কলকাতার পুলিসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও মহীতোষের যথেষ্ট হৃদ্যতা দেখা যায়।
বিখ্যাত গোয়েন্দা সুপার সুব্রত রায় মহীতোষের একজন পরম বন্ধু।
প্রায়ই সুব্রত মহীতোষের ওখানে আসে ও নানা গল্পগুজবে সময় কাটায়।
সেদিন সন্ধ্যার দিকে মহীতোষের লাইব্রেরী ঘরে বসে দুজনে-সুব্রত ও মহীতোষ গল্প করছিলেন। মহীতোষ বলছিলেন, মানুষের মন সত্যই বড় বিচিত্র সুব্রতবাবু। মানুষ যে ঠিক কী চায় ও কী চায় না তা হয়ত নিজেই সে অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না। আসলে মানুষের মনের মধ্যে দুটো সত্তা আছে, তার মধ্যে একটা থাকে জেগে, অন্যটা থাকে ঘুমিয়ে।
অথচ সবচাইতে আশ্চর্য এই যে, ঘুমন্ত সত্তাকে অবহেলা করবার মত তার মনের জাগরিত আর কোন ক্ষমতাই নেই। অলক্ষ্যে সেই ঘুমন্ত সত্তা প্রভাব বিস্তার করে মানুষের মনের উপরে। এই ঘুমন্ত সত্তাকে ভুলে থাকবার কি চেষ্টাই না আমরা করি!
সুব্রত জবাব দিল, অবিশ্যি যা আপনি বলছেন সবই স্বীকার করি কিন্তু তবু মানুষের সংযম শিক্ষা ও জম্মগত সংস্কার চিরদিনই কি সেই ঘুমন্ত সত্তার উপরে প্রভাব বিস্তার করে না মিঃ চৌধুরী?
স্বীকার করি করে, কিন্তু ঐ যে বললেন জম্মগত সংস্কার-ওটাকে আমি তত importance দিই না। সেটা প্রকৃতি ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক নিয়ে গড়ে ওঠে।
আসলে জম্মগত সংস্কার ওটা একটা মন ভুলানো কথা। মনের সত্যিকারের জোর থাকলে ওটাকে আমরা অনায়াসেই ইচ্ছামত গড়ে তুলতে পারি। তাছাড়া মানুষের জন্মের জন্য তো মানুষ দায়ী নয় সুব্রতবাবু। স্ট্যালিন মুচির ঘরে জম্মেও স্ট্যালিনই হয়েছে, হিটলার হিটলার হয়েছে, জন্ম তত তাদের চরিত্রকে ধরে রাখতে পারেনি।
সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, পারেনি সত্যি বটে, তবু রক্তের ঋণকে কেউ কোনদিন অস্বীকার করতে পারেনি ও পারবে না। যে সংস্কার তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের প্রতি রক্ত-বিন্দুতে সংক্রামিত হয়েছে তার কাছে ধরা সে দিতে বাধ্য-ইচ্ছায়ই হোক বা অনিচ্ছায়ই হোক।
সুব্রতর কথায় মহীতোষবাবু হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন। রক্তের ঋণ! বেশ কথাটা কিন্তু মিঃ রায়। হ্যাঁ ভাল কথা, আপনি একদিন বলেছিলেন আপনার বন্ধু কিরীটী রায়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন, নিয়ে আসুন না তাঁকে একদিন এখানে। ক্রিমিনোলজি (অপরাধ-তত্ত্ব) সম্পর্কে চিরকালই আমার একটা উৎসাহ ও আগ্রহ আছে। অপরাধ-জগতের বিচিত্র ভাবধারা-তার সঙ্গে পরিচয় হবার মধ্যে বুঝি একটা ভয়ঙ্কর মাদকতা আছে।
***
রাত্রি দশটা পাঁচ মিনিটে একটা রাণাঘাট লোকাল ট্রেন আছে। যেসব অফিসফেরত বাবুর দল প্রথম দিককার লোকাল ট্রেনগুলোতে না গিয়ে এই শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরেন, তাঁদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।
প্রত্যহই এই ট্রেনটায় বিশেষ ভিড় হয়। অনেক খুচরো ও পাইকারী ব্যাপারী, যারা কলকাতার হাটে-বাজারে শাকসজী, দুধ, ছানা প্রভৃতির বেচা-কেনা করে তাদের সংখ্যাও কম নয়।
একে শীতের ধোঁয়ায় মলিন রাত্রি, তার উপরে সেই সন্ধ্যা থেকে সারাটা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শিয়ালদহের তিন নম্বর প্ল্যাটফরমে রাণাঘাট লোকাল দাঁড়িয়ে আছে।
ট্রেন ছাড়তে তখনও প্রায় বিশ মিনিট বাকি।
প্ল্যাটফরমের স্তিমিত আলোয়, নানাবিধ যাত্রী ও ফেরিওয়ালাদের গুঞ্জনে প্ল্যাটফরমটিতে অদ্ভুত এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
চাই পান, পান ফ্রিগেট, গরম চা, সলটেড বাদাম…
ক্লান্ত অফিস-ফেরতা বাবুর দলের শ্লথ গতি, কারও হাতে ঝুলানো একটি ইলিশ মাছ, কারও হাতে আগরপাড়ার ক্যাম্বিসের ব্যাগে শিয়ালদহের বাজার থেকে কেনা তরিতরকারি, কারও বগলে ভাঁজ করা সেদিনকার দৈনিক পত্রিকাখানা, কারও হাতে রুমালে বাঁধা বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু খাবার।
ব্যাপারীদের কাঁধে শূন্য ঝাকা ও কলসী, মাতায় মলিন গামছা জড়ানো।
সকলেই ট্রেন ধরবার জন্য ব্যস্ত।
আলোহীন অন্ধকার বগাগুলোর মধ্যে ঠেঠেসি করে যাত্রীরা সব বসে, কেউ গল্প করছে, কেউ বিড়ি বা সিগারেট ফুঁকছে। কেউ বা পাশের যাত্রীর সঙ্গে যুদ্ধের খবর আলোচনা করছে।
যুদ্ধ লেগেছে সন্দেহ নেই।
যুদ্ধ। যুদ্ধ! যুদ্ধ!
একটা প্রবল বন্যা যেন ছুটে এসেছে ধনী, নিধন, সাধারণ গৃহস্থ প্রত্যেকের জীবনে।
ধ্বংসের আগুন জ্বলছে দিকে দিকে।
প্রত্যেকের ঘর ও বাহির সেই আগুনের শিখায় ঝলসে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
মানুষের নীরব আর্ত চিৎকার জগতের বাতাস ভারী করে তুলেছে।
ঘরে আহার নেই, পরিধানে বসন নেই, পাবলিশার্সদের কাগজ নেই। প্রেসম্যান বই ছাপতে পারে না, দপ্তরী বই বাঁধতে পায় না। যুদ্ধের গোগ্রাসী ক্ষুধার অনলে সব আহুতি দিচ্ছে কিন্তু তবু মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা চলছে বয়ে। আশা, আকাঙক্ষা, দুঃখ, শোক, হাসি সবই আছে। যুদ্ধ যদি আরও দশ বছর চলে এমনিই সব চলবে।
****
ট্রেন ছাড়বার আর মাত্র মিনিট দশেক বাকি আছে।
একখানি সেকেণ্ড ক্লাস কামরা। সেখানেও ভিড়ের অন্ত নেই।
সমগ্র দেহ কালো একটা ভারী ওভারকোটে ঢাকা, মাথায় কালো ফেল্ট হ্যাট একজান যাত্রী এসে কামরার সামনে দাঁড়াল।
দরজার উপরেই একটি কেতাদুরস্ত যুবক দাঁড়িয়েছিল, তিলমাত্র বসবার স্থান নেই, সাতআটজন মাঝখানের জায়গাটুকুতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
যুবকটি বললে, এ গাড়িতে জায়গা নেই, স্যার।