসময় সমীরবাবু একটি ভয়ানক মানসিক উত্তেজনার মধ্যে ছিলেন। ঐ ব্যাপারের সময় তার মনে আরও একটা অন্য উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর সস্নেহ আকর্ষণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক, প্রতিমা দেবীর দিকে তার মন তখন ঝুঁকেছে। তার তখনকার মানসিক অবস্থায় তার পক্ষে যে-কোন কাজ করা আশ্চর্য নয়। তিনি তার বর্তমান জীবনের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে উঠেছিলেন। এবং সেই অবস্থায় তার কাকার সম্মোহন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শেষ উপায় বেছে নেওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক। অথবা যে কল্পনাটা তার একদা মানসিক উত্তেজনার মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছিল, সেটাকেও কার্যে পরিণত করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। ভাল কথা, কথাপ্রসঙ্গে আপনাদের ঐদিনকার ঐ সময়ের গতিবিধির একটা তালিকা তৈরী করেছি, সে সম্পর্কেও একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক।

১। সমীরবাবুরা সকলে ও সমরবাবু তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় হোটেল থেকে বেড়াতে বের হন।

২। তিনটে পনের মিনিটের সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ও ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী বেড়াতে বের হন।

৩। চারটে পনের মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু বেড়াতে যান।

৪। চারটে কুড়ি মিনিটের সময় ডাঃ চক্রবর্তী জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসেন।

৫। চারটে পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীরবাবু বেড়িয়ে হোটেলে ফিরে আসেন।

৬। চারটে চল্লিশ মিনিটের সময় তার স্ত্রী বিনতা দেবী ফিরে আসেন ও ফিরে তার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেন।

৭। চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী তাঁর স্বামীর ঘরে যান।

৮। পাঁচটা দশ মিনিটের সময় অধীরবাবু বেড়িয়ে ফিরে আসেন।

৯। পাঁচটা চল্লিশ মিনিটের সময় বারীনবাবু, যতীনবাবু ও সমরবাবু ফিরে আসেন।

১০। পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় সমীরবাবু ফিরে আসেন।

১১। ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে আসেন।

১২। ছটা তিরিশ মিনিটের সময় ভৃত্য গগনেন্দ্রনাথকে চা খেতে ডাকবার জন্য গিয়ে দেখে তিনি মৃত।

***

কিরীটী বলতে লাগল, উপরিউক্ত সময়ের তালিকা বিচার করলে দেখা যাচ্ছে তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় সমীরবাবু অন্য ভাইদের সঙ্গে হোটেল থেকে বেড়াতে বের হন। গগনবাবু তখন বেঁচে ছিলেন। বেড়াতে গিয়ে সমীরবাবু ও প্রতিমা গাঙ্গুলীর সঙ্গে কথাবার্তা হয়। প্রতিমা দেবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ একসময় তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে আসেন। তার কথামত পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় হোটলে এসে ঢোকেন। তিনি হোটেলে এসে তার কাকার সঙ্গে দেখা করেন ও কথাবার্তা বলেন; তারপর নিজের ঘরে চলে যান ও ছটার সময় সকলের সঙ্গে চা খেতে খাবার ঘরে আসেন। তিনি তার জবানবন্দিতে বলেছেন, পাচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময়ও নাকি তার কাকা বেঁচে ছিলেন। কিন্তু পরের একটা ব্যাপারে বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টই যে তার কথা ঠিক নয় বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সাড়ে ছটার সময় গগনবাবুকে চা পান করতে ডাকতে গিয়ে ভূত তাকে মৃত অবস্থায় পায়। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী নিজে একজন ডাক্তার। তিনি বলেছেন তার ডাক্তারী বিদ্যানুযায়ী গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু, যখন তাকে মৃত বলে আবিষ্কার করা হয়, তারও একঘণ্টা আগে ঘটেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে ডাঃ গাঙ্গুলী ও সমীরবাবুর কথা যদি সত্যি বলে মেনে নিই, তবে একজনের statement অন্যজনের statement-এর সঙ্গে আদপেই মিলছে না। Conflicting statements! যদি মেনে নিই যে ডাঃ গাঙ্গুলী ঠিক বুঝতে পারেননি….

সহসা এমন সময় কিরীটীকে বাধা দিয়ে প্রতিমা বলে উঠল, না মিঃ রায়, আমি আপনাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি ভুল আমার হয়নি। তাছাড়া অত সহজে আমি ভুল করি না।

কিরীটী বললে, বেশ, তাই যদি মেনে নিই, তবে এই ধরনের conflicting statement থেকে দুটো conclusion আমরা করতে পারি। হয় ডাক্তার গাঙ্গুলী অথবা সমীরবাবু দুজনের একজন ইচ্ছা করে মিথ্যা কথা বলছেন!

প্রতিমা কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বলতে লাগল, কিন্তু ধরে নিই যদি সমীরবাবুই এক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলছেন, দেখা যাক কেন তিনি মিথ্যা কথা বলছেন। তার এ ধরনের মিথ্যা বলবার গোপন উদ্দেশ্য আছে কিনা? ধরে নেওয়া গেল ডাঃ গাঙ্গুলীর কথাই সত্য, তার ভুল হয়নি বা তিনি ইচ্ছা করে মিথ্যা কথা বলছেন না, সমীরবাবু হোটেলে ফিরে এসে কাকার সঙ্গে যখন দেখা করেন, তার আগেই তার কাকা মারা গেছেন, অর্থাৎ তিনি গিয়ে তার কাকাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান এবং ধরে নিই, যদি সত্যি তাই হয়েই থাকে, তবে সেই অবস্থায় তাঁর পক্ষে তখন কি করা সম্ভব?

হয় তিনি ঘাবড়ে গিয়ে সাহায্যের জন্য সকলকে ডাকাডাকি শুরু করতে পারেন, অথবা ধীরভাবে তখুনি গিয়ে সকলকে ব্যাপারটা জানান কি হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি প্রথমে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যান। তারপর কোন কিছু ভেবে কাউকে ও বিষয়ে কোন কথা না বলাই শ্রেয় বিবেচনা করে নিঃশব্দে সে স্থান ত্যাগ করে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করেন। কী বলেন আপনি সমীরবাবু, তাই নয় কি?

সমীরবাবু বাধা দিয়ে বললেন, ব্যাপারটা তাহলে একেবারে হাস্যকর বা ছেলেমানুষির মত দাঁড়ায় না কি?

তাহলে বলতে হয়, কিরীটী বললে, ডাঃ গাঙ্গুলীই হঠাৎ ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসময় সম্বন্ধে ভুল করেছেন! কিন্তু তার আগে আমরা ভাবব, এ ধরনের ব্যবহার করা আপনার পক্ষে তখন সম্ভব ছিল কিনা। কেননা তাতে এও প্রমাণ হয় যে, আপনি নির্দোষ। কেননা আপনি যখন আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করতে যান, তিনি তখন মৃত। বেশ এখন ধরা যাক, তাই যদি ঘটে থাকে এবং সত্যিই সমীরবাবু নির্দোষ হন, তবে তার ঐদিনের ঐ অদ্ভুত ব্যবহারের একটা মীমাংসায় আমরা আসতে পারি কিনা? এর মীমাংসা সহজেই হয়, যদি তাকে নির্দোষ ধরে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তার সেই রাত্রের কথাগুলো, যা তিনি তার ভাইকে বলেছিলেন তাঁর কাকার সম্পর্কে সেটাও মনে রাখতে হবে আমাদের। তিনি হোটেলে ফিরে এসে কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যখন দেখলেন। তার কাকা মৃত, তার দোষী মন ও দোষী স্মৃতিতে সহজেই একটা সম্ভাবনা জেগে ওঠা স্বাভাবিক যে তাদের সেই রাত্রের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে-কিন্তু তার দ্বারা হয়নি। অর্থাৎ তিনি যখন সে পরিকল্পনাকে কার্যে পরিণত করেননি তখন নিশ্চয়ই তার সঙ্গী করেছে। ফলে প্রথমেই হয়ত তার ছোটভাই অধীরের কথা মনে পড়ল। কেননা তারা দুজনেই এ কল্পনা করেছিলেন।

সহসা এমন সময় সমীর উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, না না, কখনও না। একেবারে মিথ্যা কথা।

কিন্তু সমীরবাবুর প্রতিবন্ধকে কোনরূপ কান না দিয়েই কিরীটী বলে যেতে লাগল, বেশ তাই যদি হয়, তাহলে এখন দেখা যাক, অধীরবাবুর দ্বারা তার কাকাকে খুন করা সম্ভব কিনা? অধীরবাবুর বিরুদ্ধে প্রমাণ কি? তারও মানসিক অবস্থা তার মেজদা সমীরবাবুর মতই ছিল এবং দু ভাই কতকটা একই মনোবৃত্তির। কেননা তার সঙ্গেই সেরাত্রে সমীরবাবু তাদের কাকাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

অধীরবাবু পাঁচটা দশ মিনিটের সময় হোটেলে ফিরে আসেন। তিনিও বলেছেন তিনি ফিরে এসেই সোজা প্রথমে তার কাকার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তিনিও নাকি তার কাকার সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। অথচ সেই সময় কেউই তাকে তার কাকার সঙ্গে কথা বলতে দেখেননি। অর্থাৎ কেউ তার উক্তির সাক্ষী নেই। এক্ষেত্রে অধীরবাবুর চমৎকার একটা alibi আছে। কেউ তখন সেখানে ছিল না। বারীনবাবু, যতীনবাবু ও সমরবাবু বাইরে চলে গেছেন। ওঁদের সকলের movement–এর সময়তালিকা থেকেই তা প্রমাণিত হয়। তাই যদি হয় এবং তার ঐ alibi প্রমাণিত না হয়, তবে অধীরবাবুর পক্ষে এক্ষেত্রে তার কাকাকে খুন করা এতটুকুও অসম্ভব বা আশ্চর্যজনক নয়।

অধীর কিরীটীর দিকে সহসা চোখ তুলে চাইল। কী একটা করুণ মিনতি, কী দারুণ অবসন্নতায় ভরা তার দু-চোখের দৃষ্টি!

কিরীটী আবার বলতে লাগল, আরও একটা কথা, যেদিন গগনেন্দ্রবাবু খুন হন, তার পরদিন সকালে অধীরবাবুকে কেউ তার জানালা দিয়ে কোন একটা বস্তু বাড়ির পিছনের দিকে ফেলে দিতে দেখেছিলেন এবং সেটা হচ্ছে একটা হাইপোড়রমিক সিরিঞ্জ।

সহসা এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী বলে উঠল, কিন্তু আমিও পরদিন সকালে আমার হারিয়ে যাওয়া সিরিঞ্জটা আমার ঔষধের ব্যাগের উপরেই পাই।

কিরীটী বললে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি আপনার সিরিঞ্জটা পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু এটা আর একটা সিরিঞ্জ। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি অধীরবাবু?

অধীর জবাব দিলে, সেটা আমার নিজস্ব সিরিঞ্জ ছিল।

তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে, আপনিই সেদিন সকালে সে সিরিঞ্জটা জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কেন স্বীকার করব না?

সহসা এমন সময় বিনতা অধীরকে বাধা দিয়ে প্রবলভাবে বলে উঠল, অধীর, অধীর, এ তুমি কি বলছো ভাই! কিছুই তো আমি বুঝতে পারছি না।

বিস্মিত ও রাগান্বিত ভাবে অধীর তার বৌদির দিকে ফিরে তাকাল, এতে আশ্চর্য হবার বা না বুঝবার মত তো কিছুই নেই বৌদি। পুরাতন একটা সিরিঞ্জ আমার এক ডাক্তার বন্ধু আমাকে একসময় দিয়েছিল। সেটা সেদিন সকালে ফেলে দিয়েছি; কিন্তু আমি কাকাকে খুনও করিনি বা বিষও দিইনি।

এমন সময় প্রতিমা বলে উঠল, আমিই সিরিঞ্জটা কয়েক দিন আগে অধীরবাবুকে দিয়েছিলাম।

আশ্চর্য! সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সিরিঞ্জের ব্যাপারটা। তবু মনে হচ্ছে, কিরীটী বলতে লাগল, এর একটা মীমাংসাও যেন খুঁজে পাচ্ছি। দুটো সিরিঞ্জও পাওয়া যাচ্ছে। এবং তা থেকে দুটো ব্যাপার আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠছে। প্রথমটায় অধীরবাবুকে দোষী প্রমাণ করতে পারলে, হয়ত সমীরবাবুর নির্দোষিতা প্রমাণ হয়ে যায়, কিন্তু সব দিক ভাল করে দেখেশুনে আমাদের সুবিচারই করতে হবে। দেখা যাক, অধীরবাবু যদি নির্দোষ হন, তবে কিভাবে ব্যাপারটা ঘটতে পারে। তিনি হোটেলে ফিরে এলেন। তিনি তার কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন তিনি মৃত (?), তার তখন মনে হতে পারে যে হয়ত তার মেজদাই কাকাকে খুন করেছেন। কেননা তাঁরা দুজন মাত্র কয়েকদিন আগে এক রাত্রে তাদের কাকাকে এ পৃথিবী থেকে সরাবার কল্পনা করেছিলেন। ফলে ঐ কথাটা সহসা মনে উদয় হওয়ায় হয়ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কী করবেন, কী ঐ সময় করা উচিত—এই সব নানা সাত-পাঁচ ভেবে হয়ত শেষে তিনি ঐ সময় কোন কিছু না প্রকাশ করাই সব দিক থেকে বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করে সরে পড়েন এবং এর কিছুক্ষণ বাদে সমীরবাবু ফিরে এসে কাকার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যখন জানতে পারলেন যে তার কাকা মৃত তখন তিনিও ঐ এক কারণেই কিছু প্রকাশ না করে চুপ করে সরে পড়লেন। এদিকে হয়ত অধীরবাবু ঘরে ঢুকেই তার ঘরে সিরিঞ্জটা দেখতে পান এবং সাত-পাঁচ ভেবে সেটা সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে ফেলেন। পরের দিন সকালে সেটা বাড়ির পিছনদিকে ফেলে দেন। কেননা হয়ত তার সন্দেহ হয়েছিল, তার মেজদাই এ সিরিঞ্জ দিয়ে কাকাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছেন।

এ ছাড়াও আর একটা দিক দিয়ে মনে হয় অধীরবাবু নির্দোষ। তিনি আমাকে তার একটু আগে দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন যে তিনি দোষী নন। কিন্তু এমন কথা বলেননি যে তারা দোষী নন, কেননা তার মনে মেজদার প্রতি দৃঢ় সন্দেহ ছিল। কিন্তু আমার কানে ঐ তিনি ও তারার পার্থক্যটা এড়ায়নি। এর থেকেই হয়ত অধীরবাবুর নির্দোষিতা প্রমাণ হতে পারে।

ঘরের প্রত্যেকটি প্রাণীই যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত কিরীটীর কথা শুনছে। কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।

কিরীটী একটুখানি থেমে একটা নতুন সিগারেট ধরিয়ে মৃদু একটা টান দিল ও একগাল ধোঁয়া ছেড়ে আবার বলতে শুরু করল, আচ্ছা, এবারে সমীরবাবু নির্দোষ কিনা এইভাবে বিচার করে দেখা যাক। ধরা যাক, অধীরবাবুর কথাই সত্যি। গগনেন্দ্রনাথ পাঁচটা ত্রিশ মিনিটের সময় বেঁচেই ছিলেন। তাই যদি হয়, তবে কি ভাবে সমীরবাবু দোষী হতে পারেন? আমরা ধরে নিতে পারি, পাঁচটা পঞ্চান্ন মিনিটের সময় যখন তিনি বেড়িয়ে হোটেলে ফিরে আসেন, যখন তার কাকার সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন, সেই সময় তাকে তিনি খুন করেন। সে-সময় আশেপাশে লোক ছিল বটে, কিন্তু শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সেই স্বল্পালোকে অন্যের অজান্তে তার পক্ষে তার কাকাকে খুন করাটা এমন কিছু কষ্টসাধ্য বা আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। কিন্তু তাহলে ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর কথা মিথ্যে হয়ে যায় যে, তার মতে গগনেন্দ্রনাথের দেহ পরীক্ষা করবার অন্তত এক ঘণ্টা আগে মৃত্যু হয়েছে।

প্রতিমা দেবী বাধা দিয়ে বলে উঠল, আমার ধারণা নির্ভুল।

কিরীটী বলতে লাগল, আরও একটা সম্ভাবনা এক্ষেত্রে আছে। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী সমীরবাবুর ফিরবার কিছু পরেই হোটেলে ফিরে আসেন। যদি সমীরবাবুর কথামত সে-সময় তার কাকা বেঁচেই থেকে থাকেন, তাহলে আমাদের ধরতে হবে ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীই নিশ্চয়ই গগনবাবুকে খুন করেছেন। তিনি জানতেন গগনবাবু অসুস্থ। মানসিক বিকৃতি তার ঘটেছে। সমাজেরও বিশেষ করে এদের family-র পক্ষে তিনি মূর্তিমান অমঙ্গল ও অশান্তি। এবং সেই সঙ্গে এই অত্যাচারিতদের দেখে এঁদের জন্যে তার মনে একটা অনুকম্পাও জেগেছিল। হয়ত সেই কারণেই এঁদের বাঁচাতে নিজ হাতে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছেন।

সহসা ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী বাধা দিয়ে বলে উঠল, না, আমি খুন করিনি।

কিন্তু মনে পড়ে কি প্রতিমা দেবী, আপনি একদিন ডাঃ চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ঐ শয়তান বুড়োকে খুন করা উচিত। ঐ শয়তানকে খুন করতে পারলে এখন হয়ত ওদের বাঁচবার আশা আছে…..দশজনের মঙ্গলের কাছে একজনের মৃত্যু সে তো বড় বেশী কথা নয়…

প্রতিমা বললে, হ্যাঁ, এ কথা একদিন কথায় কথায় ডাঃ চক্রবর্তীকে বলেছিলাম বটে, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি, সেই শয়তান দুর্দান্ত অত্যাচারী বিকৃতমস্কি লোকটাকে যতই আমি ঘৃণা করি না কেন, তাকে সত্যি সত্যি খুন করব এমন কথা স্বপ্নেও আমি কোনদিন ভাবিনি। না, তাকে খুন করা দূরে থাক, তাকে মরবার পর ছাড়া স্পর্শ পর্যন্ত করিনি।

কিরীটী গম্ভীরভাবে বললে, তাহলে বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হয় ডাক্তার যে, আপনি না হয় সমীরবাবু আপনাদের মধ্যে একজন নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলছেন!

এবারে সমীর সহসা চিৎকার করে বলে উঠল, আপনারই জিত হল মিঃ রায়। সত্যিই আমি মিথ্যা কথা বলেছি। আমি যখন বেড়িয়ে ফিরে কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন তিনি মৃত। আমি অত্যন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই ঘটনার আকস্মিকতায়। কী করব প্রথমটা বুঝে উঠতে পারি না, সব গোলমাল হয়ে যায়। আমি তাঁকে বলতে যাচ্ছিলাম, তার নাগপাশের অধীনে আর আমি থাকব না। আমি চলে যাব। আজ থেকে আর আমি এ বাড়িতে থাকব না। আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন। রাস্তায় রাস্তায় আমি ভিক্ষা করে খাব তবু তোমার মত শয়তানের কৃপাপ্রার্থী হয়ে এ কয়েদখানায় আর আমি বাঁচতে চাই না। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তখন তিনি মৃত, তাঁর শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা প্রাণহীন। আমার মনে ঠিক সেই কথাটাই জেগেছিল, যা একটু আগে আপনি অধীর সম্পর্কে বলেছিলেন, যে অধীর হয়ত শেষে কাকাকে খুন করেছে এবং আমি কাকার ডান হাতের উপরে একবিন্দু রক্ত দেখেছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল যে তাকে কোন কিছু ইনজেকশন করা হয়েছে।

কিরীটী সহসা বলে উঠল, এই একটা পয়েন্ট যাতে আমি স্থিরনিশ্চিত হতে পারিনি যে, কীভাবে আপনি আপনার কাকার প্রাণ নেবার সংকল্প করেছিলেন। তবে একটু ধারণা করেছিলাম যে, আপনার কল্পনার সঙ্গে সিরিঞ্জের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমাকে যদি বিশ্বাস করেন তবে বাকিটা বলুন।

সবই বলব মিঃ রায়, একটা ইংরাজী বইতে পড়েছিলাম, একজন একজনকে ইনজেকশন করে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছিল। সেই থেকেই ঐভাবেই খুন করবার একটা দুষ্ট চিন্তু সর্বদা আমার মাথায় ঘুরত।

এখন বোঝা যাচ্ছে, ঐজন্যই আপনি শেষ পর্যন্ত একটা সিরিঞ্জ কিনেছিলেন।

না, কিনিনি, বৌদির বাক্স থেকে সেটা চুরি করে নিয়েছিলাম।

সহসা বিনতা দেবী যেন লজ্জায় লাল হয়ে উঠে বললে, কিন্তু আমি-আমি সে কথা জানতাম না।

কিরীটী বললে, এতক্ষণে দুটো সিরিঞ্জের রহস্য উদঘাটিত হল। যেটা বিনতা দেবীর ছিল, সমীরবাবু সেটা চুরি করলেন। পরে অধীরবাবু সমীরবাবুর ঘরে সেটা পেয়ে সন্দেহবশে মেজদাকে বাঁচাবার জন্য বাড়ির পিছনে ফেলে দিলেন। বেশ, তাহলে আবার আমাদের সময়তালিকাটি পুনর্বিচার করে দেখা যাক।

তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় সমীরবাবু, সমরবাবু ও রণধীরবাবু সব বেড়াতে বের হন।

তিনটে পনের মিনিটের সময় ডাঃ চক্রবর্তী ও ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী বেড়াতে বের হন।

চারটে পনের মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু বেরিয়ে যান।

চারটে কুড়ি মিনিটের সময় জুরে কাঁপতে কাঁপতে ডাঃ চক্রবর্তী ফিরে আসেন।

চারটে পয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীরবাবু ফিরে আসেন।

চারটে চল্লিশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী ফিরে এসে গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তার সঙ্গে কথা বলে স্বামীর ঘরে যান প্রায় চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময়।

পাঁচটা দশ মিনিটের সময় অধীরবাবু ফিরে আসেন।

পাঁচটা চল্লিশ মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু ফিরে আসেন।

পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় সমীরবাবু ফিরে আসেন।

ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে আসেন।

ছটা তিরিশ মিনিটের সময় গগনেন্দ্রনাথ মৃত আবিষ্কৃত হন।

এই সময় তালিকা সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী যখন ফিরে এসে তার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে রণধীরবাবুর ঘরে চলে যান ও পাঁচটা দশ মিনিটের সময় যখন অধীরবাবু ফিরে আসেন—এই যে কুড়ি মিনিট সময় তার মধ্যে (অধীরবাবুর কথা যদি সত্যি বলে মেনে নিই) গগনেন্দ্রনাথ খুন হয়েছেন।

এখন কথা হচ্ছে, ঐ কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যে কে তাকে খুন করতে পারে! ঐ সময় ডাঃ গাঙ্গুলী ও সমীরবাবু দুজনে এক জায়গায় ছিলেন। যতীনবাবুর (যাঁর গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার মত কোন সঙ্গত কারণই থাকতে পারে না) একটা alibi আছে বটে, তিনি, বারীনবাবু ও সমরবাবু একসঙ্গে ছিলেন। রণধীরবাবু ও তার স্ত্রী বিনতা দেবী পাশের ঘরেই ছিলেন; ঐ সময়ে ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী তার ঘরে একা একা শুয়ে জ্বরে গোঙাচ্ছেন। হোটেলে নীচের তলায় আর কেউই প্রায় ছিল না। ঐ সময় কারো কাউকে খুন করবার অপূর্ব সুযোেগ হতে পারে। এমন কি কেউ হোটেলের নীচের তলায় ঐ সময় ছিল যে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করতে পারে? বলতে বলতে কিরীটী আড়চোখে একটিবার অদূরে উপবিষ্ট কিশোরের দিকে তাকাল। তারপর আবার বলতে লাগল, একজন সে-সময় সেখানে ছিল—সে হচ্ছে কিশোর। কিশোর সেদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আগাগোড়া হোটেলে নিজের ঘরেই ছিল। হোটেলের বাইরে যায়নি।

এ কথাও ঠিক যে বেলা তিনটে থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত কিশোর তার নিজের ঘরে ছিল না। তার প্রমাণ পেয়েছি। কিশোর তার জবানবন্দিতে একটা বিশেষ কথা বলেছিল। ডাঃ চক্রবর্তী নাকি জ্বরের ঘোরে তার নাম ধরে ডাকছিলেন। কিন্তু কিশোর যে ঘরে থাকে সেখান থেকে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘর দূরে, জ্বরের ঘোরে সেখান থেকে ডাকলেও সে ডাক শোনা যেতে পারে না। তাছাড়া ডাঃ চক্রবর্তীও জ্বরের ঘোরে কিশোরকে নাকি স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আসলে ডাক্তারের সেটা স্বপ্ন নয়, কিশোরকে সশরীরেই তার ঘরে সেদিন দেখেছিলেন তার শয্যার পাশে। তিনি মনে করেছিলেন, ওটা তার স্বপ্ন বা জুরবিকার। আসলে সত্যি সত্যি কিশোর সে-সময় ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে গিয়েছিল। এমনও তো হতে পারে, কিশোর সেই সময় তার কাকাকে খুন করে ডাক্তারের ঘরে সিরিঞ্জটা রাখতে গিয়েছিল।

কিশোর মুখ তুলে কিরীটীর দিকে তাকাল। তার মাথার তৈলহীন রুক্ষ এলোমেলো চুলগুলি মুখের চারপাশে ও ঘাড়ের উপর এসে ঝাপিয়ে পড়েছে। বড় বড় সুন্দর টানা টানা দুটি চক্ষু। সে চোখের দৃষ্টিতে কোন ভাব নেই। যেন সহজ অসহায় উদাস ব্যথায় ক্লান্ত, অশ্রুআবিল।

এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী বলে উঠল, আশ্চর্য!

কিন্তু মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়ে এটা কি একেবাবেই অসম্ভব ডাঃ চক্রবর্তী? কিরীটী প্রশ্ন করলে।

কিন্তু তাদের বাধা দিয়ে বিনতা দেবী যেন একপ্রকার চিৎকার করেই বললে, না না, এ অসম্ভব! এ অসম্ভব! এ হতে পারে না!

কেন হতে পারে না বিনতা দেবী?

তীক্ষ্ম ধারাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটী বিনতা দেবীর দিকে তাকাল। সাপের দৃষ্টির মত সম্মোহন সে দৃষ্টিতে, যেন অন্তর্ভেদী ধারাল তীক্ষ্ণ আলোর রশ্মির মত অনুসন্ধানী। বিনতার অন্তস্তল পর্যন্ত ভেদ করছে। বিনতা বললে, হ্যাঁ, অসম্ভব। এ শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, এ আপনার বাতুলতা।

কিশোর চেয়ারটার উপরে একটু নড়েচড়ে বসল। তার ভাবলেশহীন পাথরের মত খোদাই করা মুখের উপরে যেন সহসা একটা চাপা কৌতূহলের আভা ফুরিত হচ্ছে।

কিরীটী একবার মাত্র তীব্র দৃষ্টিতে বিনতা দেবীর দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল, আপনি একজন সত্যিকারের বুদ্ধিমতী মহিলা বিনতা দেবী। আপনারবুদ্ধির প্রশংসা কিরীটী রায়ও করছে।

আপনি কি বলতে চান, মিঃ রায়? তীক্ষ্ম স্বরে বিনতা দেবী প্রশ্ন করল।

আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাই বিনতা দেবী যে, এতক্ষণে সত্যিই আমি বুঝতে পেরেছি তীক্ষ্ণ ধারাল বুদ্ধির একটা চমৎকার মুখোশ আসল সত্যিকারের রূপটাকে ঢেকে রেখেছে। সত্যিই আপনি প্রশংসার যোগ্য। বাংলাদেশের সাধারণ ঘরোয়া মেয়েদের মধ্যে এতখানি বুদ্ধির প্রখ্য ইতিপূর্বে আমার চোখে আর পড়েছে কিনা বলতে পারি না।

কুণ্ঠায় ও লজ্জায় বিনতা দেবীর দৃষ্টি নত হয়ে এল। কিরীটী বলতে লাগল, লজ্জিত হবেন না মিসেস মল্লিক। তোষামোদ বা চাটুকার্য আমার পেশা নয়। এ বাড়ির অদ্ভুত জীবনধারার সঙ্গে আপনি আপনার নিজস্ব গড়ে-ওঠা জীবনধারাকে অতি কৌশলের সঙ্গে যেন খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। বাইরে আপনি আপনার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করতেন, তাঁর মতেই মত দিয়ে চলতেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আপনি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়েই ঘৃণা করতেন, তার সমগ্র কাজ ও ব্যবহারকে অন্যায় অবিচার বলে অবজ্ঞা করতেন। কিছুদিন থেকে আপনি ভাবছিলেন এবং আপনার স্বামীকে নিয়ে এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যাবার জন্য উত্তেজিত করছিলেন। আপনি ভেবেছিলেন তা যদি পারেন তবেই নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে তিল তিল করে যে নাগপাশের বন্ধনে আপনার স্বামী বাঁধা পড়েছিলেন, তার প্রভাবকে অস্বীকার করবার মত মনের শক্তি আর আপনার স্বামীর ছিল না।

অনেক চেষ্টাতেও যখন আপনি আপনার স্বামীকে আপনার মতে আনতে সক্ষম হলেন, তখন অতি অদ্ভুত উপায়ে আপনার স্বামীর ঘুমিয়ে পড়া মনকে জাগিয়ে তুলবার জন্য আঘাত হানবার কল্পনা করলেন। তাকে ভয় দেখালেন, আপনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জন করবেন। আপনি সত্যিই আপনার স্বামীকে ভালবাসেন। এটা আপনার স্বামীকে মাত্র ভয় দেখানোর উপায় ভেবেছিলেন, একথা শুনলে যদি আপনার স্বামী। শেষ পর্যন্ত ফিরে দাঁড়ান। এবং হয়েছিলও তাই। আপনার কথায় সত্যি এতদিন পরে। রণধীরবাবুর ঘুমিয়ে পড়া পৌরুষের গোড়ায় আঘাত লাগল। এতদিনকার কাকুতিমিনতি যা করতে পারেনি, এক কথায় সেটা সম্ভব হল। এমনিই হয়। কখন কী সামান্য ঘটনা হতে যে মানুষের মনের মূলটা পর্যন্ত নড়ে ওঠে, চিরদিনকার যুক্তি শিথিল হয়ে আসে, কেউ তা বলতে পারে না। রণধীরবাবুর মনের গোড়াতেও ঝড় উঠল। তিনি হয়ত ভাবলেন, যার জন্য এত দুঃখ, এত কষ্ট, তাকে শেষ করে ফেলতে পারলেই সব আপদের শান্তি হয়, তাই হয়ত তিনি শেষ পর্যন্ত…

বিনতা প্রবল ভাবে বাধা দিল, না, না, এ আপনার ভুল কিরীটীবাবু। আপনি ভেবেছেন। আমার স্বামীকে আমি সেদিন ঐ কথা বলবার পর আমার স্বামী খুব রেগে বা চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু আসলে তা তিনি হননি। তাছাড়া আমি সেদিন বিকেলে বেড়িয়ে ফিরে আমার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করে সোজা আমার স্বামীর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করি, এবং চা খেতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা দুজনে সে ঘরে বসে গল্প করেছি। তার মৃত্যুর জন্য আমি হয়ত বা দায়ী হতে পারি, অর্থাৎ আমার শ্বশুরকে আমার মনের অভিসন্ধির কথা বলে তার দুর্বল শরীরে আঘাত দিতে পারি, হয়ত সে আঘাতের ফলে তার হঠাৎ মৃত্যু হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়, এবং সত্যি যদি হয়ে থাকে, তাহলেও আমার বিরুদ্ধে আপনার কোন প্রমাণই নেই মিঃ রায়।

কিরীটী গম্ভীর স্বরে বললে, আছে বৈকি। আমার সময়-তালিকাটার বারো নম্বর পয়েন্টটা বিবেচনা করে দেখুন। সাড়ে ছটার সময় যখন চা খেতে সকলে খাবার ঘরে গেছেন, গগনেন্দ্রনাথকে চা পান করতে ডাকবার জন্য ভৃত্যকে তার কাছ পাঠানো হয়েছিল।

সমীর বললে, আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না মিঃ রায়!

অধীরও সঙ্গে সঙ্গে বললে, আমিও বুঝলাম না।

কিরীটী জবাব দিলে, ও বুঝতে পারছেন না, না? গগনেন্দ্রনাথকে ডাকতে একজন ভৃত্যকে পাঠানো হয়েছিল কেন? চিরদিন আপনার ভাইরা একজনের মধ্যে যে কেউ বা বিনতা দেবীই তাকে চা পান করবার বা খাবার সময় ডাকতে যেতেন। কেননা সেটাই আপনাদের কাকা বেশী পছন্দ করতেন। কাকাকে ডাকতে যাওয়া আপনারা আপনাদের একটা কর্তব্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে ইদানীং সর্বদাই আপনাদের মধ্যে একজন

একজন তার কাছে কাছে থাকতেন। সমীরবাবু ও বিনতা দেবী দুজনেই তাদের জবানবন্দীতে একথা স্বীকার করেছেন। তাই যদি হয়, তবে সেদিন সন্ধ্যায় চা পান করবার জন্য আপনাদের মধ্যে কেউ একজন তাকে না ডাকতে গিয়ে ভৃত্যকে পাঠানো হয়েছিল কেন? এ বাড়ির প্রচলিত নিয়মের কেন ব্যতিক্রম হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায়?

কেউ আপনারা ডাকতে যাননি, কেননা ঘটনার আকস্মিকতায় আপনারা সকলেই তখন বিমূঢ় ও বিবশ হয়ে গিয়েছিলেন। কী করা উচিত না উচিত এ প্রশ্নটাই আপনাদের প্রত্যেককে তখন বিচলিত করে তুলছিল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মনে আপনারা ভাবছিলেন, কেন আপনাদের মধ্যে একজন কাকাকে ডাকতে যাচ্ছে না। তার কারণ একটা ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদের জন্য মনে মনে আপনারা প্রত্যেকেই তখন অবশভাবে অপেক্ষা করছিলেন।

বিনতা দেবী জবাব দিলেন, না, তা হয়। আমরা প্রত্যেকেই সেদিন ক্লান্ত ও অবসন্ন। অবশ্য স্বীকার করি আমাদেরই একজনের কাউকে ডাকতে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু যেহেতু আমাদের মধ্যে কেউ যায়নি বলেই যে আমাদের মধ্যে কেউ দোষী এ যুক্তিটা ছেলেমানুষের যুক্তির মত হল না?

কিরীটী বললে, হয়ত বা তাই। কিন্তু বিনতা দেবী, আপনি বা সমীরবাবুই বেশীরভাগ সময় ও কাজটা করতেন, সেকথা দুজনেই তো আপনারা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেদিন রাত্রে ইচ্ছা করেই আপনি তাকে ডাকতে যাননি। কিন্তু কেন আপনি যাননি জানেন? কিরীটীর স্বর সহসা যেন ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ ও ধারাল হয়ে উঠল, তার কারণ আপনি তখন জানতেন যে আপনার শশুর মৃত। হ্যাঁ, আপনি জানতেন। গভীর উত্তেজনায় কিরীটীর গলার স্বর কাঁপতে লাগল।

বিনতা দেবী প্রত্যুত্তরে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী তার কথায় ক্ষেপমাত্র করে বলতে লাগল, না না, আমি আপনার কোন কথা বা কোন যুক্তিই মানতে চাই না। শুনুন মিসেস মল্লিক, আমি—যা আমি কিরীটী রায় বলছি, আমাকে চেনবার ও জানবার অবকাশ হয়ত আপনার হয়নি, তাহলে এভাবে নিজেকে লুকোবার এই হাস্যকর প্রয়াস নিশ্চয়ই করতেন না।

স্বীকার করি আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা এবং অনেকের চাইতে ঢের বেশী বুদ্ধি রাখেন। কিন্তু তবু আমার চোখে ধূলো দেবার মত ক্ষমতা আপনার নেই। অবিশ্যি এটা ঠিকই যে বেড়িয়ে ফিরে এসে যে সময় আপনি গগনবাবুর সঙ্গে দেখা করেন, সে সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু হোটেলেই ছিলেন এবং তারা আপনাকে গগনবাবুর সঙ্গে কথা বলতেও দেখেছেন। তারা শুধু দূর থেকে আপনাকে গগনবাবুর সঙ্গে কথা বলতেই দেখেছিলেন, কিন্তু কী কথা যে আপনি বলছিলেন তা তারা শুনতে পাননি। কেননা এত দূর থেকে সেটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আসলে সে-সময় আপনি যে সেখানে কী করছিলেন তার কোন প্রমাণই আমাদের হাতে নেই। তবু এ বিষয়ে আমার একটা theory আছে বা কল্পনা করেছি।

আগেই বলেছি আপনার বুদ্ধি আছে। খুব তাড়াতাড়ি যদি আপনি যে কোন ভাবেই হোক আপনার খুড়শ্বশুরকে এ সংসার থেকে সরাবার ইচ্ছা করতেন তবে সেটা সহজেই এবং অনেকদিন আগেই করতে পারতেন। একটুখানি বুদ্ধি আর তার সঙ্গে একটুখানি সুযোগের যোগাযোগ। কিন্তু তাড়াতাড়ি কাজটা না শেষ করে হয়ত বিশেষ একটা সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। আপনি হয়ত সকালবেলা কোন এক সুযোগে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে ঢুকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা ও সিরিঞ্জটা চুরি করে এনেছিলেন। কাউকে খুন করবার মত ঔষধ বেছে নেওয়া আপনার পক্ষে বিশেষ কষ্টকর ছিল না। কেননা নার্সিং আপনি কিছুদিন শিক্ষা করেছিলেন। ডাক্তারী ঔষধপত্র সম্পর্কে বেশ কিছু জ্ঞান আপনার আছে। আপনি ইচ্ছা করেই ডাক্তারী ব্যাগ থেকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা বেছে নেন, ঠিক যে ধরণের ঔষধ আপনার শ্বশুর খেতেন। আপনি সিরিঞ্জে ঐ ঔষধ ভরে রাখেন ও উত্তেজনার বশে গগনেন্দ্রনাথের শরীরে প্রয়োগ করে তাকে খুন করেন। কিন্তু কাজ হাসিল হয়ে যাবার পর সিরিঞ্জটা আর ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে রাখবার সুযোগ পাননি, কেননা সেই সময় ডাঃ চক্রবর্তী তার ঘরে শুয়ে জ্বরের ঘোরে কাপছিলেন।

আগে থাকতেই সব আপনি planকরে রেখেছিলেন। দূর থেকে বারীনবাবু ও যতীনবাবু গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে দেখেছেন মাত্র। আপনি অনায়াসেই গগনেন্দ্রনাথের হাতে ইনজেকশন করে বিষপ্রয়োগ করেছিলেন। বুড়ো রোগগ্রস্ত মানুষ, বাধা দেবার বা চিৎকার করবারও সুযোগ পাননি হয়ত এবং বিষপ্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটেছিল। কাজ শেষ করে আবার হয়ত কথা বলবার ভান করে বা অভিনয় করে আবার তাঁর পাশে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান। দূর থেকে যতীনবাবু ও বারীনবাবু সে সময় আপনাকে দেখতে পান। তারা ভেবেছেন আপনি তার সঙ্গে কথা বলছেন, খুবই এটা স্বাভাবিক। কে আপনাকে এক্ষেত্রে সন্দেহ করতে পারে বলুন! তারপর আপনি সেখান থেকে ফিরে আপনার স্বামীর ঘরে ঢুকে বাকি সময়টা তার সঙ্গেই কথাবার্তা বলে কাটান, সেখান থেকে আর অন্য কোথাও যাননি।

কাজ হাসিল হয়ে গিয়েছিল, কোথাও আর যাবার তো দরকার ছিল না। আপনি জানতেন, কেউ আপনাকে সন্দেহ করতে পারবে না। বহুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন সকলেই ভাববেন তিনি হঠাৎ হার্টফেল করেই মারা গেছেন। সবই ঠিক ছিল বিনতা দেবী, কিন্তু সামান্য একটা কারণের জন্য আপনার সমগ্র plan ভেস্তে গেল। আপনি কাজ হাসিল করবার পর সিরিঞ্জটা আর আগের জায়গায় রেখে আসবার সুযোগ বা সুবিধা পাননি। কেননা ডাঃ চক্রবর্তী তখন তার ঘরে ছিলেন। যদিও আপনি জানতেন না যে, ডাক্তার ইতিপূর্বেই তার সিরিঞ্জটা যে খোয়া গেছে তা জানতে পেরেছিলেন। বিনতা দেবী, এই একটিমাত্র গলদেই সব ভেস্তে গেল। নচেৎ চমৎকার একটি perfect crime হয়েছিল।

সহসা যেন ঘরের মধ্যে একটা বজ্রপাত হয়েছে। স্তম্ভিত হতবাক হয়ে সবাই বসে রইল, কারও মুখে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নেই।

শ্মশানের মতই একটা জমাট স্তব্ধতা যেন সমগ্র ঘরখানির মধ্যে থমথম করছে।

সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে বিস্ময়ে আতঙ্কে ও ঘটনার আকস্মিকতায়।

এমন সময় রণধীর উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে এবং প্রতিবাদের সুরে বললে, না না, এ একেবারে মিথ্যে কথা। ও নির্দোষ, সম্পূর্ণ নির্দোষ। ও কিছুই করেনি। আমার কাকা তার আগেই মারা গিয়েছিলেন।

কিরীটী চোখ দুটো সহসা যেন অস্বাভাবিক এক উজ্জ্বলতায় ঝকঝক করে উঠল, মৃদুস্বরে সে বলল, আঃ। তাহলে শেষ পর্যন্ত আপনিই গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছিলেন, বলুন?

আবার মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা।

রণধীর ততক্ষণে চেয়ারের উপরে আবার থপ করে বসে পড়েছে। গভীর উত্তেজনায় তখনও তার সর্বশরীর কাঁপছে। ক্লান্তক্লিষ্ট স্বরে কোনমতে শুধু উচ্চারণ করলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ,–আমিই তাকে খুন করেছি।

কিরীটী প্রশ্ন করলে, আপনিই তাহলে ডাঃ চক্রবর্তীর ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ ও ডিজিট্যালিনের শিশিটা চুরি করেছিলেন?

হ্যাঁ।

কখন?

একটু আগে আপনিই তো তা বললেন মিঃ রায়!

কেন আপনি তাকে খুন করলেন?

সে কথা আমাকে আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন কি মিঃ রায়?

হ্যাঁ, আমি জিজ্ঞাসাই করছি। বলুন? জবাব দিন?

জানেন তো আমার মনের অবস্থা তখন কী রকম হয়েছিল। কিন্তু কেন, কেন আমাকে আপনি এ প্রশ্ন করছেন মিঃ রায়? রণধীরের কণ্ঠ থেকে যেন একটা প্রবল বিরক্তির ঝাজ ঝরে পড়ল, কী হবে আপনার এসব শুনে?

কিরীটী বললে, অনেক কিছুই হবে রণধীরবাবু। আমি চাই এখনও আপনি যা জানেন তা গোপন না করে খুলে সব বলুন। এখনও সত্য কথা বলুন।

সত্য কথা বলব?

হ্যাঁ হ্যাঁ, সত্যি কথা বলুন।

হা ভগবান, তাই আমি বলব। কিন্তু জানি না, সেকথা বিশ্বাস করবেন কিনা। তবু–তবু আমি বলব। একটা দীর্ঘশ্বাস রণধীরের বুকখানা কাপিয়ে বের হয়ে এল। রণধীর বলতে লাগল, সেইদিন দুপুরে আমার মনের অবস্থা অত্যন্ত unbalanced ছিল। আর এ জীবন সহ্য হচ্ছে না। এ বন্ধন যেন নাগপাশের মতই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। মুক্তি-মুক্তি চাই। এমনি ভাবে আর বেশীদিন থাকলে আমি বোধ হয় পাগল হয়েই যাব। আমার কেবলই কদিন থেকে মনে হচ্ছিল, আমিই এ সব কিছুর জন্য দায়ী। আমি সকলের বড়। ছোট ভাইরা সব আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের অসহায় যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে কতদিন-কতদিন আমি ভেবেছি, এই শৃঙ্খল আমি ছিড়ে ফেলব। সকলকে আমি মুক্তি দেব। সকলকে আবার বাঁচিয়ে তুলব। দিনের পর দিন এক বৃদ্ধ বিকৃত-মস্তিষ্কের নিষ্ঠুর খেয়ালের নাগপাশে বন্দী হয়ে জর্জরিত হবার চাইতে বুঝি মৃত্যুও ভাল। কী যে সে যন্ত্রণা আমি ভোগ করেছি তা কেউ জানত না।

আপনাকে আমি কী বলব মিঃ রায়, কতদিন রাত্রে শিশুর মতই আমি একা একা শয্যায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছি। কিশোরের মনের অবস্থা দিন দিন যেভাবে সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলছিল, সে আর যেন দেখতে পারছিলাম না। আমার সহ্যশক্তি যেন ভেঙে এড়িয়ে যাচ্ছিল। বাপ-মা-হারা ছোট ভাইটির সেই অসহায় করুণ মুখখানা যেন আমার হৃদয়ে নিশিদিন ব্যর্থ অনুশোচনার দাবাগ্নি জ্বালাত। সাপ যেমন তার চোখের দৃষ্টিতে শিকারকে সম্মোহিত করে রাখে, আমারও হয়েছিল সেই অবস্থা।

কাকার উন্মাদ পরিকল্পনা যেন অক্টোপাশের মত অষ্টবাহুতে আমাকে আঁকড়ে ধরে আমার রক্ত শোষণ করছিল। সমস্ত রাত্রি ধরে কত সঙ্কল্পের পর সঙ্কল্পই না আটতাম, কিন্তু সকালবেলা কাকার মুখের দিকে চাইলেই বন্যার মুখে স্রোতের কুটোর মত সব ভেসে যেত। অহর্নিশি অন্তর ও বাইরের এই দ্বন্দ্ব যেন আমায় পাগল করে তুলছিল, সামান্য শব্দে কেঁপে উঠতাম, সামান্য উত্তেজনায় আমার বুক কাঁপত। বোঝাতে পারব না আপনাকে আমার সেই অসহায় অবস্থার কথা। শেষকালে আর স্থির থাকতে পারলাম না। সেদিন বিকালে অনেক সাহস সঞ্চয় করে একটা উত্তেজনার মধ্যেই কাকার কাছে এগিয়ে গেলাম এর একটা শেষ মীমাংসা করতে।

সহসা অধীর ও সমীর চিৎকার করে উঠল, দাদা! দাদাভাই!

রণধীর তখন পাগলের মতই হয়ে উঠেছে, সে ভাইদের কথায় প্রবলভাবে চিৎকার করে বলে উঠল, না না, তোরা থাম। তোরা থাম। আজ তোরা আমায় বলতে দে। আজ আমার সকল সঙ্কোচ ভেঙেছে। দীর্ঘ একুশ বছরের এ অসহ্য যন্ত্রণা আর পুষে রাখতে পারছি না।

হ্যাঁ  শুনুন মিঃ রায়, তারপর কাকার সামনে গিয়ে কি দেখলাম জানেন, দেখলাম তিনি মৃত। মৃতদেহ সেখানে চেয়ারের উপরে বসে আছে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, কী করব-কী করা উচিত! চিৎকার করে সকলকে একবার যেন ডাকতে গেলাম, কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে আমার কোন স্বর বের হল না। তখন আমি ধীরে ধীরে আমার ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। কাউকে কোন কথা বললাম না। আমিও তার হাতে ইনজেকসনের দাগ দেখেছিলাম। আমি জানি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। করতে পারে না। তবু আপনাকে বললাম। বলে রণধীর হাঁপাতে লাগল।

ডাঃ চক্রবর্তী বললে, খুব স্বাভাবিক এটা রণধীরবাবু, যা আপনি করেছেন। একেই দীর্ঘদিন ধরে আপনি অন্তরে ও বাইরে উত্তেজিত ছিলেন, আপনার ঐ মানসিক অবস্থায় ওভাবে হঠাৎ কাজ করা কিছুই আশ্চর্য নয়। খুব স্বাভাবিক। আপনার তখন মানসিক পক্ষাঘাত হয়েছে।

কিরীটী এতক্ষণে বললে, রণধীরবাবু, আপনার এ কথা আমি বিশ্বাস করি। এবং ঐজন্যই বিনতা দেবী গগনেন্দ্রনাথকে মৃত জেনেও সেকথা গোপন করে গেছেন, তাই নয় কি?

রণধীর বললে, তাই। কিন্তু মিঃ রায়, সত্যি কি আপনি আমাকে সন্দেহ করেছিলেন?

ঠিক তাই নয়, কিরীটী বললে, তবে একবার মনে হয়েছিল, আপনার দ্বারা তাঁকে খুন করা একেবারে অসম্ভব নয়।

তবে, রণধীর বললে, আমাদের মধ্যে যদি কেউই তাকে খুন করে থাকি, তবে কে তাকে খুন করলে? কী সত্যি ঘটেছিল? আসল ব্যাপারটা কি?

জানতে চান কি তবে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল? কিরীটী বলতে লাগল, শুনুন বলছি। সিরিঞ্জ ও ডিজিট্যালিন ডাঃ চক্রবতীর ব্যাগ থেকে খোয়া গিয়েছিল। গগনেন্দ্রনাথের হাতেও ইনজেকশনের দাগ ছিল, সে আপনারা অনেকেই দেখেছেন ও বিশ্বাস করেন। ময়নাতদন্ত হলেই সে কথা আমরা জানতে পারতাম। কিন্তু তার আর উপায় নেই। আমাদের যখন সন্দেহ হয়েছে তখন আসল সত্যটা জেনে আমাদের সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়া ভাল, যখন খুনী আমাদের মধ্যে বসে আছে নির্ভয়ে স্বচ্ছন্দ চিত্তে।

সমীর বললে, এখনও আপনি বিশ্বাস করেন মিঃ রায় যে, আমাদের মধ্যেই কেউ কাকাকে হত্যা করেছি।

কিরীটী চুপ করে রইল।

.

(আমার পাঠক-পাঠিকাগণ,

আপনারা প্রথম থেকেই সমগ্র ব্যাপারগুলো পড়েছেন। কী করে রহস্যটা গড়ে উঠল, সেটাও আপনাদের চোখের উপরেই। প্রত্যেকটি চরিত্র নিয়েই কিরীটী সূক্ষ্ম বিচার করেছে এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে খুনী কে? আপনাদের জিজ্ঞাসা করছি, বলুন দেখি কে খুনী এবং কেন তাকে আপনারা সন্দেহ করছেন?

লেখক)

.

কিরীটী বলতে লাগল, শুনুন প্রথম থেকেই দুটো ব্যাপার আমার কাছে একটু আশ্চর্য ঠেকেছিল। যার কোন মীমাংসাই পাচ্ছিলাম না খুঁজে। গগনেন্দ্রনাথ নিত্য একটু ঔষধ সেবন করতেন, যার মধ্যে একটা ingredientDigitain; দ্বিতীয়ত, ডাঃ চৌধুরীর হাইপোড়রমিক সিরিঞ্জটা কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। এই দুটো পয়েন্টকে একসঙ্গে বিচার করে দেখুন, তাহলেই দেখতে পাবেন ঐ দুটো point–এর জন্য আপনাদের সকলকেই সন্দেহ করা যেতে পারে। অথচ সূক্ষ্ম বিচার ও আলোচনার দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল আপনারা ভাইরা বা বিনতা দেবী কেউই দোষী নন।

যে লোকটা আগে থেকেই হার্টের ব্যারামে ভূগছিল এবং প্রত্যহ ঔষধের সঙ্গে ডিজিট্যালিন সেবন করছিল, তাকে মারতে হলে ঔষধের সঙ্গে একটু বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন সেবন করিয়ে দিলেই সবচাইতে সহজ ও বুদ্ধিমানের কাজ হত। আপনাদের মধ্যেই যদি কেউ হত্যাকারী হতেন, তাহলে ঐভাবে আপনাদের কাকাকে হত্যা করতে হলে কী করতেন? যে শিশি থেকে তিনি নিয়মিত ঔষধ সেবন করতেন, তার মধ্যে বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন মিশিয়ে রাখতেন। কেউ টের পেত না। কেউ জানতেও পারত না, অথচ নিঝঞাটে কাজটা হাসিল হয়ে যেত এবং এভাবে কাজটা একমাত্র সম্ভব হত তাদের দ্বারা যারা তাঁর বাড়ির লোক বা যারা তাকে সেই ঔষধ খাইয়ে দিলে কেউই সন্দেহ করতে পারবে না। যখন বিনতা দেবীর মুখে শুনলাম ঔষধের শিশিটা ভেঙে গেছে তখন ঐ সন্দেহটা বেশী করে আমার মনে উঠেছিল।

ওভাবে মারা গেলে এবং শিশির ঔষধটা পরীক্ষা করলে যখন দেখা যেত যে, তার মধ্যে বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন আছে, তখন অনায়াসেই ওটার একটা explanation খাড়া করা যেতে পারত। বলা যেত, ভুল করে হয়ত ঔষধের দোকানদার যে ঔষধটা dispenseকরেছে, তাতে বেশী ডিজিট্যালিন মিশিয়ে ফেলেছে। এতে বাড়ির লোকের দোষ কী? এমন ভুল তো দোকানদাররা মাঝে মাঝে করেও থাকে, ফলে কিছুই ওই শিশি থেকে প্রমাণ করা যেত না। কিন্তু ওই সঙ্গে আর একটা সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে পারিনি। সেটা হচ্ছে মৃতের দেহে ইনজেকশনের দাগ ও সেই সঙ্গে ডাক্তারের ঘর থেকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা ও সিরিঞ্জটা চুরি যাওয়া। এর দুটি মাত্র মীমাংসা হতে পারে। এক ডাক্তারেরই দেখার ভুল, সিরিঞ্জ বা ঔষধ মোটেই চুরি যায়নি। অথবা হত্যাকারী সিরিঞ্জ ও ঔষধ চুরি করেছিল এইজন্য যে, গগনেন্দ্রনাথের নিত্য-ব্যবহৃত শিশিটার মধ্যে অন্যের অলক্ষে ডিজিট্যালিন ঢালার অবকাশ পায়নি বলে। অর্থাৎ এর থেকেই প্রমাণ হচ্ছে যে, হত্যাকারী বাড়ির কেউ নয়, বাইরের লোক।

এ ব্যাপারটা যে আগে আমার মনে উদয় হয়নি তা নয়। কিন্তু রণধীরবাবুদের দিকটা ভেবে দেখতে গেলে, ওঁদের দিক থেকে কাকাকে হত্যা করবার এত সঙ্গত কারণ ছিল যে, তাদের বাদ দিতে পারিনি প্রথমটায় আমার সন্দেহের তালিকা থেকে এবং তখনই ভাবতে লাগলাম, এও কি সম্ভব! ওঁদের দোষী সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ওঁরা নির্দোষ। এখন এইটাই আমাদের মীমাংসা করতে হবে। হত্যাকারী একজন বাইরের লোক। অর্থাৎ গগনেন্দ্রনাথকে এমন একজন কেউ হত্যা করেছে যে গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে এত পরিচিত নয়, যাতে করে সে অনায়াসেই তার ঘরে ঢুকে ঔষধের শিশিটার মধ্যে বেশী করে ডিজিট্যালিন মিশিয়ে রেখে আসতে পারে। এই ঘটনার সময় গগনেন্দ্রনাথের কাছাকাছি বা আশেপাশে বাইরের লোক কারা ছিল সেইটাই এখন বিচার করে দেখতে হবে।

সমরবাবু, যতীনবাবু, ডাঃ চক্রবর্তী, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ও বারীনবাবু-এঁরাই এখানে ছিলেন।

প্রথমেই ধরা যাক যতীনবাবুর কথা। যতীনবাবুর সঙ্গে এঁদের কোন পরিচয়ই ছিল না। তাছাড়া তিনি যদি খুনই করে থাকেন, কী উদ্দেশ্যে খুন করবেন। তার পক্ষে কোন strong motive তো নেই। একমাত্র Homicidalmaniacছাড়া তার পক্ষে ওভাবে গগনেন্দ্রনাথকে হঠাৎ খুন করবার কোন সঙ্গত কারণই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এবং এও আমরা জানি তিনি সে ধরনের লোক নন। অসুস্থ হলেও মস্তিষ্ক তার সম্পূর্ণ সুস্থ।

যতীনবাবু এতক্ষণে কথা বললেন, মিঃ রায়, এটা কি সত্যই হাস্যকর নয়? যদিও তার ভাইপোদের প্রতি তার ব্যবহার এতটুকুও পছন্দ করতাম না এবং মাঝে মাঝে আমার ভীষণ রাগ হত তার প্রতি ও তাকে সর্বান্তঃকরণেই আমি ঘৃণা করতাম, তথাপি সেই সামান্য কারণে একজন অপরিচিত রোগগ্রস্ত বৃদ্ধকে খুন করতে কখনই কেউ পারে না। তাছাড়া তাকে খুন করবার মত সুযোগও তো আমার মেলেনি। কেননা আমি বারীনবাবু ও সমরবাবুর সঙ্গেই আপনার বর্ণিত ঐ কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যে ছিলাম।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, তা জানি। আচ্ছা এখন দেখা যাক, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীই খুন করেছেন কিনা সেটা বিচার করে। তার পক্ষে ঐভাবে ডিজিট্যালিন ইনজেক্ট করে গগনেন্দ্রনাথকে মারা এমন কিছুই অসম্ভব নয়, কেননা তিনি একজন শিক্ষিত ডাক্তার। কিন্তু যেহেতু তিনি সাড়ে তিনটের আগেই হোটেল ছেড়ে চলে যান ও ফিরে আসেন সন্ধ্যা ছটায়, তার পক্ষে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার সুযোগ পাওয়া অসম্ভব ছিল। তাছাড়া এক্ষেত্রে তার খুন করবার উদ্দেশ্যই বা কি থাকতে পারে?

তারপর ধরা যাক ডাঃ চক্রবর্তীকে। তিনি, রণধীরবাবুর কথা মেনে নিলে, সাড়ে চারটের সময় যখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসেন-তার আগেই গগনবাবু খুন হয়েছেন। বারীনবাবুর ও যতীনবাবুর evidence-এ প্রমাণ হয় চারটে যোল মিনিটের সময় গগনবাবু বেঁচেই ছিলেন। তার মানে, এক্ষেত্রে ঐ কুড়ি মিনিটের পাকে ডাঃ চক্রবর্তীকে ফেলা যায় না। অবশ্য ডাঃ চক্রবর্তী হোটেলে ফিরে আসবার পথে কী করেছেন না করেছেন তার। কোন প্রমাণ নেই। কেননা ঐ সময় কেউ তার সাক্ষী ছিল না সেখানে। তাহলে একদিক দিয়ে ঐ সময় ডাঃ চক্রবর্তীর পক্ষে গগনবাবুকে খুন করা মোটেই আশ্চর্য বা অসম্ভব নয়।

কিন্তু এও ভাবতে হবে যে, তিনিও একজন শিক্ষিত ডাক্তার। অবশ্য একটা কথা আমার বরাবরই মনে হয়েছে। ডাক্তার যদি খুনী হন, তবে তিনিই প্রথম এ ব্যাপারে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন কেন যে এ ব্যাপারে কোন রহস্য আছে, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়? তাছাড়া গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার তার উদ্দেশ্যই বা কি থাকতে পারে? গগনবাবুর সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল না। এক্ষেত্রে ডাঃ চক্রবর্তী সম্পূর্ণ একজন তৃতীয় ব্যক্তি। তিনি নিজেই যদি দোষী হতেন তবে ব্যাপারটাকে এভাবে খুঁচিয়ে না তুলে বুদ্ধিমানের মত চুপচাপই থাকতেন। আমাদের common sense কি অন্তত তাই বলে না?

কিন্তু ঐ সময় আর একজন হোটেলে ছিল, সে হচ্ছে কিশোর। সে অনায়াসেই ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে সিরিঞ্জ চুরি করে নিয়ে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করতে পারত। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে সেও করেনি। তবে কে হত্যা করলে?

একটু থেমে আবার কিরীটী বলতে লাগল, এইবার আসুন আমার তৃতীয় ও চতুর্থ পয়েন্টে। গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ফ্যামিলির কাউকে বাইরের কোন তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে মিশতে দিতে একেবারেই পছন্দ করতেন না ও কোথাও বের হতে দিতেন না। অথচ সেদিন বিকালে তিনি তার ভাইপোদের ইচ্ছামত অন্য সকলের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যেতে বললেন, কোন আপত্তিই করলেন না। দুটো ব্যাপারই একটা আশ্চর্য নয় কি! এটা তার স্বভাবের একেবারেই বিপরীত।

এবার গগনেন্দ্রনাথের মানসিক অবস্থাটা একটু আললাচনা করে দেখা যাক। অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন তিনি।

তার মনে অন্যের উপরে শাসন ও প্রভুত্ব করবার একটা উম্মাদ পৈশাচিক আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই যে একটা প্রভুত্ব করবার আকাঙক্ষা, একটা শক্তিপ্রয়োগের লোভ, এটাকে জয় করার মত তার মানসিক শক্তি ছিল না। এবং তার দীর্ঘ কর্মজীবনে ঐ জিনিসটা বরাবরই উপভোগ করে এসেছিলেন ও অপ্রতিহত ভাবে প্রথমে আন্দামানের কয়েদীদের উপর ও জেলার-জীবনে কয়েদীদের উপর, পরে নিজের অসহায় ভাইপোদের প্রতি প্রয়োগ করেছিলেন। অথচ মজা হচ্ছে এই যে, আসলে তিনি একজন পরের প্রতি প্রভুত্ব করবার মত শক্তিশালী লোক ছিলেন না। শুধু সুযোগ ও সুবিধা তার সহায় হয়েছিল মাত্র। এবং এইভাবে অন্যের প্রতি অন্যায় প্রভুত্ব করবার একটা নেশা তাকে শেষ পর্যন্ত পেয়ে বসেছিল।

এবারে আসা যাক আমাদের আট নম্বর পয়েন্টে। তিনি একদিন বলেছিলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না। মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি। সবই আমার মনে আছে। সব মুখই আমার মনে আছে। কথাগুলো সেদিন হয়ত ডাঃ গাঙ্গুলীর মনে অনেকখানি চঞ্চলতা এনেছিল। কিন্তু আসলে এ কথাগুলো সেদিন তিনি ডাঃ গাঙ্গুলীকে বলেননি। হঠাৎ তার আশেপাশে অন্য কোন বিশেষ এক পরিচিত ব্যক্তির মুখ দেখেই ও কথাগুলো সেই লোককে উদ্দেশ করেই বলেছিলেন।

কিরীটী আবার একটু থেমে বলতে লাগল, আবার ভেবে দেখা যাক গগনেন্দ্রনাথের হত্যার দিন বাইরের অন্য কোন লোক সে সময় হোটেলে ছিল কিনা। একমাত্র কিশোর ছাড়া রণধীরবাবুরা প্রত্যেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। গগনেন্দ্রনাথ একা তার ঘরের সামনে বারান্দায় চেয়ারের উপরে হেলান দিয়ে বসেছিলেন।

এবারে বারীনবাবু ও যতীনবাবুর কথাগুলো ভাল করে বিচার করে দেখা যাক। যতীনবাবুর দৃষ্টিশক্তিকে আমি প্রশংসা করতে পারি না। সে প্রমাণ আমি পেয়েছি যখন তিনি বলেছিলেন তার ঘরের অল্পদূর দিয়েই খানসামাটা প্রায় যখন ছুটে গিয়েছিল তিনি তাকে চিনতে পারেননি। তাছাড়া যতীনবাবু ও বারীনবাবুর ঘর পাশাপাশি; এক ঘরের লোক অন্য ঘরের লোককে দেখতে পারেন না। অথচ দুজনের ঘর থেকেই বারান্দায় যেখানে গগনেন্দ্রনাথ বসেছিলেন সেখানটা স্পষ্ট দেখা যায় এবং দুজনেই দেখেছিলেন একজন খানসামা গগনবাবুর কাছে গিয়ে কোন কারণে গালাগালি খেয়ে কিশোরের ঘরের দিকে ছুটে পালায়। বেলা চারটের সময় যতীনবাবু যখন নিজের ঘরে বসে বই পড়ছেন, বারীনবাবু তাকে বেড়াবার জন্য ডাকতে যান। বারীনবাবু তার জানবন্দিতে বলেন, একজন খানসামা গগনবাবুর কাছে যায়, তারপরই একটা গোলমাল শোনা যায়, খানসামাটা আবার কিশোরের ঘরের দিকে চলে যায়।

সহসা এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি তুমি বলতে চাও কিরীটী যে, হোটেলের একজন খানসামাই শেষ পর্যন্ত গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছে?

দাঁড়াও দাঁড়াও ডাক্তার, ব্যস্ত হয়ো না। আমি এখনও আমার বক্তব্য শেষ করিনি। খানসামা গগনবাবুর কাছে বকুনি (?) খেয়ে কিশোরের ঘরের দিকে ছুটে পালায়। যতীনবাবু ও বারীনবাবু দুজনেই তা দেখেছেন। অথচ আশ্চর্য, কেউই তার মুখ দেখতে পাননি বা চিনতে পারেননি। কিন্তু মজা এই যে, বারীনবাবুর ঘর থেকে বারান্দায় যেখানে গগনেন্দ্রনাথ বসেছিলেন তার দূরত্ব মাত্র একশত গজ।

বারীনবাবু খানসামার সাদা রঙের পোশাকের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি খানসামার পোশাকের অমন নিখুত বর্ণনা দিতে পারেন পলায়নপর খানসামাকে দেখে, অথবা তার মুখটা দেখতে পেলেন না বা তাকে চিনতে পারলেন না, এটা কি আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য নয়? অথচ তাঁর নাকি চোখের অসুখ, সর্বদা রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করেন। চোখে আলো সহ্য হয় না। সহসা ডাঃ চক্রবর্তী চিৎকার করে উঠলেন, তবে কি—তবে কি

কঠিন শান্ত কণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল, হ্যাঁ, তাই। বারীনবাবুই গগনেন্দ্রনাথের হত্যাকারী।…এবং শুধু গগনেন্দ্রনাথেরই নয়, ইতিপূর্বে কিছুকাল ধরে কলকাতা শহরে যে কয়েকটি নৃশংস অমানুষিক হত্যা বা খুন হয়েছে, সব কটি হত্যা-রহস্যেরই মেঘনাদ…বলতে বলতে কিরীটীর চোখ সৌম্য-শান্ত অদূরে উপবিষ্ট বারীনবাবুর প্রতি ন্যস্ত হল। সহসা বারীনবাবু চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতই কিরীটীর উপরে ঝাপিয়ে পড়লেন।

মেঝের উপরে দুজনে দুজনকে আঁকড়ে ধরে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু অসীম বলশালী কিরীটীর কাছে অল্পক্ষণের মধ্যেই বারীনাবুকে পরাস্ত হতে হল।

সকলে মিলে বারীনবাবুর হাত বেঁধে চেয়ারের উপরে বসাল। বারীনবাবুর মুখে একটি কথা নেই। সর্বশরীর তার রাগে তখন ফুলছে। চোখের রঙীন চশমা কোথায় ছিটকে পড়েছে। গোল গোল দুটো চোখ থেকে যেন ক্ষুধিত জিঘাংসার একটা অগ্নিশিখা ছুটে বেরিয়ে আসছে।

কিরীটী গায়ের জামা-কাপড় একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললে, মনে পড়ে বন্ধু! এক মাস আগে রসা রোডের মোড়ে এক গভীর রাত্রের কথা? আজও তোমার সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে রক্তলোলুপ দৃষ্টির কথা আমি ভুলিনি!

অমরবাবু, নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল ওরফে বারীন চৌধুরী ওরফে মহীতোষ রায় চৌধুরী–কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার, দানেধ্যানে প্রাতঃস্মরণীয় ডাঃ এন. এন. চৌধুরী, চেতলার অবসরপ্রাপ্ত আলিপুর জেলের ডেপুটি সুপারিন্টেন্টে ডাঃ অমিয় মজুমদার, রাণাঘাট লোকাল ট্রেনের সেই হতভাগ্য যুবকের হত্যাকারী নরখাদককে আপনার হাতে তুলে দিলাম। ঘরের মধ্যে যেন মৃত্যুর মতই স্তব্ধতা থমথম্ করছে।

সহসা বারীনবাবু বলে উঠল, কিরীটী রায়, তুমি আমায় ধরবে বটে! বলতে বলতে বিদ্যুৎবেগে সে উঠে দাঁড়াল এবং চোখের পলকে ঘর থেকে ছুটে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী করে যে ইতিমধ্যে সকলের অলক্ষ্যে সে তার হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছিল কেউ তা টের পায়নি।

আসলে বারীনের হাতের কবজিতে একটা তীক্ষ্ণ ছুরি বাঁধা থাকত, তার সাহায্যে সে সকলের অলক্ষ্যে বাঁধন কেটে ফেলেছিল।

.

সমস্ত পুরী শহরটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও মহীতোষের সন্ধান পাওয়া গেল না।

কলকাতায় সুব্রতকে ইতিপূর্বেই সকল কথা জানিয়ে কিরীটী তার করে দিয়েছিল। মহীতোষ সেখানেও যায়নি।

.

দিন পাঁচেক পরের কথা।

পরদিন সকলে কলকাতার পথে যাত্রা করবে।

রাত্রি তখন বোধ করি সাড়ে নটা। অন্ধকার রাত্রি। সকলে সাগরের তীরে বসে আছে। অন্ধকারে উলঙ্গ সাগর কুদ্ধ দানবের মত গর্জাচ্ছে।

আকাশে তারাগুলি মিটমিট করে জ্বলছে আর নিভছে।

ডাঃ চক্রবর্তীই প্রশ্ন করলে, বারীনবাবুকে কি তুমি প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলে কিরীটী?

কিরীটী বললে, তবে শোন। মানুষের প্রতিভা যখন বিপথে যায় তখন এমনি করেই বুঝি ধ্বংসের মুখে ছুটে যায়। মানুষের খেয়ালের অন্ত নেই। বারীনবাবুর মত লোকেরা মানুষের দেহে শয়তান। এ একটা মানসিক বিকার। বিকৃত-মস্তিষ্কের একটা অদ্ভুত পৈশাচিক অনুভূতি। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইদানীং কিছুকাল ধরে কলকাতার উপরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছিল তার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। শুধু যে খুন করে রক্ত দেখবার একটা নেশাতেই মহীতোষ খুন করত তা নয়। পিছনে তার অতীত জীবনের কিছুটা সম্পর্কও ছিল। বিখ্যাত ডাঃ অমিয় মজুমদার খুন হবার কিছুকাল পরেই সুব্রতর সাহায্যে মহীতোষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে কেবলই আমার মনে হত যে, তার মত অদ্ভুত শিক্ষিত বিকৃত মস্তিষ্ক ইতিপূর্বে আর আমি দেখিনি এবং সেই থেকেই তার প্রতি আমি নজর রাখি।

মহীতোষ সম্পর্কে খোঁজ করতে করতে জানতে পারি, কলকাতা শহরে কেউ তার পাঁচ বছর পূর্কোর জীবনের কোন কথাই জানেনা এবং জানবার চেষ্টাও করেনি। লোকটা যেন হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। ডাঃ অমিয় মজুমদারের খুনের দিন মহীতোষের চোখের যে দৃষ্টি আমি সহসা দেখেছিলাম, অন্তরের অন্তস্থলে তা আমার গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। এখানে মহীতোষের চোখের তারার সেই দৃষ্টিই খুঁজে পেয়েছিলাম সেইদিন যেন। আমি মহীতোষের পূর্ব-জীবনের সন্ধান করতে শুরু করলাম এবং কেমন করে সব কথা আমি অনুসন্ধানের ফলে জানতে পেরেছিলাম তাও আমি বলব।

তোমার আহ্বানে আমি যখন পুরীতে এলাম, প্রথম দিনই হঠাৎ দূর থেকে বারীনবাবুকে দেখে আমি যেন চমকে উঠলাম। মুখে সাদা দাড়ি, চোখে রঙীন কাঁচের চশমা, কেবলই যেন মনে হতে লাগল এমনি লম্বা চেহারার একজনকে কোথায় দেখেছি। এমনি চলার ভঙ্গি, এমনি কণ্ঠস্বর, এমনি হাসি। কেন যেন কেবলই আমার মনে হত বৃদ্ধের ছদ্মবেশের অন্তরালে যেন কোন একটা পরিচিত চেনা লোক লুকিয়ে আছে। সহসা একদিন এমন সময় আচমকা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য বারীনের চশমাহীন চোখ আমি তার অজান্তেই দূর থেকে দেখেছিলাম। সে দৃষ্টি তো আমার ভুলবার নয়, চকিতে মনের কোণে সন্দেহের বিদ্যুৎ জেগে উঠল। আমি সতর্ক হয়ে উঠলাম এবং সেই থেকেই একটা চিন্তা আমার মনে কেবলই ঘুরপাক খেতে লাগল, এই ছদ্মবেশে মহীতোষ এখানে কেন?…

ইতিপূর্বে মহীতোষের পূর্ব ইতিহাস আমি অনেকটা অনুসন্ধানের ফলে সংগ্রহ করেছিলাম। মহীতোষের আসল নাম নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল। ওর জন্ম হয় সামান্য এক ঘাতকের ঘরে এবং সে কথা আমি জানতে পারি ওর অনুপস্থিতিতে একদিন রাত্রে ওর শোবার ঘরে হানা দিয়ে, দেওয়ালে টাঙানো এক এনলার্জড় ফটো দেখে। ওর ঠাকুর্দা ছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ঘাতক। ছবিট তারই। যেসব হতভাগ্যদের ফাঁসির হুকুম হত, তাদের ফাসির দড়িতে লটকাবার কাজ করত প্রথমে ওর ঠাকুন্দা, পরে ওর পিতা। পুরুষানুক্রমে ওরা ওই ঘাতকের ব্যবসা করত। ওর বাপ রামশরণ কাঞ্জিলালকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পিতার ব্যবসা গ্রহণ করতে হয়েছিল শিক্ষার অভাবে। কিন্তু বোধ হয় নিরঞ্জনের বাপ সে কাজ ঘৃণা করত এবং সেই জন্যই হয়ত সে তার পুত্রকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে।.।

নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল কলিকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে এম. এ. পাস করে পাটনায় প্রফেসারী করত। কিন্তু রক্তের যা ঋণ, তার দাবি বড় ভয়ানক। সে ভয়ঙ্কর পৈশাচিক কর্মের অনুভূতি তার পিতা ও ঠাকুর্দার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত ছিল, সেটা নিরঞ্জন কাঞ্জিলালের রক্তেও সংক্রামিত হয়েছিল। খুন করবার একটা দুর্জয় লালসা ও পৈশাচিক অনুভূতি নিরঞ্জনের অবচেতন মনের মধ্যে প্রথমে ক্রমে ক্রমে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। সে তার শিক্ষাদীক্ষা সত্তেও সেই অবচেতন পশুমনের পৈশাচিক অনুভূতির কাছে আপনার অজ্ঞাতেই আপনাকে ধরা দিতে বাধ্য হয়েছিল। দুই পুরুষের রক্তের ঋণ তাকেও শোধ করতে হল। এ ছাড়া তার আর উপায় ছিল না এবং পরে সে এইভাবে সংক্রামিত হয়ে খুন করে একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করত।

একবার রাঁচি শহরে ওইভাবে কোন এক ভদ্রলোককে খুন করতে গিয়ে ও ধরা পড়ে, বিচারে ওর পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং ওকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। সেই সময় গগনেন্দ্রনাথ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের জেলার ছিলেন। যা হোক জেল থেকে মুক্তি পাবার পর নিরঞ্জন আরও দুর্বার হয়ে ওঠে। কিন্তু তার শিক্ষা হয়ত তার সেই অবচেতন প্রবৃত্তির সামনে এসে শিক্ষা ও প্রকৃতিগত পৈশাচিকতার সঙ্গে বাধায় সংঘর্ষ। অবশেষে শয়তানেরই হয় জয়। রক্তের ঋণ! রক্তের ঋণ! নিরঞ্জনের মুখ চেনা বলেই সেদিন গগনেন্দ্রনাথ ওই কথা বলেছিলেন। তাকে হয়ত হঠাৎ চিনতে পেরেছিলেন। তাই তার মুখ দিয়ে ওকথা বের হয়েছিল।

ছদ্মবেশেও নিরঞ্জন আপনাকে গগনেন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি এবং নিরঞ্জনও ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কেননা গগনেন্দ্রনাথকে ইহসংসার থেকে সরাবার মতলবেই সে পুরীতে তার পিছু পিছু ধাওয়া করে এসেছিল। ডাঃ অমিয় মজুমদারও পাটনায় প্রথম জীবনে ডাক্তারী করতেন ও হয়ত নিরঞ্জনকে চিনতেন। ডাঃ এন. এন. চৌধুরীও নিরঞ্জনের বাপকে ও তাকে চিনতেন। আলিপুরের সুপারও তাকে চিনতেন। নিরঞ্জন যখন ছদ্মনামে ছদ্মবেশে নতুন জীবন শুরু করল, তার স্বতই মনে হল তার চেনা লোকদের না সরাতে পারলে হঠাৎ হয়ত কোন একদিন তার আসল ও সত্যকারের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে। ফলে তার সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে। সেও একটা কথা এবং তার প্রকৃতিগত পৈশাচিকতা দুটোতে মিলে তাকে খুনের নেশায় মাতিয়ে তুলল।

কিন্তু সে আশা করেনি হয়ত যে, গগনেন্দ্রনাথ তার ছদ্মবেশের ভিতর থেকেও তাকে চিনতে পারবেন। ফলে নিরঞ্জন মরীয়া হয়ে উঠল এবং সুযোগ খুঁজতে লাগল। সুযোগ মিলেও গেল হঠাৎ। বারীনকে আমি সন্দেহ করলেও আমার মনে তখনও একটা সন্দেহের কাটা খচ খচ করছিল, কিন্তু তার evidence শোনবার পর আর কোন সন্দেহ রইল না। বুঝলাম এ সেই নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল এবং এই গগনেন্দ্রনাথের হত্যাকারী। কাঞ্জিলাল তার evidence-এ দুটি মাত্র ভুল করেছিল, যাতে করে আমার চোখের দৃষ্টি খুলে যায় ও সমস্ত সন্দেহ মিটে যায়। এক নম্বর হচ্ছে, সে পলায়নপর খানসামার বেশভূষার নিখুঁত description দিলে, অথচ তাকে চিনতে পারলে না এবং ভুলে গিয়েছিল যে সে চোখের ব্যারামের অজুহাতে রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করছে! ২ নং সে ভুল করে, সিরিঞ্জটা ডাক্তারের ঘরে রাখতে গিয়ে প্রথমেই কিশোরের ঘরে গিয়ে ঢোকে। সে আগে থাকতেই ওদিন কোন এক সময় ডাক্তারের ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ ও ঔষধের শিশিটা চুরি করেছিল, পরে খানসামার বেশ পরে গগনেন্দ্রনাথকে হত্যা করে তাড়াতাড়ি ভুল করে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘর ভেবে কিশোরের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ে। ডাঃ চক্রবর্তী তখন নিজের ঘরে শুয়ে জ্বরের ঘোরে গোঙাচ্ছেন। টের পাননি। কিন্তু ইনজেকশন দেবার সময় নিশ্চয়ই গগনেন্দ্রনাথ বাধা দিয়েছিলেন, এবং তাতেই গোলমাল শোনা যায়, যতীনবাবু ভেবেছিলেন গগনবাবু বুঝি নিত্যকারের মত ভৃত্যকে গালাগাল করছেন। পরে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করে বারীন যখন সিরিঞ্জ রেখে আসে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে, ডাঃ চক্রবর্তীও টের পাননি। তারপর বারীন তার খানসামার বেশ বদল করে নিজ বেশে এসে যতীনবাবুকে বেড়াতে যাবার জন্য আহ্বান করে ও দুজনে বেড়াতে বের হন। এবং বারান্দার সামনে দিয়ে যাবার সময় যতীনবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিরঞ্জন গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলবার অভিনয় করে। আসলে কিন্তু তার কথায় গগনেন্দ্রনাথ কোন জবাবই দেননি। কিন্তু অন্যমনস্ক যতীনবাবু সেটা বুঝতে পারে নি। তাছাড়া আগেই বলেছি, যতীনবাবুর দৃষ্টিশক্তি তত প্রখর নয়। বারীন নিজের মনগড়া ভাবে যতীনবাবুকে বুঝিয়ে দেয় ও বলে, দেখলেন, ভদ্রলোক জবাবটা পর্যন্ত ভাল করে দিলেন না! যতীনবাবুও তাই বুঝে চুপ করে রইলেন। তিনিও জানতেন যে গগনেন্দ্রনাথ অভদ্র ও বদমেজাজী। তা ছাড়া তিনি তো তখন জানতেন না যে গগনেন্দ্রনাথ মৃত!

কিশোরের স্বপ্নও মিথ্যা নয় বা সেটা delirium–ও নয়। সে দেখছিল একজন সাদা পোশাক পরা পরী তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার বিকৃত স্বপ্নাতুর কল্পনায় বারীনের খানসামার সাদা পোশাককে পরীর পোশাক বলে ভুল করেছিল। কিন্তু এই প্রমাণেই তো তাকে দোষী বলে ধরা যায় না। আমি প্রথম যেদিন তাকে রসা রোডে রাত্রে দেখি, সে তাড়াতাড়ি পালাবার সময়, তার নামের আদ্যক্ষর এন লেখা রুমালটা ফেলে যায়। তাছাড়া তার আঙুলের ছাপ কায়দা করে নিয়েছি ও সেটা কলকাতায় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলাম, সেখানকার অপরাধীদের ফাইলে রক্ষিত আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে। ডাঃ চক্রবর্তীর সিরিঞ্জের গায়েও তার আঙুলের ছাপ ছিল, সেটাও নেওয়া হয়েছিল। সব হুবহু এক, মিলে গেছে। আমারই ভুল হয়েছিল তাকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে আলোচনা করা। তা না হলে হয়ত সে পালাবার সুযোগ পেত না।

কিরীটী চুপ করলে। অদুরে অন্ধকারে সমুদ্রের কালো কালো ঢেউগুলো সাদা ফেনার উচ্ছ্বাস বুকে নিয়ে যেন ক্রুদ্ধ গর্জনে এদিকে ছুটে আসছে।

তুমি কি সত্যই কোণারকে গিয়েছিলে কিরীটী? অমিয় জিজ্ঞাসা করল।

কিরীটী জবাব দিল, না। কলকাতায় বারীনের আসল ইতিহাসের খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বারীন যে এত তাড়াতাড়ি খুন করবে তা ভাবতে পারিনি।

–: সমাপ্ত :–

Exit mobile version