মহীতোষ সম্পর্কে খোঁজ করতে করতে জানতে পারি, কলকাতা শহরে কেউ তার পাঁচ বছর পূর্কোর জীবনের কোন কথাই জানেনা এবং জানবার চেষ্টাও করেনি। লোকটা যেন হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। ডাঃ অমিয় মজুমদারের খুনের দিন মহীতোষের চোখের যে দৃষ্টি আমি সহসা দেখেছিলাম, অন্তরের অন্তস্থলে তা আমার গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। এখানে মহীতোষের চোখের তারার সেই দৃষ্টিই খুঁজে পেয়েছিলাম সেইদিন যেন। আমি মহীতোষের পূর্ব-জীবনের সন্ধান করতে শুরু করলাম এবং কেমন করে সব কথা আমি অনুসন্ধানের ফলে জানতে পেরেছিলাম তাও আমি বলব।
তোমার আহ্বানে আমি যখন পুরীতে এলাম, প্রথম দিনই হঠাৎ দূর থেকে বারীনবাবুকে দেখে আমি যেন চমকে উঠলাম। মুখে সাদা দাড়ি, চোখে রঙীন কাঁচের চশমা, কেবলই যেন মনে হতে লাগল এমনি লম্বা চেহারার একজনকে কোথায় দেখেছি। এমনি চলার ভঙ্গি, এমনি কণ্ঠস্বর, এমনি হাসি। কেন যেন কেবলই আমার মনে হত বৃদ্ধের ছদ্মবেশের অন্তরালে যেন কোন একটা পরিচিত চেনা লোক লুকিয়ে আছে। সহসা একদিন এমন সময় আচমকা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য বারীনের চশমাহীন চোখ আমি তার অজান্তেই দূর থেকে দেখেছিলাম। সে দৃষ্টি তো আমার ভুলবার নয়, চকিতে মনের কোণে সন্দেহের বিদ্যুৎ জেগে উঠল। আমি সতর্ক হয়ে উঠলাম এবং সেই থেকেই একটা চিন্তা আমার মনে কেবলই ঘুরপাক খেতে লাগল, এই ছদ্মবেশে মহীতোষ এখানে কেন?…
ইতিপূর্বে মহীতোষের পূর্ব ইতিহাস আমি অনেকটা অনুসন্ধানের ফলে সংগ্রহ করেছিলাম। মহীতোষের আসল নাম নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল। ওর জন্ম হয় সামান্য এক ঘাতকের ঘরে এবং সে কথা আমি জানতে পারি ওর অনুপস্থিতিতে একদিন রাত্রে ওর শোবার ঘরে হানা দিয়ে, দেওয়ালে টাঙানো এক এনলার্জড় ফটো দেখে। ওর ঠাকুর্দা ছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ঘাতক। ছবিট তারই। যেসব হতভাগ্যদের ফাঁসির হুকুম হত, তাদের ফাসির দড়িতে লটকাবার কাজ করত প্রথমে ওর ঠাকুন্দা, পরে ওর পিতা। পুরুষানুক্রমে ওরা ওই ঘাতকের ব্যবসা করত। ওর বাপ রামশরণ কাঞ্জিলালকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পিতার ব্যবসা গ্রহণ করতে হয়েছিল শিক্ষার অভাবে। কিন্তু বোধ হয় নিরঞ্জনের বাপ সে কাজ ঘৃণা করত এবং সেই জন্যই হয়ত সে তার পুত্রকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে।.।
নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল কলিকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে এম. এ. পাস করে পাটনায় প্রফেসারী করত। কিন্তু রক্তের যা ঋণ, তার দাবি বড় ভয়ানক। সে ভয়ঙ্কর পৈশাচিক কর্মের অনুভূতি তার পিতা ও ঠাকুর্দার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত ছিল, সেটা নিরঞ্জন কাঞ্জিলালের রক্তেও সংক্রামিত হয়েছিল। খুন করবার একটা দুর্জয় লালসা ও পৈশাচিক অনুভূতি নিরঞ্জনের অবচেতন মনের মধ্যে প্রথমে ক্রমে ক্রমে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। সে তার শিক্ষাদীক্ষা সত্তেও সেই অবচেতন পশুমনের পৈশাচিক অনুভূতির কাছে আপনার অজ্ঞাতেই আপনাকে ধরা দিতে বাধ্য হয়েছিল। দুই পুরুষের রক্তের ঋণ তাকেও শোধ করতে হল। এ ছাড়া তার আর উপায় ছিল না এবং পরে সে এইভাবে সংক্রামিত হয়ে খুন করে একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করত।
একবার রাঁচি শহরে ওইভাবে কোন এক ভদ্রলোককে খুন করতে গিয়ে ও ধরা পড়ে, বিচারে ওর পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং ওকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। সেই সময় গগনেন্দ্রনাথ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের জেলার ছিলেন। যা হোক জেল থেকে মুক্তি পাবার পর নিরঞ্জন আরও দুর্বার হয়ে ওঠে। কিন্তু তার শিক্ষা হয়ত তার সেই অবচেতন প্রবৃত্তির সামনে এসে শিক্ষা ও প্রকৃতিগত পৈশাচিকতার সঙ্গে বাধায় সংঘর্ষ। অবশেষে শয়তানেরই হয় জয়। রক্তের ঋণ! রক্তের ঋণ! নিরঞ্জনের মুখ চেনা বলেই সেদিন গগনেন্দ্রনাথ ওই কথা বলেছিলেন। তাকে হয়ত হঠাৎ চিনতে পেরেছিলেন। তাই তার মুখ দিয়ে ওকথা বের হয়েছিল।
ছদ্মবেশেও নিরঞ্জন আপনাকে গগনেন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি এবং নিরঞ্জনও ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কেননা গগনেন্দ্রনাথকে ইহসংসার থেকে সরাবার মতলবেই সে পুরীতে তার পিছু পিছু ধাওয়া করে এসেছিল। ডাঃ অমিয় মজুমদারও পাটনায় প্রথম জীবনে ডাক্তারী করতেন ও হয়ত নিরঞ্জনকে চিনতেন। ডাঃ এন. এন. চৌধুরীও নিরঞ্জনের বাপকে ও তাকে চিনতেন। আলিপুরের সুপারও তাকে চিনতেন। নিরঞ্জন যখন ছদ্মনামে ছদ্মবেশে নতুন জীবন শুরু করল, তার স্বতই মনে হল তার চেনা লোকদের না সরাতে পারলে হঠাৎ হয়ত কোন একদিন তার আসল ও সত্যকারের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে। ফলে তার সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে। সেও একটা কথা এবং তার প্রকৃতিগত পৈশাচিকতা দুটোতে মিলে তাকে খুনের নেশায় মাতিয়ে তুলল।
কিন্তু সে আশা করেনি হয়ত যে, গগনেন্দ্রনাথ তার ছদ্মবেশের ভিতর থেকেও তাকে চিনতে পারবেন। ফলে নিরঞ্জন মরীয়া হয়ে উঠল এবং সুযোগ খুঁজতে লাগল। সুযোগ মিলেও গেল হঠাৎ। বারীনকে আমি সন্দেহ করলেও আমার মনে তখনও একটা সন্দেহের কাটা খচ খচ করছিল, কিন্তু তার evidence শোনবার পর আর কোন সন্দেহ রইল না। বুঝলাম এ সেই নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল এবং এই গগনেন্দ্রনাথের হত্যাকারী। কাঞ্জিলাল তার evidence-এ দুটি মাত্র ভুল করেছিল, যাতে করে আমার চোখের দৃষ্টি খুলে যায় ও সমস্ত সন্দেহ মিটে যায়। এক নম্বর হচ্ছে, সে পলায়নপর খানসামার বেশভূষার নিখুঁত description দিলে, অথচ তাকে চিনতে পারলে না এবং ভুলে গিয়েছিল যে সে চোখের ব্যারামের অজুহাতে রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করছে! ২ নং সে ভুল করে, সিরিঞ্জটা ডাক্তারের ঘরে রাখতে গিয়ে প্রথমেই কিশোরের ঘরে গিয়ে ঢোকে। সে আগে থাকতেই ওদিন কোন এক সময় ডাক্তারের ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ ও ঔষধের শিশিটা চুরি করেছিল, পরে খানসামার বেশ পরে গগনেন্দ্রনাথকে হত্যা করে তাড়াতাড়ি ভুল করে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘর ভেবে কিশোরের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ে। ডাঃ চক্রবর্তী তখন নিজের ঘরে শুয়ে জ্বরের ঘোরে গোঙাচ্ছেন। টের পাননি। কিন্তু ইনজেকশন দেবার সময় নিশ্চয়ই গগনেন্দ্রনাথ বাধা দিয়েছিলেন, এবং তাতেই গোলমাল শোনা যায়, যতীনবাবু ভেবেছিলেন গগনবাবু বুঝি নিত্যকারের মত ভৃত্যকে গালাগাল করছেন। পরে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করে বারীন যখন সিরিঞ্জ রেখে আসে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে, ডাঃ চক্রবর্তীও টের পাননি। তারপর বারীন তার খানসামার বেশ বদল করে নিজ বেশে এসে যতীনবাবুকে বেড়াতে যাবার জন্য আহ্বান করে ও দুজনে বেড়াতে বের হন। এবং বারান্দার সামনে দিয়ে যাবার সময় যতীনবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিরঞ্জন গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলবার অভিনয় করে। আসলে কিন্তু তার কথায় গগনেন্দ্রনাথ কোন জবাবই দেননি। কিন্তু অন্যমনস্ক যতীনবাবু সেটা বুঝতে পারে নি। তাছাড়া আগেই বলেছি, যতীনবাবুর দৃষ্টিশক্তি তত প্রখর নয়। বারীন নিজের মনগড়া ভাবে যতীনবাবুকে বুঝিয়ে দেয় ও বলে, দেখলেন, ভদ্রলোক জবাবটা পর্যন্ত ভাল করে দিলেন না! যতীনবাবুও তাই বুঝে চুপ করে রইলেন। তিনিও জানতেন যে গগনেন্দ্রনাথ অভদ্র ও বদমেজাজী। তা ছাড়া তিনি তো তখন জানতেন না যে গগনেন্দ্রনাথ মৃত!