সমরবাবু, যতীনবাবু, ডাঃ চক্রবর্তী, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ও বারীনবাবু-এঁরাই এখানে ছিলেন।
প্রথমেই ধরা যাক যতীনবাবুর কথা। যতীনবাবুর সঙ্গে এঁদের কোন পরিচয়ই ছিল না। তাছাড়া তিনি যদি খুনই করে থাকেন, কী উদ্দেশ্যে খুন করবেন। তার পক্ষে কোন strong motive তো নেই। একমাত্র Homicidalmaniacছাড়া তার পক্ষে ওভাবে গগনেন্দ্রনাথকে হঠাৎ খুন করবার কোন সঙ্গত কারণই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এবং এও আমরা জানি তিনি সে ধরনের লোক নন। অসুস্থ হলেও মস্তিষ্ক তার সম্পূর্ণ সুস্থ।
যতীনবাবু এতক্ষণে কথা বললেন, মিঃ রায়, এটা কি সত্যই হাস্যকর নয়? যদিও তার ভাইপোদের প্রতি তার ব্যবহার এতটুকুও পছন্দ করতাম না এবং মাঝে মাঝে আমার ভীষণ রাগ হত তার প্রতি ও তাকে সর্বান্তঃকরণেই আমি ঘৃণা করতাম, তথাপি সেই সামান্য কারণে একজন অপরিচিত রোগগ্রস্ত বৃদ্ধকে খুন করতে কখনই কেউ পারে না। তাছাড়া তাকে খুন করবার মত সুযোগও তো আমার মেলেনি। কেননা আমি বারীনবাবু ও সমরবাবুর সঙ্গেই আপনার বর্ণিত ঐ কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যে ছিলাম।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, তা জানি। আচ্ছা এখন দেখা যাক, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীই খুন করেছেন কিনা সেটা বিচার করে। তার পক্ষে ঐভাবে ডিজিট্যালিন ইনজেক্ট করে গগনেন্দ্রনাথকে মারা এমন কিছুই অসম্ভব নয়, কেননা তিনি একজন শিক্ষিত ডাক্তার। কিন্তু যেহেতু তিনি সাড়ে তিনটের আগেই হোটেল ছেড়ে চলে যান ও ফিরে আসেন সন্ধ্যা ছটায়, তার পক্ষে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার সুযোগ পাওয়া অসম্ভব ছিল। তাছাড়া এক্ষেত্রে তার খুন করবার উদ্দেশ্যই বা কি থাকতে পারে?
তারপর ধরা যাক ডাঃ চক্রবর্তীকে। তিনি, রণধীরবাবুর কথা মেনে নিলে, সাড়ে চারটের সময় যখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসেন-তার আগেই গগনবাবু খুন হয়েছেন। বারীনবাবুর ও যতীনবাবুর evidence-এ প্রমাণ হয় চারটে যোল মিনিটের সময় গগনবাবু বেঁচেই ছিলেন। তার মানে, এক্ষেত্রে ঐ কুড়ি মিনিটের পাকে ডাঃ চক্রবর্তীকে ফেলা যায় না। অবশ্য ডাঃ চক্রবর্তী হোটেলে ফিরে আসবার পথে কী করেছেন না করেছেন তার। কোন প্রমাণ নেই। কেননা ঐ সময় কেউ তার সাক্ষী ছিল না সেখানে। তাহলে একদিক দিয়ে ঐ সময় ডাঃ চক্রবর্তীর পক্ষে গগনবাবুকে খুন করা মোটেই আশ্চর্য বা অসম্ভব নয়।
কিন্তু এও ভাবতে হবে যে, তিনিও একজন শিক্ষিত ডাক্তার। অবশ্য একটা কথা আমার বরাবরই মনে হয়েছে। ডাক্তার যদি খুনী হন, তবে তিনিই প্রথম এ ব্যাপারে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন কেন যে এ ব্যাপারে কোন রহস্য আছে, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়? তাছাড়া গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার তার উদ্দেশ্যই বা কি থাকতে পারে? গগনবাবুর সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল না। এক্ষেত্রে ডাঃ চক্রবর্তী সম্পূর্ণ একজন তৃতীয় ব্যক্তি। তিনি নিজেই যদি দোষী হতেন তবে ব্যাপারটাকে এভাবে খুঁচিয়ে না তুলে বুদ্ধিমানের মত চুপচাপই থাকতেন। আমাদের common sense কি অন্তত তাই বলে না?
কিন্তু ঐ সময় আর একজন হোটেলে ছিল, সে হচ্ছে কিশোর। সে অনায়াসেই ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে সিরিঞ্জ চুরি করে নিয়ে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করতে পারত। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে সেও করেনি। তবে কে হত্যা করলে?
একটু থেমে আবার কিরীটী বলতে লাগল, এইবার আসুন আমার তৃতীয় ও চতুর্থ পয়েন্টে। গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ফ্যামিলির কাউকে বাইরের কোন তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে মিশতে দিতে একেবারেই পছন্দ করতেন না ও কোথাও বের হতে দিতেন না। অথচ সেদিন বিকালে তিনি তার ভাইপোদের ইচ্ছামত অন্য সকলের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যেতে বললেন, কোন আপত্তিই করলেন না। দুটো ব্যাপারই একটা আশ্চর্য নয় কি! এটা তার স্বভাবের একেবারেই বিপরীত।
এবার গগনেন্দ্রনাথের মানসিক অবস্থাটা একটু আললাচনা করে দেখা যাক। অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন তিনি।
তার মনে অন্যের উপরে শাসন ও প্রভুত্ব করবার একটা উম্মাদ পৈশাচিক আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই যে একটা প্রভুত্ব করবার আকাঙক্ষা, একটা শক্তিপ্রয়োগের লোভ, এটাকে জয় করার মত তার মানসিক শক্তি ছিল না। এবং তার দীর্ঘ কর্মজীবনে ঐ জিনিসটা বরাবরই উপভোগ করে এসেছিলেন ও অপ্রতিহত ভাবে প্রথমে আন্দামানের কয়েদীদের উপর ও জেলার-জীবনে কয়েদীদের উপর, পরে নিজের অসহায় ভাইপোদের প্রতি প্রয়োগ করেছিলেন। অথচ মজা হচ্ছে এই যে, আসলে তিনি একজন পরের প্রতি প্রভুত্ব করবার মত শক্তিশালী লোক ছিলেন না। শুধু সুযোগ ও সুবিধা তার সহায় হয়েছিল মাত্র। এবং এইভাবে অন্যের প্রতি অন্যায় প্রভুত্ব করবার একটা নেশা তাকে শেষ পর্যন্ত পেয়ে বসেছিল।
এবারে আসা যাক আমাদের আট নম্বর পয়েন্টে। তিনি একদিন বলেছিলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না। মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি। সবই আমার মনে আছে। সব মুখই আমার মনে আছে। কথাগুলো সেদিন হয়ত ডাঃ গাঙ্গুলীর মনে অনেকখানি চঞ্চলতা এনেছিল। কিন্তু আসলে এ কথাগুলো সেদিন তিনি ডাঃ গাঙ্গুলীকে বলেননি। হঠাৎ তার আশেপাশে অন্য কোন বিশেষ এক পরিচিত ব্যক্তির মুখ দেখেই ও কথাগুলো সেই লোককে উদ্দেশ করেই বলেছিলেন।