কিরীটী আবার একটু থেমে বলতে লাগল, আবার ভেবে দেখা যাক গগনেন্দ্রনাথের হত্যার দিন বাইরের অন্য কোন লোক সে সময় হোটেলে ছিল কিনা। একমাত্র কিশোর ছাড়া রণধীরবাবুরা প্রত্যেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। গগনেন্দ্রনাথ একা তার ঘরের সামনে বারান্দায় চেয়ারের উপরে হেলান দিয়ে বসেছিলেন।
এবারে বারীনবাবু ও যতীনবাবুর কথাগুলো ভাল করে বিচার করে দেখা যাক। যতীনবাবুর দৃষ্টিশক্তিকে আমি প্রশংসা করতে পারি না। সে প্রমাণ আমি পেয়েছি যখন তিনি বলেছিলেন তার ঘরের অল্পদূর দিয়েই খানসামাটা প্রায় যখন ছুটে গিয়েছিল তিনি তাকে চিনতে পারেননি। তাছাড়া যতীনবাবু ও বারীনবাবুর ঘর পাশাপাশি; এক ঘরের লোক অন্য ঘরের লোককে দেখতে পারেন না। অথচ দুজনের ঘর থেকেই বারান্দায় যেখানে গগনেন্দ্রনাথ বসেছিলেন সেখানটা স্পষ্ট দেখা যায় এবং দুজনেই দেখেছিলেন একজন খানসামা গগনবাবুর কাছে গিয়ে কোন কারণে গালাগালি খেয়ে কিশোরের ঘরের দিকে ছুটে পালায়। বেলা চারটের সময় যতীনবাবু যখন নিজের ঘরে বসে বই পড়ছেন, বারীনবাবু তাকে বেড়াবার জন্য ডাকতে যান। বারীনবাবু তার জানবন্দিতে বলেন, একজন খানসামা গগনবাবুর কাছে যায়, তারপরই একটা গোলমাল শোনা যায়, খানসামাটা আবার কিশোরের ঘরের দিকে চলে যায়।
সহসা এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি তুমি বলতে চাও কিরীটী যে, হোটেলের একজন খানসামাই শেষ পর্যন্ত গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছে?
দাঁড়াও দাঁড়াও ডাক্তার, ব্যস্ত হয়ো না। আমি এখনও আমার বক্তব্য শেষ করিনি। খানসামা গগনবাবুর কাছে বকুনি (?) খেয়ে কিশোরের ঘরের দিকে ছুটে পালায়। যতীনবাবু ও বারীনবাবু দুজনেই তা দেখেছেন। অথচ আশ্চর্য, কেউই তার মুখ দেখতে পাননি বা চিনতে পারেননি। কিন্তু মজা এই যে, বারীনবাবুর ঘর থেকে বারান্দায় যেখানে গগনেন্দ্রনাথ বসেছিলেন তার দূরত্ব মাত্র একশত গজ।
বারীনবাবু খানসামার সাদা রঙের পোশাকের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি খানসামার পোশাকের অমন নিখুত বর্ণনা দিতে পারেন পলায়নপর খানসামাকে দেখে, অথবা তার মুখটা দেখতে পেলেন না বা তাকে চিনতে পারলেন না, এটা কি আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য নয়? অথচ তাঁর নাকি চোখের অসুখ, সর্বদা রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করেন। চোখে আলো সহ্য হয় না। সহসা ডাঃ চক্রবর্তী চিৎকার করে উঠলেন, তবে কি—তবে কি
কঠিন শান্ত কণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল, হ্যাঁ, তাই। বারীনবাবুই গগনেন্দ্রনাথের হত্যাকারী।…এবং শুধু গগনেন্দ্রনাথেরই নয়, ইতিপূর্বে কিছুকাল ধরে কলকাতা শহরে যে কয়েকটি নৃশংস অমানুষিক হত্যা বা খুন হয়েছে, সব কটি হত্যা-রহস্যেরই মেঘনাদ…বলতে বলতে কিরীটীর চোখ সৌম্য-শান্ত অদূরে উপবিষ্ট বারীনবাবুর প্রতি ন্যস্ত হল। সহসা বারীনবাবু চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতই কিরীটীর উপরে ঝাপিয়ে পড়লেন।
মেঝের উপরে দুজনে দুজনকে আঁকড়ে ধরে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু অসীম বলশালী কিরীটীর কাছে অল্পক্ষণের মধ্যেই বারীনাবুকে পরাস্ত হতে হল।
সকলে মিলে বারীনবাবুর হাত বেঁধে চেয়ারের উপরে বসাল। বারীনবাবুর মুখে একটি কথা নেই। সর্বশরীর তার রাগে তখন ফুলছে। চোখের রঙীন চশমা কোথায় ছিটকে পড়েছে। গোল গোল দুটো চোখ থেকে যেন ক্ষুধিত জিঘাংসার একটা অগ্নিশিখা ছুটে বেরিয়ে আসছে।
কিরীটী গায়ের জামা-কাপড় একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললে, মনে পড়ে বন্ধু! এক মাস আগে রসা রোডের মোড়ে এক গভীর রাত্রের কথা? আজও তোমার সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে রক্তলোলুপ দৃষ্টির কথা আমি ভুলিনি!
অমরবাবু, নিরঞ্জন কাঞ্জিলাল ওরফে বারীন চৌধুরী ওরফে মহীতোষ রায় চৌধুরী–কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার, দানেধ্যানে প্রাতঃস্মরণীয় ডাঃ এন. এন. চৌধুরী, চেতলার অবসরপ্রাপ্ত আলিপুর জেলের ডেপুটি সুপারিন্টেন্টে ডাঃ অমিয় মজুমদার, রাণাঘাট লোকাল ট্রেনের সেই হতভাগ্য যুবকের হত্যাকারী নরখাদককে আপনার হাতে তুলে দিলাম। ঘরের মধ্যে যেন মৃত্যুর মতই স্তব্ধতা থমথম্ করছে।
সহসা বারীনবাবু বলে উঠল, কিরীটী রায়, তুমি আমায় ধরবে বটে! বলতে বলতে বিদ্যুৎবেগে সে উঠে দাঁড়াল এবং চোখের পলকে ঘর থেকে ছুটে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী করে যে ইতিমধ্যে সকলের অলক্ষ্যে সে তার হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছিল কেউ তা টের পায়নি।
আসলে বারীনের হাতের কবজিতে একটা তীক্ষ্ণ ছুরি বাঁধা থাকত, তার সাহায্যে সে সকলের অলক্ষ্যে বাঁধন কেটে ফেলেছিল।
.
সমস্ত পুরী শহরটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও মহীতোষের সন্ধান পাওয়া গেল না।
কলকাতায় সুব্রতকে ইতিপূর্বেই সকল কথা জানিয়ে কিরীটী তার করে দিয়েছিল। মহীতোষ সেখানেও যায়নি।
.
দিন পাঁচেক পরের কথা।
পরদিন সকলে কলকাতার পথে যাত্রা করবে।
রাত্রি তখন বোধ করি সাড়ে নটা। অন্ধকার রাত্রি। সকলে সাগরের তীরে বসে আছে। অন্ধকারে উলঙ্গ সাগর কুদ্ধ দানবের মত গর্জাচ্ছে।
আকাশে তারাগুলি মিটমিট করে জ্বলছে আর নিভছে।
ডাঃ চক্রবর্তীই প্রশ্ন করলে, বারীনবাবুকে কি তুমি প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলে কিরীটী?
কিরীটী বললে, তবে শোন। মানুষের প্রতিভা যখন বিপথে যায় তখন এমনি করেই বুঝি ধ্বংসের মুখে ছুটে যায়। মানুষের খেয়ালের অন্ত নেই। বারীনবাবুর মত লোকেরা মানুষের দেহে শয়তান। এ একটা মানসিক বিকার। বিকৃত-মস্তিষ্কের একটা অদ্ভুত পৈশাচিক অনুভূতি। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইদানীং কিছুকাল ধরে কলকাতার উপরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছিল তার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। শুধু যে খুন করে রক্ত দেখবার একটা নেশাতেই মহীতোষ খুন করত তা নয়। পিছনে তার অতীত জীবনের কিছুটা সম্পর্কও ছিল। বিখ্যাত ডাঃ অমিয় মজুমদার খুন হবার কিছুকাল পরেই সুব্রতর সাহায্যে মহীতোষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে কেবলই আমার মনে হত যে, তার মত অদ্ভুত শিক্ষিত বিকৃত মস্তিষ্ক ইতিপূর্বে আর আমি দেখিনি এবং সেই থেকেই তার প্রতি আমি নজর রাখি।