ডাঃ চক্রবর্তী বললে, খুব স্বাভাবিক এটা রণধীরবাবু, যা আপনি করেছেন। একেই দীর্ঘদিন ধরে আপনি অন্তরে ও বাইরে উত্তেজিত ছিলেন, আপনার ঐ মানসিক অবস্থায় ওভাবে হঠাৎ কাজ করা কিছুই আশ্চর্য নয়। খুব স্বাভাবিক। আপনার তখন মানসিক পক্ষাঘাত হয়েছে।
কিরীটী এতক্ষণে বললে, রণধীরবাবু, আপনার এ কথা আমি বিশ্বাস করি। এবং ঐজন্যই বিনতা দেবী গগনেন্দ্রনাথকে মৃত জেনেও সেকথা গোপন করে গেছেন, তাই নয় কি?
রণধীর বললে, তাই। কিন্তু মিঃ রায়, সত্যি কি আপনি আমাকে সন্দেহ করেছিলেন?
ঠিক তাই নয়, কিরীটী বললে, তবে একবার মনে হয়েছিল, আপনার দ্বারা তাঁকে খুন করা একেবারে অসম্ভব নয়।
তবে, রণধীর বললে, আমাদের মধ্যে যদি কেউই তাকে খুন করে থাকি, তবে কে তাকে খুন করলে? কী সত্যি ঘটেছিল? আসল ব্যাপারটা কি?
জানতে চান কি তবে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল? কিরীটী বলতে লাগল, শুনুন বলছি। সিরিঞ্জ ও ডিজিট্যালিন ডাঃ চক্রবতীর ব্যাগ থেকে খোয়া গিয়েছিল। গগনেন্দ্রনাথের হাতেও ইনজেকশনের দাগ ছিল, সে আপনারা অনেকেই দেখেছেন ও বিশ্বাস করেন। ময়নাতদন্ত হলেই সে কথা আমরা জানতে পারতাম। কিন্তু তার আর উপায় নেই। আমাদের যখন সন্দেহ হয়েছে তখন আসল সত্যটা জেনে আমাদের সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়া ভাল, যখন খুনী আমাদের মধ্যে বসে আছে নির্ভয়ে স্বচ্ছন্দ চিত্তে।
সমীর বললে, এখনও আপনি বিশ্বাস করেন মিঃ রায় যে, আমাদের মধ্যেই কেউ কাকাকে হত্যা করেছি।
কিরীটী চুপ করে রইল।
.
(আমার পাঠক-পাঠিকাগণ,
আপনারা প্রথম থেকেই সমগ্র ব্যাপারগুলো পড়েছেন। কী করে রহস্যটা গড়ে উঠল, সেটাও আপনাদের চোখের উপরেই। প্রত্যেকটি চরিত্র নিয়েই কিরীটী সূক্ষ্ম বিচার করেছে এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে খুনী কে? আপনাদের জিজ্ঞাসা করছি, বলুন দেখি কে খুনী এবং কেন তাকে আপনারা সন্দেহ করছেন?
লেখক)
.
কিরীটী বলতে লাগল, শুনুন প্রথম থেকেই দুটো ব্যাপার আমার কাছে একটু আশ্চর্য ঠেকেছিল। যার কোন মীমাংসাই পাচ্ছিলাম না খুঁজে। গগনেন্দ্রনাথ নিত্য একটু ঔষধ সেবন করতেন, যার মধ্যে একটা ingredientDigitain; দ্বিতীয়ত, ডাঃ চৌধুরীর হাইপোড়রমিক সিরিঞ্জটা কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। এই দুটো পয়েন্টকে একসঙ্গে বিচার করে দেখুন, তাহলেই দেখতে পাবেন ঐ দুটো point–এর জন্য আপনাদের সকলকেই সন্দেহ করা যেতে পারে। অথচ সূক্ষ্ম বিচার ও আলোচনার দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল আপনারা ভাইরা বা বিনতা দেবী কেউই দোষী নন।
যে লোকটা আগে থেকেই হার্টের ব্যারামে ভূগছিল এবং প্রত্যহ ঔষধের সঙ্গে ডিজিট্যালিন সেবন করছিল, তাকে মারতে হলে ঔষধের সঙ্গে একটু বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন সেবন করিয়ে দিলেই সবচাইতে সহজ ও বুদ্ধিমানের কাজ হত। আপনাদের মধ্যেই যদি কেউ হত্যাকারী হতেন, তাহলে ঐভাবে আপনাদের কাকাকে হত্যা করতে হলে কী করতেন? যে শিশি থেকে তিনি নিয়মিত ঔষধ সেবন করতেন, তার মধ্যে বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন মিশিয়ে রাখতেন। কেউ টের পেত না। কেউ জানতেও পারত না, অথচ নিঝঞাটে কাজটা হাসিল হয়ে যেত এবং এভাবে কাজটা একমাত্র সম্ভব হত তাদের দ্বারা যারা তাঁর বাড়ির লোক বা যারা তাকে সেই ঔষধ খাইয়ে দিলে কেউই সন্দেহ করতে পারবে না। যখন বিনতা দেবীর মুখে শুনলাম ঔষধের শিশিটা ভেঙে গেছে তখন ঐ সন্দেহটা বেশী করে আমার মনে উঠেছিল।
ওভাবে মারা গেলে এবং শিশির ঔষধটা পরীক্ষা করলে যখন দেখা যেত যে, তার মধ্যে বেশীমাত্রায় ডিজিট্যালিন আছে, তখন অনায়াসেই ওটার একটা explanation খাড়া করা যেতে পারত। বলা যেত, ভুল করে হয়ত ঔষধের দোকানদার যে ঔষধটা dispenseকরেছে, তাতে বেশী ডিজিট্যালিন মিশিয়ে ফেলেছে। এতে বাড়ির লোকের দোষ কী? এমন ভুল তো দোকানদাররা মাঝে মাঝে করেও থাকে, ফলে কিছুই ওই শিশি থেকে প্রমাণ করা যেত না। কিন্তু ওই সঙ্গে আর একটা সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে পারিনি। সেটা হচ্ছে মৃতের দেহে ইনজেকশনের দাগ ও সেই সঙ্গে ডাক্তারের ঘর থেকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা ও সিরিঞ্জটা চুরি যাওয়া। এর দুটি মাত্র মীমাংসা হতে পারে। এক ডাক্তারেরই দেখার ভুল, সিরিঞ্জ বা ঔষধ মোটেই চুরি যায়নি। অথবা হত্যাকারী সিরিঞ্জ ও ঔষধ চুরি করেছিল এইজন্য যে, গগনেন্দ্রনাথের নিত্য-ব্যবহৃত শিশিটার মধ্যে অন্যের অলক্ষে ডিজিট্যালিন ঢালার অবকাশ পায়নি বলে। অর্থাৎ এর থেকেই প্রমাণ হচ্ছে যে, হত্যাকারী বাড়ির কেউ নয়, বাইরের লোক।
এ ব্যাপারটা যে আগে আমার মনে উদয় হয়নি তা নয়। কিন্তু রণধীরবাবুদের দিকটা ভেবে দেখতে গেলে, ওঁদের দিক থেকে কাকাকে হত্যা করবার এত সঙ্গত কারণ ছিল যে, তাদের বাদ দিতে পারিনি প্রথমটায় আমার সন্দেহের তালিকা থেকে এবং তখনই ভাবতে লাগলাম, এও কি সম্ভব! ওঁদের দোষী সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ওঁরা নির্দোষ। এখন এইটাই আমাদের মীমাংসা করতে হবে। হত্যাকারী একজন বাইরের লোক। অর্থাৎ গগনেন্দ্রনাথকে এমন একজন কেউ হত্যা করেছে যে গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে এত পরিচিত নয়, যাতে করে সে অনায়াসেই তার ঘরে ঢুকে ঔষধের শিশিটার মধ্যে বেশী করে ডিজিট্যালিন মিশিয়ে রেখে আসতে পারে। এই ঘটনার সময় গগনেন্দ্রনাথের কাছাকাছি বা আশেপাশে বাইরের লোক কারা ছিল সেইটাই এখন বিচার করে দেখতে হবে।