ঝড়ের মতই আগন্তুক দরজা ঠেলে ঘরের বাইরে চলে গেল।
অন্ধকার ঘরের মধ্যে একা শুধু বসে রইল তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী কিরীটী রায়।
ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি দুটো ঘোষণা করল।
কিরীটী চোখ দুটো একবার রগড়ে নিল। এতক্ষণ একটা স্বপ্ন দেখছিল না তো!
***
হঠাৎ সেদিন বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীটে এক বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতার দোকানে। প্রায় দীর্ঘ নয় বৎসর বাদে সহপাঠী ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কিরীটীর দেখা হয়ে গেল।
ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী কলিকাতা ইউনিভারসিটির একজন নামকরা ছাত্র। বি. এসি পাস করে সে কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. পাস করে। পরে মনোবিজ্ঞানে এম. এ. পাস করে। বিলাতে তিন বৎসরকাল অধ্যয়ন করে সাইকাব্রিকস্ট হয়ে আসে। যুদ্ধ বাধবার মাত্র মাস ছয়েক আগে সে ফিরে আসে।
অত্যন্ত খেয়ালী প্রকৃতির। এতদিন বসেই ছিল, হঠাৎ আবার কী খেয়াল হওয়ায় কলকাতায় মাস দুই হল এসে একটা ক্লিনিকস্ খুলে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। দুমাসেই বেশ নাম হয়েছে তার শহরে।
বহুকাল বাদে দুই বন্ধুর দেখা। দুজনে গিয়ে এক রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল, চা খেতে খেতে নানা সুখ-দুঃখের গল্প চলতে লাগল।
কলেজ-লাইফে কিরীটী ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। আর অমিয় ছিল শান্তশিষ্ট ভাবুক প্রকৃতির।
কিরীটীকে অমিয় কিরাত বলে ডাকত, আর কিরীটী অমিয়কে কুনো বলে সম্বোধন করত।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অমিয় বললে, তুই তো আজকাল মস্ত বড় একজন গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিস কিরাত। কাগজে কাগজে তোর নাম।
কিরীটী জ্বলন্ত সিগারেটে একটা মৃদু টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গম্ভীর স্বরে বললে, হ্যাঁ, গোয়েন্দা নয়, রহস্যভেদী। কিন্তু তোর খবর কি বল তো? সত্যিই ডাক্তারী করবি নাকি? চিরদিন তো রবি ঠাকুরের কবিতা আর যত রাজ্যের মনোবিজ্ঞানের বই পড়ে কাটালি!
ডাক্তারী করব মানে? রীতিমত শুরু করেছি। বিনি ফিসে একটা মাথা খারাপের গোষ্ঠী পাওয়া গেছে।
মানে?
মানে আর কি! বালিগঞ্জে আমাদের পাশের বাড়িতে তারা থাকে। সমস্ত ফ্যামিলিটাই পাগল, কতা থেকে শুরু করে ছেলেগুলো পর্যন্ত।
বলিস কী? কতা ক্ষ্যাপা, গিন্নী ক্ষ্যাপা, পাগল দুটো চেলা, সেথা সাত পাগলের মেলা!
আর বলছি কী! সামনের রবিবারে আয় না, আলাপ করিয়ে দেব ভদ্রলোক আবার শীঘ্রই পুরীতে হাওয়া বদলাতে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের নাম রায়বাহাদুর গগনেন্দ্রনাথ মল্লিক। জেল ডিপার্টমেন্টে মোটা মাহিনায় চাকরি করতেন। কিছুকাল আলিপুর জেলের ও পোর্টব্লেয়ারে সুপারিন্টেন্টে ছিলেন। গত মহাযুদ্ধে লোহালক্কড়ের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থও জমিয়েছিলেন। অবিবাহিত। বয়স এখন বোধ করি ষাটের কাছাকাছি হবে। সংসারে পোষ্যের মধ্যে চারটে ভাইপো। এই ভাইপোদের শিশুবয়সে মা-বাপ মারা যায় এবং এরা এদের এই বুড়ো কাকার কাছেই মানুষ।
বড় রণধীর বি.এস-সি পাস করে বাড়িতেই বসে আছে। বছর দুই হল বিবাহও করেছে, ছেলেমেয়ে নেই। বয়স প্রায় ত্রিশের মত। মেজ সমীর আই. এ. পর্যন্ত পড়ে আর লেখাপড়া করেনি। বাড়িতে বসে আছে। বয়স প্রায় সাতাশ। সেজ অধীর, বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে, বি. এ. পাস করে বসে আছে। সবার ছোট কিশোর, বছর চৌদ্দ বয়স, বাড়িতেই পড়াশুনা করে।
বুড়ো গগনেন্দ্রনাথ অসুস্থ, হার্টের ব্যারামে ভুগছেন। সর্বদাই বাড়িতে বসে থাকেন। অত্যন্ত খিটখিটে বদমেজাজী, অসাধারণ প্রতিপত্তি এই বুড়োর ভাইপোদের উপর।
ভাইপোরা বাড়ি থেকে এখনও এক পাও কোথাও বের হয় না। সর্বদাই বাড়ির মধ্যে বুড়োর দৃষ্টির ভিতরে আছে।
কারও বাড়িতে জোরে কথা বলবার উপায় নেই, হাসবার উপায় নেই। সবাই গম্ভীর চিন্তাযুক্ত। একটা কঠিন শাসন-শৃঙ্খলা যেন বাড়ির সব কটি প্রাণীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধন দিয়ে পঙ্গু নিশ্চল করে রেখেছে।
ভাইপোরা খাবেদাবে, ঘুরবে, বেড়াবে, দাঁড়াবে, চলবে, ঘুমুবে সব বুড়োর সৃষ্টিছাড়া বাঁধাধরা আইনে। এতটুকু কোন ব্যতিক্রম হবে না এমনি কঠোর শাসন বুডোর।
সবার ছোটটাই রীতিমত hallucination-এ ভুগছে।
বাড়ির মধ্যে কেবল একমাত্র বড় ছেলের বৌ নমিতা দেবী যেন ওদের গণ্ডির বাইরে।
এক বিচিত্র আবহাওয়া! বিচিত্র পরিস্থিতি!
বুড়ো হঠাৎ একদিন রাত্রে অসুস্থ হয়ে পড়ায় পাশেই থাকি বলে বাড়িতে আমার ডাক পড়েছিল। কী জানি কেন বুড়ো আমাকে যেন একটু স্নেহের চোখেই দেখে।
একমাত্র আমাকেই সকলের সঙ্গে মিশতে দেয়।
কিন্তু ছেলেগুলো দীর্ঘকাল ধরে ঐ অদ্ভুত শাসনগণ্ডির মধ্যে থেকে থেকে মানসিক এমন একটা সদা-সশঙ্কিত ভাব হয়েছে যে, কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে বা দুদণ্ড আলাপ করতে পর্যন্ত ভয়ে শিউরে ওঠে।
কী করে যে অতগুলো প্রাণী একটা কুৎসিত গণ্ডির মধ্যে অমন ভাবে দিনের পর দিন আটকে রয়েছে ভাবলেও আশ্চর্য হয়ে যাই।
আশ্চর্য তো! কিরীটী বললে, এ যুগে এও সম্ভব?
Mentally সবকটা লোকই ও-বাড়ির unbalanced, সকলেই একটা মানসিক উত্তেজনার মধ্যে আছে অথচ বিদ্রোহ করবার মত কারও সাহস নেই।
কিরীটী বললে, আমিও বর্তমানে একটা হোমিসাইডাল ম্যানিয়াকের পিছনে ঘুরছি ভাই। দেখি আসছে রবিবার চেষ্টা করব যেতে।
***
কিন্তু কিরীটীর আর রবিবার যেতে হল না।
সহসা শনিবার সকালে বন্ধুর এক চিঠি পেল।