আমার জ্যেঠামশাই। বিখ্যাত ডাঃ অমিয় মজুমদার।
উনিই ডাঃ অমিয় মজুমদার?
হ্যাঁ।
আপনার নাম?
সুশীল মজুমদার।
এ বাড়িতে আর কে আছেন?
জ্যেঠামশাই ব্রহ্মচারী, চিরকুমার। আমি ছোটবেলায় মা-বাপকে হারিয়েছি, জ্যেঠামশাইয়ের কাছেই মানুষ। যুবকের চোখদুটি ছলছল করে এল। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।
এরা সব?
চাকরবাকর, ঠাকুর, সোফার।
ব্যাপারটা কখন জানতে পারলেন?
আমি জ্যেঠামশাইয়ের পাশের ঘরেই ঘুমোই। জ্যেঠামশাই রাত্রে সাধারণতঃ অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করেন। আজও বোধ হয় তাই করছিলেন। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমটা বুঝতে পারিনি।
আবার চিৎকার শোনা গেল। তখন মনে হল যেন পাশের ঘর থেকেই আসছে, ছুটে ঘরের বাইরে চলে আসি। জ্যেঠামশাইয়ের ঘরের দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখি দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।
অনেক কষ্টে ঠেলাঠেলি করে ও চিৎকার করেও যখন দরজা খুলতে পারছি না, এমন সময় সহসা দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল এবং কে যেন অন্ধকারে ঝড়ের মত আমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েই ছুটে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। ততক্ষণে চাকরবাকরেরাও গোলমাল শুনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। কিন্তু লোকটা সকলকে যেন ঝড়ের মতই ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে আচমকা অদৃশ্য হয়ে গেল।
দেখেছিলেন লোকটা দেখতে কেমন?
ভাল করে দেখতে পাইনি, তবে মনে হল যেন কালো পোশাক পরা।
কিরীটী একবার চমকে উঠল। তবে কি…
এমন সময় বাইরের রাস্তায় মোটর থামবার শব্দ শোনা গেল।
একটু পরেই সিঁড়িতে কার জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
সুপার সুব্রত রায় আসছেন। কিরীটী বললে।
সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করল। হ্যালো কিরীটী! ব্যাপার কি?
কিরীটী হাত তুলে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, বস সুব্রত।
ইনি শ্রীযুক্ত সুশীল মজুমদার।..কিরীটী একে একে সুব্রতকে সমস্ত ব্যাপার খুলে বললে।
সুব্রত খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বললে, হুঁ। তারপর সুব্রত পাশের ঘরে গিয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখল। সমস্ত বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল সিন্দুকটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, বন্ধই আছে, কিছু চুরি যায়নি।
ততক্ষণে কয়েকজন লালপাগড়ীও এসে গেছে।
বাড়িটা বেশ প্রশস্ত।
উপরে নীচে সর্বসমেত আটখানি ঘর।
দেখা গেল বৈঠকখানায় একটা কাঁচের জানলা ভাঙা।
জানালার দুপাশে দুটো বাড়ির মাঝখানে একটা সরু গলিপথ।
আশেপাশের বাড়ির অনেকে তখন ঘুম ভেঙে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
বোঝা গেল ওই জানালা-পথেই খুনী বাড়িতে প্রবেশ করেছিল।
বাড়ির ঠাকুর, চাকর, সোফারের জবানবন্দি নিয়ে মৃতদেহ ময়নাঘরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে, দুজন লালপাগড়ী বাড়িতে মোতায়েন রেখে কিরীটী ও প্রত যখন ডাঃ মজুমদারের বাড়ি ছেড়ে পথে বের হয়ে এল রাত্রি তখন পৌনে চারটে।
সুব্রত কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, চল্ তোকে পৌঁছে দিয়ে যাই।
দুজনে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ছুটে চলল।
গাড়িতে আর কোন কথাবার্তা হল না।
গাড়ি এসে টালিগঞ্জে কিরীটীর বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বাইরের ঘরে এসে দুজনে বসে জংলীকে দু কাপ চায়ের আদেশ দিল।
বাইরের ঘরে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় কিরীটী পকেট থেকে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া রুমালটা বের করতেই চমকে উঠল।
সমস্ত রুমালটাই চাপ চাপ রক্তের লাল দাগে ভর্তি।
সুব্রত বিস্মিত ভাবে কিরীটীর হস্তধৃত রুমালটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কী ওটা?
কিরীটী চিন্তিতভাবে জবাব দিল, একটা রক্তমাখা রুমাল।
হুঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু কোথায় পেলি ওটা?
রাস্তায় কুড়িয়ে, একজন তাড়াতাড়িতে রাস্তায় ফেলে গেছে।
মানে?
কিরীটী তখন একে একে সমস্ত কথা খুলে বলল সুব্রতকে।
ধরতে পারলি না লোকটাকে?
না। কিন্তু আমি ভাবছি, এ কি সত্যই সম্ভব? মানুষে মানুষের মাংস খায়? মনে পড়ে দন্ত-চিকিৎসক ডাঃ চৌধুরীর রহস্যময় মৃত্যুর কথা?
কিরীটী বলতে লাগল, দুটো কেসই একেবারে হুবহু মিলে যাচ্ছে না কি?
কি বলতে চাস তুই? প্ৰত অধীরভাবে প্রশ্ন করলে।
ঠিক যা তুই ভাবছিস তাই বলতে চাই, তার চাইতে বেশী কি আর! এই বর্তমান সভ্যতার যুগেও ক্যানিবালিজিম চলে?
অ্যাঁ!
হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী? আদিম যুগে মানুষ যখন ছিল বর্বর, তখন নাকি মানুষে মানুষ খেত। কিন্তু গুহা ছেড়ে তো অনেকদিন তারা লোকালয়ে এসে ঘর বেঁধেছে। হয়েছে সভ্য পরিপাটি। তবে এর অর্থ কি? আর তাছাড়া যদি বলি একটা হোমিসাইডাল ম্যানিয়া, এমনি করে খুনের নেশায় মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে!
তা কি সম্ভব?
অসম্ভব বলে এ দুনিয়াতে কিছুই নেই ভাই। স্পষ্ট আমি দেখেছি লোকটাকে এই রুমালটা দিয়ে মুখ মুছতে।
কিরীটী ভাল করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রুমালটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। সাধারণ ক্যালিকো মিলের একটা রুমাল সাদা রঙের।
রুমালের কোথাও কোন বোপর বাড়ির চিহ্ন নেই। বোধ হয় একেবারে নতুন। একবারও নিশ্চয়ই ধোপা-বাড়ি দেওয়া হয়নি।
তবে রুমালের এক কোণে লাল সুতোয় ছোট্ট করে ইংরাজী K অক্ষরটি তোলা।
লোকটা দেখতে কেমন কিরীটী? ব্রত প্রশ্ন করলে।
এমন সময় জংলী দুহাতে দুটো ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
সামনে একটা টিপয়ের উপরে কাপ দুটো নামিয়ে রেখে জংলী ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
একটা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে কিরীটী চুমুক দিয়ে মৃদু একটা শব্দ করলে, আঃ!