কে বলে রে অমৃত সুদূর স্বর্গেতে,
চেয়ে দেখ ভরা এই চায়ের পাত্রেতে!
ভোরের আলো সবে ফুটি-ফুটি করছে। রাতের বিলীয়মান অন্ধকারের অস্বচ্ছ যবনিকাখানি একটু একটু করে নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে।
একটা মৃদু শীতল হাওয়া ভোরের বারতা নিয়ে খোলা জানলা-পথে ঝিরঝির করে এসে প্রবেশ করল।
সুব্রত আবার প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী বাধা দিয়ে বলে উঠল, লোকটা লম্বায় প্রায় ছফুট মত হবে। বলিষ্ঠ পেশল গঠন। দ্রুত চলুন। পরিধানে কালো রঙের গরম সার্জের সুট ছিল। মাথায় কালো রঙের ফেল্ট টুপি। মুখে একজোড়া বড় পাকানো গোঁফ। সামনের দাঁত দুটো উঁচু, নীচের ঠোঁটের উপরে চেপে বসেছে।
তীক্ষ্ণ শিকারী বিড়ালের মত খর-অনুসন্ধানী হিংস্র গোল গোল দুটি চোখ।– মৃদু গ্যাসের আলোয় যেন ভয়ঙ্কর এক শয়তানের প্রতিমূর্তির মতো দেখাচ্ছিল। এখনও যেন তার ক্ষুধিত চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমার চোখের উপর ভাসছে।
মানুষ-আমাদের মতই মানুষ? তবে?
হ্যাঁ মানুষ, তবে আমাদের মত কিনা জানি না। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দিল।
***
বালিগঞ্জ রেল স্টেশনের ধারে কাঁকুলিয়া রোডে প্রকাণ্ড ইমারততুল্য তিনতলা সাদারঙের একখানা বাড়ি।
বাড়ির লৌহ-ফটকের একপাশে কালো পাথরের বুকে সোনালী জলে খোদাই করে লেখা মহানির্বাণ, অন্যপাশে নামফলকে লেখা মহীতোষ রায়চৌধুরী।
মাত্র বছর ছয়েক হল মহীতোষবাবু কলকাতার এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছেন।
মহীতোষবাবুর পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয় অধিবাসীদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না।
কিন্তু অগাধ ধনশালী, চিরকুমার, উচ্চশিক্ষিত, অত্যন্ত অমায়িক বৃদ্ধ মহীতোষ রায়চৌধুরীকে শ্রদ্ধা করত না শহরে এমন একটি লোক ছিল না।
অনাথ আতুর কাঙালের জন্য তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকার লৌহদ্বার সর্বদাই খোলা থাকত।
প্রার্থীকে কখনও কেউ কোনদিন মহীতোষের দ্বার হতে রিক্তহস্তে ফিরতে দেখেনি।
স্কুলের চাঁদার খাতায়, স্থানীয় লাইব্রেরী, সর্বজনীন উৎসবাদি নানা প্রতিষ্ঠানে তাঁর চাঁদার অংশটা সকলকে ডিঙিয়ে যেত।
মুক্তহত উদার প্রকৃতির সদাহাস্যময় মহীতোষ সকলের বন্ধু। এই সব নানাবিধ গুণাবলীতেই শহরবাসীরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর নামকরণ করেছিল রাজা মহীতোষ।
মহীতোষের আধিপত্যও ছিল যথেষ্ট।
স্থানীয় স্কুল সমিতির প্রেসিডেন্ট, লাইব্রেরীর প্রেসিডেন্ট, সভা-সমিতির প্রেসিডেন্ট।
কোন উৎসবই মহীতোষকে বাদ দিয়ে চলে না।
কর্পোরেশনের একজন প্রতিপত্তিশালী কাউনসিলার মহীতোষ। গুজব সামনের মেয়র নির্বাচনে তিনিও একজন প্রার্থী।
মহীতোষের বয়স যে ঠিক কত সেটা অনুমান করা একটু বেশ কঠিন।
দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় ফুট। পেশল বক্ষ, বলিষ্ঠ গঠন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। গোলগাল সদাচঞ্চল দুটি চোখ, দৃষ্টিতে বুদ্ধির প্রখ্য যেন ঠিকরে বের হয়। কপালের দুপাশে একটুখানি টাক দেখা দিয়েছে। ঘন কৃষ্ণকালো চুলের মধ্যে দু-চারটে পাকা চুলও দেখা যায়। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।
মুখের গঠন তীক্ষ্ণ।
নীচের ঠোঁটটা একটু বেশী পুরু ও ভারী। মুখে সর্বদাই যেন খুশীর একটুকরো হাসি জেগে আছে।
সংসারে তাঁর আপনার বলতে কেউ নেই। তবে অনাত্মীয় গোয্যের দল তাঁকে আপনার জনের মত সর্বদাই আঁকড়ে ধরে আছে।
মহীতোষ মিতাহারী, সংযমী ও মিতভাষী।
উপরের তলায় দুখানি ঘর তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের জন্য, বাড়ির বাকি ঘরগুলিতে অনাত্মীয়ের দল ভিড় করে আছে।
ঠাকুর ও চাকর অনেকগুলি।
উপরে তাঁর নিজস্ব দখলে যে ঘর দুখানি, তার একখানি তাঁর শয়নঘর, অন্যখানি লাইব্রেরী। শয়নঘরখানি আকারে মাঝারি।
ঘরের এক কোণে একটা স্পিংয়ের খাটে নিভাঁজ শয্যা বিছানো। খাটের সামনেই একটি টিপয়ে একটা সুদৃশ্য নামী টাইমপিস ও টেলিফোন।
ঘরের মধ্যে প্রকাণ্ড একখানা এনলার্জড় ফটো। তাঁর পিতার।
ঘরে আর কোন আসবাবপত্র নেই। মেঝেতে দামী কাশ্মীরী কার্পেট বিছানো।
শয়নঘরের সংলগ্ন ছোট একটি ঘর আছে, তাতে মহীতোষের আবশ্যকীয় জামাকাপড় ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্রে বোঝাই।
ঘরটি সর্বদাই প্রায় তালা-বন্ধ থাকে।
শয়নঘরের সংলগ্ন বাথরুম আছে।
লাইব্রেরী ঘরখানি আকারে প্রশস্ত। মেঝেটায়ও দামী পুরু কার্পেট বিছানো। আধুনিক কেতাদুরন্ত ভাবে সুদৃশ্য সোফায় সজ্জিত। অদৃশ্য বৈদ্যুতিক বাতিদান থেকে ঘরখানি রাত্রে আলোকিত করার ব্যবস্থা। দু-তিনটি সিলিং ফ্যান। ঘরের চারপাশে সুদৃশ্য কাঁচের আলমারিতে নানা শাস্ত্রের সব বই।
ঘরের একপাশে একখানা সুদৃশ্য সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার উপরে কাগজপত্র, ফাইল প্রভৃতি সাজানো।
সামনে একখানা রিভলভিং গদী-আঁটা চেয়ার।
মহীতোষের বাড়িতে তাঁর দর্শনার্থীর ও দয়াপ্রার্থীর সদাই ভিড়।
কেউ এলে মহীতোষ তার সঙ্গে এই লাইব্রেরী ঘরে বসেই কথাবার্তা বলেন।
অতিথি-অভ্যাগতদের আদর-আপ্যায়নের কোন ত্রুটিই মহীতোষের বাড়িতে হয় না।
সাধারণতঃ সারাদিন ও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত মহীতোয সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেন।
সাড়ে সাতটার পরে কেউ এলে হাজার প্রয়োজনীয় কাজ হলেও তিনি কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেন না।
বাড়ির লোকেরা বলে, মহীতোষ নাকি অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করেন।
মহীতোষের নিজস্ব কাজকর্ম যা কিছু তার প্রিয় পাহাড়িয়া ভৃত্য ঝুমনই করে।