***
কিরীটী, সুব্রত মহীতোষবাবু ও তাঁর এক বিশিষ্ট বন্ধু সমর বসু সকলে বিকেলের দিকে মহীতোষের লাইব্রেরী ঘরে বসে চা পান করতে করতে আলাপ-আলোচনা করছিল।
সমরবাবু বলছিলেন, উঃ, এ কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার শহরের বুকে চলেছে বলুন তো সুব্রতবাবু? প্রত্যেক শহরবাসীর মনে যে একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক উপস্থিত হয়েছে তা কি বুঝতে পারছেন না?
বুঝেই বা কি করছি বলুন, মিঃ বসু! চেষ্টার তো ত্রুটি করছি না।
কিন্তু এও কি সম্ভব? মহীতোষ বলতে লাগলেন, মানুষ তো মানুষের মাংস খেতে পারে না! তবে কি সেই জনকথার কোন রাক্ষসেরই আবির্ভাব হল এই শহরে? ভয়ে রাত্রিতে আমার ভাল করে ঘুমই হয় না আজ দুদিন থেকে।
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, দরজায় খিল দিয়ে শোন তো?
মহীতোষ বললেন, তা আবার বলতে! কথায় বলে সাবধানের মার নেই!
কিন্তু সত্যি আপনার কী মত বলুন তো কিরীটীবাবু? সমরবাবু প্রশ্ন করলেন।
সেও একটা মানুষ, তবে abnormalবলতে পারেন। আমি স্বচক্ষে তাকে দেখেছি। কিরীটী বললে।
সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন, সে কি!
হ্যাঁ! কিন্তু আজকের মত এসব আলোচনা থাক। চল সুব্রত। উঠলাম মিঃ চৌধুরী। নমস্কার।
কিরীটী সুব্রতকে নিয়ে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে মহীতোষ ও সমরবাবু বসে।
হঠাৎ মহীতোষবাবু বললেন, এই কিরীটী রায় নোকটা অসাধারণ বুদ্ধিমান বলে শুনেছি, তবে অহমিকা বড় বেশী।
সমরবাবু কোন জবাব দিলেন না, চুপ করে বসে রইলেন।
***
সেই রাত্রে।
কৃষ্ণা সুব্রতদের ওখানে নিমন্ত্রণ খেতে গেছে। আজ আর ফিরবে না রাত্রে।
কিরীটী একাকী নিজের শয়নঘরে একটা সোফায় হেলান দিয়ে টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় গভীর মনোযোগের সঙ্গে ক্রিমিনোলজির একখানি বই পড়ছে। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো বড় ঘড়িতে ঢং করে রাত্রি একটা ঘোষণা করলে।
কিরীটী সোফা হতে উঠে পাশের টেবিলে বইটা রেখে আড়মোড়া ভাঙল। উঃ, অনেক রাত্রি হয়ে গেছে! আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ভোলা জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।
বাইরে চন্দ্রালোকিত নিঃশব্দ রজনী যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তার মোড়ে কৃষ্ণচূড়ার গাছের পাতায় পাতায় আলোছায়ার লুকোচুরি।
রাত্রির নিঃশব্দ হাওয়া ঝিরঝির করে বইছে।
সহসা পশ্চাতে কার ভারী গলার স্বরে কিরীটী বিদ্যুতের মত চমকে ফিরে দাঁড়াল।
কিরীটী রায়!
কে?
চাঁদের আলোর খানিকটা ঘরের মধ্যে এসে ঈষৎ আলোকিত করে তুলেছে।
অস্পষ্ট আলোছায়ায় ঘরের ওপাশের দেওয়াল ঘেঁষে কালো ওভারকোট গায়ে মাথার একপাশে হেলানো কালো ফেল্টের টুপি।
কে? কে ও দাঁড়িয়ে? কিরীটী রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সামনের দিকে চেয়ে রইল।
চকিতে মনের কোণে ভেসে ওঠে রসা রোডের কিছুদিন আগেকার একটা মধ্যরাত্রির কথা।
বসতে পারি কিরীটীবাবু? আগন্তুক প্রশ্ন করল।
কিরীটী নির্বাক।
কথ বলবার সমগ্র শক্তিই যেন তার কণ্ঠ হতে লুপ্ত হয়েছে। আগন্তুক একটা সোফা টেনে নিয়ে বসল।-সত্যি মিঃ রায়, এই নিশুতি রাত ও বাইরের ঐ চাঁদের আলো-এর মধ্যে যেন একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। বসুন, আপনি যে দাঁড়িয়েই রইলেন! কতদূর থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম!
আমার বাড়িতে আপনি ঢুকলেন কি করে? কিরীটী রুদ্ধ বিস্ময়ে প্রশ্ন করল।
আগন্তুক এবারে হাঃ হাঃ করে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠল, কিরীটীবাবু, আপনি অপরাধতত্ত্বের একজন মস্তবড় পণ্ডিত শুনেছি। এককালে আপনার নেশা ছিল অপরাধীদের অপরাধতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা। ঘরের দরজাটা একটা লোহার তালা এঁটে বন্ধ করলেই কি গৃহপ্রবেশ অসম্ভব হয়ে গেল? একটা তুচ্ছ লোহার তালাই হল বড় আর মানুষের বুদ্ধিটা একেবার মিথ্যা হয়ে যাবে! যাকগে সেকথা। তালা আটা থাকলেও দরজায় গৃহপ্রবেশের উপায় আমার জানা আছে।
কিরীটী নিঃশব্দে একখানি চেয়ারের উপরের উপবেশন করে গা এলিয়ে দিল।
হ্যাঁ, নিজেকে এমনি করে শিথিল না করতে পারলে কি গল্প জমে কখনও,-বিশেষ এমনি নিশুতি রাতে!…নিশুতি রাত। শুধু আবছা রহস্যময় চাঁদের আলো! কেউ কোথাও জেগে নেই, সবাই ঘুমিয়ে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই কেন? কেন-কেন আমি ঘুমোতে পারি। না? চোখ বুজলেই একটা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা যেন আমায় অষ্টবাহু মেলে অক্টোপাশের মত আঁকড়ে ধরে! শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আমি উঠে বসি শয্যার উপরে। শুধু রক্ত-তাজা লাল টকটকে রক্ত যেন অজস্র ঝরনার মত আমার সর্বাঙ্গে আগুন ছড়াতে থাকে। বুকের মধ্যে একটা শয়তান মোচড় দিয়ে ওঠে। একটা লালসা, একটা বন্য বর্বর ক্ষুধা দেহের রক্তবিন্দুতে যেন দানবীয় উল্লাসে নাচতে থাকে। আমি এই হাত দিয়ে গলা টিপে মানুষ খুন করি। এই যে দেখছেন তীক্ষ্ণ ধারালো উপরের দুটো দাঁত, এর সাহায্যে তাজা মানুষের মাংস আমি ছিড়ে খাই। আপনাদের বর্তমান রহস্যের মেঘনাদ, নরখাদক রাক্ষস আমিই। আমাকে ধরুন, আমায় খুন করুন!…আগন্তুক গভীর উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগল।
কিরীটী নির্বাক হয়ে শুধু বসে রইল।
হঠাৎ আগন্তুক সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, পারলেন না, হেরে গেলেন। জানি কেউ আমায় ধরতে পারবে না। আমার এই রাক্ষসের মুখোশটা টেনে খুলে কেউ আমায় চিনতে পারবে না। কিন্তু আমি অপেক্ষা করব; তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করব কিরীটী! খুলে রাখব। আমার ঘরের দুয়ার বন্ধু। তুমি এসে প্রবেশ করবে বলে। তারপর দুটি হাত তোমার সামনে প্রসারিত করে দিয়ে বলব, বন্ধু! এই আমাকে ধর! হার মেনেছি!