আগন্তুক তার বলিষ্ঠ মুষ্টিতে গাড়ির হ্যাণ্ডেলটা চেপে ধরে কর্কশ গলায় বললে, কেন?
যুবক জবাব দিল, কেন আবার কী, দেখছেন না সব ঠেসাঠেসি করে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, অন্য কামরা দেখুন।
দেখেছি, সব গাড়িই সমান। যেতে হবে আমাকেও। আগন্তুক জবাব দিল।
কামরার ভিতর থেকে কে একজন জবাব দিলেন, যাবেন তো, কিন্তু ঢুকবেন কোথায়? দেখছেন না তিলমাত্র জায়গা নেই?
আগন্তুক বললে, জায়গা করে নিতে হবে।
এবার একজন রুখে এল, আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি, বলছি জায়গা নেই তবু ঝগড়া করবেন, দেখুন না অন্য কোন গাড়িতে!
এমন সময় গাড়ির শেষ ঘণ্টা বাজল, গার্ড সবুজ আলো দেখিয়ে হুইসেল বাজাল।
আগন্তুক বলিষ্ঠ হাতে সামনের দণ্ডায়মান ভদ্রলোককে একটু ঠেলে কোনমতে গাড়িতে উঠে দাঁড়াল।
গাড়ি তেমনি চলতে শুরু করেছে।
গাড়ি প্রত্যেক স্টেশনে দাঁড়াবে।
ক্রমে স্টেশনে স্টেশনে যাত্রীরা নেমে যেতে লাগল।
ব্যারাকপুরে এসে গাড়ি খালি হয়ে গেল প্রায়।
গাড়িতে তখন আগন্তুক ও যুবকটি।
অন্ধকার শীতের রাত্রি।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
যুবক আর আগন্তুক গাড়ির দুপাশে দুখানা সিট অধিকার করে বসে।
হঠাৎ একসময় আগন্তুক তার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, মুখে তার জ্বলন্ত সিগারেট।
যুবক আনমনে খোলা জানলা-পথে অন্ধকার প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নীরবে বসে।
আগন্তুক নিঃশব্দে এসে যুবকের সামনে দাঁড়াল ও ডান হাতখানি যুবকের কাঁধের উপরে রাখল।
কে? চমকে যুবক মুখ ফেরাল।
চাপা গম্ভীর গলায় আগন্তুক বললে, চুপ! আস্তে-কী নাম তোমার?
আগন্তুকের মুখে জ্বলন্ত সিগারেটের স্তিমিত আলোয় তার উদ্ভাসিত মুখের দিকে সভয়ে তাকালো যুবক।
লোহার মত শক্ত একখানা মুষ্টি যেন যুবকের কাঁধের মাংসপেশীকে সাঁড়াশীর মত আঁকড়ে ধরেছে।
উঃ, কী ভয়াবহ আগন্তুকের মুখখানা!
গোল-গোল দুটি চোখের দৃষ্টি সিগারেটের আগুনের আলোয় যেন কী এক অস্বাভাবিক মৃত্যুক্ষুধায় লকলক করছে। সামনের দিকে উপরের পাটির বড় বড় দুটো দাঁত নীচের পুরু ঠোঁটটার উপরে যেন চেপে বসেছে।
একজোড়া পাকানো গোঁফ।
মাথার টুপিটা একদিকে হেলানো।
মুখের খানিকটা অন্ধকারে অস্পষ্ট, খানিকটা স্তিমিত আলোয় ভয়ঙ্কর একটা নিষ্ঠুরতায় শক্ত কঠিন হয়ে উঠেছে।
যুবকের শরীরে স্নায়ু বেয়ে যেন তীব্র ভয়ের স্রোত সিরসির করে বয়ে গেল; সহসা সে একটা দীণ ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল।
আগন্তুক হাঃ হাঃ হাঃ করে তীব্র বাজের মত হেসে উঠল। সেই ভয়ঙ্কর হাসির শব্দ যেন অদ্ভুত একটা বিভীষিকায় চলন্ত গাড়ির শব্দকে ছাপিয়ে অন্ধকার কামরার মধ্যে প্রেতায়িত হয়ে উঠল।
আগন্তুক তখন দুহাত দিয়ে যুবকের কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। একটা গোঁ গোঁ শব্দ।…
যুবকের সমস্ত মুখখানা নীল হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো যেন ঠিকরে আঁখিকোটর থেকে বের হয়ে আসতে চায়।
আগন্তুকের সমস্ত মুখাবয়বের উপরে একটা পাশবিক নিষ্ঠুরতার পৈশাচিক আনন্দের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে।
দেখতে দেখতে আগন্তুকের বলিষ্ঠ মুষ্টির নিষ্ঠুর লৌহপেষণে হতভাগ্য যুবক গাড়ির গদিতে এলিয়ে পড়ল।
আগন্তুক আবার খলখল করে পৈশাচিক হাসি হেসে উঠল, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! মরেছে! নিঃশেষে মরেছে!
সহসা হঠাৎ পাগলের মত যুবকের বুকের উপরে ঝাপিয়ে পড়ে তীক্ষ্ণ নখরাঘাতে যুবকের বুকের জামা ছিঁড়তে লাগল। গাড়ির গতি মন্থর হয়ে আসছে না!
পাগলের মতই আগন্তুক যুবকের পেশল উম্মুক্ত বক্ষের দিকে তাকাল।
চোখের দৃষ্টিতে একটা দানবীয় লালসা যেন হিলহিল করে উঠল।
যেমন সে নীচু হয়ে যুবকের বুকের মাংসে তার ধারাল দাঁত বসিয়েছে, খানিকটা তাজা রক্ত তার জিহ্বায় এসে লাগল।
যেন একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ে শিকারের বুকে চেপে বসেছে! সহসা এমন সময় গাড়িটা থেমে গেল।
কিন্তু দানবের সেদিকে লক্ষ্য নেই।
আচমকা একটা টর্চের আলোর রক্তিম আভা দানবটার উপরে এসে পড়ল—সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার-ভূত! ভূত!
চকিতে দানবটা পাশের দরজা খুলে অন্ধকারে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এদিকে সেই চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আশেপাশের কামরা থেকে লোক এসে জড়ো হয়েছে। ব্যাপার কী! ব্যাপার কী মশাই!
ঐ কামরার মধ্যে ভূতে মানুষ খাচ্ছে! কে একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে বললে। আর একজন বললে, স্বপ্ন দেখছেন না তো মশাই!
একজন মন্তব্য করলে, গাঁজায় দম চড়িয়েছেন নাকি? কিন্তু সত্যি সত্যি যখন সকলে বাক-বিতণ্ডার পর গার্ডের সঙ্গে আলো নিয়ে কামরাটার মধ্যে এসে প্রবেশ করল তখন সেখানকার সেই ভৌতিক দানবীয় দৃশ্য দেখে সকলেই চমকে উঠল।
হতভাগ্য যুবকের মৃতদেহ তখনো কামরার গদীর উপরে লুটিয়ে পড়ে আছে। বুকের জামা ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। ডান দিককার বুকের মাংস কে যেন নিষ্ঠুরভাবে দাঁত দিয়ে বলে ছিড়ে নিয়ে গেছে।
G.I.P-র পুলিস এল, স্টেশন মাস্টার এলেন, লাশ স্টেশনে নামানো হল, গাড়ি আবার চলল।
পরের দিন সমস্ত দৈনিকে বড় বড় হরফে প্রকাশিত হয়েছে দেখা গেল–
ভয়ঙ্কর নরখাদক দানবের আবিভাব! এই শহরের বুকে এই সভ্য যুগে! হতভাগ্য যুবকের পৈশাচিক মৃত্যু! সেই অদৃশ্য ভয়ঙ্কর নরখাদকের হাতে এই তৃতীয় ব্যক্তির শোচনীয় মৃত্যু!
শহরবাসী অবগত আছেন কয়েক মাসের মধ্যে আলিপুরের অবসরপ্রাপ্ত সুপার ও ডা এন. এন. চৌধুরীর এইভাবে মৃত্যু হয়। তারপর আর একজন বিখ্যাত ডাক্তার অমিয় মজুমদারের মৃত্যু হয়। এই যে শহরের বুকে অবাধে নরহত্যালীলা চলেছে এর শেষ কোথায়? ঘটনাগুলি হতে স্পষ্টই মনে হয়, বুঝিবা কোন নরখাদক এই শহরের বুকে হত্যালীলা করে বেড়াচ্ছে। আবার কি সেই বন্য বর্বর যুগ ফিরে এল? পুলিসের কর্তৃপক্ষ কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন? সমগ্র শহরবাসী আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। এইভাবে যদি নরখাদক আরও কিছুদিন এই শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, তবে যে শহরবাসীর মধ্যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তা কি পুলিসের কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছেন না? ইত্যাদি ইত্যাদি।