কাজ হাসিল হয়ে গিয়েছিল, কোথাও আর যাবার তো দরকার ছিল না। আপনি জানতেন, কেউ আপনাকে সন্দেহ করতে পারবে না। বহুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন সকলেই ভাববেন তিনি হঠাৎ হার্টফেল করেই মারা গেছেন। সবই ঠিক ছিল বিনতা দেবী, কিন্তু সামান্য একটা কারণের জন্য আপনার সমগ্র plan ভেস্তে গেল। আপনি কাজ হাসিল করবার পর সিরিঞ্জটা আর আগের জায়গায় রেখে আসবার সুযোগ বা সুবিধা পাননি। কেননা ডাঃ চক্রবর্তী তখন তার ঘরে ছিলেন। যদিও আপনি জানতেন না যে, ডাক্তার ইতিপূর্বেই তার সিরিঞ্জটা যে খোয়া গেছে তা জানতে পেরেছিলেন। বিনতা দেবী, এই একটিমাত্র গলদেই সব ভেস্তে গেল। নচেৎ চমৎকার একটি perfect crime হয়েছিল।
সহসা যেন ঘরের মধ্যে একটা বজ্রপাত হয়েছে। স্তম্ভিত হতবাক হয়ে সবাই বসে রইল, কারও মুখে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নেই।
শ্মশানের মতই একটা জমাট স্তব্ধতা যেন সমগ্র ঘরখানির মধ্যে থমথম করছে।
সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে বিস্ময়ে আতঙ্কে ও ঘটনার আকস্মিকতায়।
এমন সময় রণধীর উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে এবং প্রতিবাদের সুরে বললে, না না, এ একেবারে মিথ্যে কথা। ও নির্দোষ, সম্পূর্ণ নির্দোষ। ও কিছুই করেনি। আমার কাকা তার আগেই মারা গিয়েছিলেন।
কিরীটী চোখ দুটো সহসা যেন অস্বাভাবিক এক উজ্জ্বলতায় ঝকঝক করে উঠল, মৃদুস্বরে সে বলল, আঃ। তাহলে শেষ পর্যন্ত আপনিই গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছিলেন, বলুন?
আবার মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা।
রণধীর ততক্ষণে চেয়ারের উপরে আবার থপ করে বসে পড়েছে। গভীর উত্তেজনায় তখনও তার সর্বশরীর কাঁপছে। ক্লান্তক্লিষ্ট স্বরে কোনমতে শুধু উচ্চারণ করলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ,–আমিই তাকে খুন করেছি।
কিরীটী প্রশ্ন করলে, আপনিই তাহলে ডাঃ চক্রবর্তীর ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ ও ডিজিট্যালিনের শিশিটা চুরি করেছিলেন?
হ্যাঁ।
কখন?
একটু আগে আপনিই তো তা বললেন মিঃ রায়!
কেন আপনি তাকে খুন করলেন?
সে কথা আমাকে আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন কি মিঃ রায়?
হ্যাঁ, আমি জিজ্ঞাসাই করছি। বলুন? জবাব দিন?
জানেন তো আমার মনের অবস্থা তখন কী রকম হয়েছিল। কিন্তু কেন, কেন আমাকে আপনি এ প্রশ্ন করছেন মিঃ রায়? রণধীরের কণ্ঠ থেকে যেন একটা প্রবল বিরক্তির ঝাজ ঝরে পড়ল, কী হবে আপনার এসব শুনে?
কিরীটী বললে, অনেক কিছুই হবে রণধীরবাবু। আমি চাই এখনও আপনি যা জানেন তা গোপন না করে খুলে সব বলুন। এখনও সত্য কথা বলুন।
সত্য কথা বলব?
হ্যাঁ হ্যাঁ, সত্যি কথা বলুন।
হা ভগবান, তাই আমি বলব। কিন্তু জানি না, সেকথা বিশ্বাস করবেন কিনা। তবু–তবু আমি বলব। একটা দীর্ঘশ্বাস রণধীরের বুকখানা কাপিয়ে বের হয়ে এল। রণধীর বলতে লাগল, সেইদিন দুপুরে আমার মনের অবস্থা অত্যন্ত unbalanced ছিল। আর এ জীবন সহ্য হচ্ছে না। এ বন্ধন যেন নাগপাশের মতই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। মুক্তি-মুক্তি চাই। এমনি ভাবে আর বেশীদিন থাকলে আমি বোধ হয় পাগল হয়েই যাব। আমার কেবলই কদিন থেকে মনে হচ্ছিল, আমিই এ সব কিছুর জন্য দায়ী। আমি সকলের বড়। ছোট ভাইরা সব আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের অসহায় যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে কতদিন-কতদিন আমি ভেবেছি, এই শৃঙ্খল আমি ছিড়ে ফেলব। সকলকে আমি মুক্তি দেব। সকলকে আবার বাঁচিয়ে তুলব। দিনের পর দিন এক বৃদ্ধ বিকৃত-মস্তিষ্কের নিষ্ঠুর খেয়ালের নাগপাশে বন্দী হয়ে জর্জরিত হবার চাইতে বুঝি মৃত্যুও ভাল। কী যে সে যন্ত্রণা আমি ভোগ করেছি তা কেউ জানত না।
আপনাকে আমি কী বলব মিঃ রায়, কতদিন রাত্রে শিশুর মতই আমি একা একা শয্যায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছি। কিশোরের মনের অবস্থা দিন দিন যেভাবে সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলছিল, সে আর যেন দেখতে পারছিলাম না। আমার সহ্যশক্তি যেন ভেঙে এড়িয়ে যাচ্ছিল। বাপ-মা-হারা ছোট ভাইটির সেই অসহায় করুণ মুখখানা যেন আমার হৃদয়ে নিশিদিন ব্যর্থ অনুশোচনার দাবাগ্নি জ্বালাত। সাপ যেমন তার চোখের দৃষ্টিতে শিকারকে সম্মোহিত করে রাখে, আমারও হয়েছিল সেই অবস্থা।
কাকার উন্মাদ পরিকল্পনা যেন অক্টোপাশের মত অষ্টবাহুতে আমাকে আঁকড়ে ধরে আমার রক্ত শোষণ করছিল। সমস্ত রাত্রি ধরে কত সঙ্কল্পের পর সঙ্কল্পই না আটতাম, কিন্তু সকালবেলা কাকার মুখের দিকে চাইলেই বন্যার মুখে স্রোতের কুটোর মত সব ভেসে যেত। অহর্নিশি অন্তর ও বাইরের এই দ্বন্দ্ব যেন আমায় পাগল করে তুলছিল, সামান্য শব্দে কেঁপে উঠতাম, সামান্য উত্তেজনায় আমার বুক কাঁপত। বোঝাতে পারব না আপনাকে আমার সেই অসহায় অবস্থার কথা। শেষকালে আর স্থির থাকতে পারলাম না। সেদিন বিকালে অনেক সাহস সঞ্চয় করে একটা উত্তেজনার মধ্যেই কাকার কাছে এগিয়ে গেলাম এর একটা শেষ মীমাংসা করতে।
সহসা অধীর ও সমীর চিৎকার করে উঠল, দাদা! দাদাভাই!
রণধীর তখন পাগলের মতই হয়ে উঠেছে, সে ভাইদের কথায় প্রবলভাবে চিৎকার করে বলে উঠল, না না, তোরা থাম। তোরা থাম। আজ তোরা আমায় বলতে দে। আজ আমার সকল সঙ্কোচ ভেঙেছে। দীর্ঘ একুশ বছরের এ অসহ্য যন্ত্রণা আর পুষে রাখতে পারছি না।
হ্যাঁ শুনুন মিঃ রায়, তারপর কাকার সামনে গিয়ে কি দেখলাম জানেন, দেখলাম তিনি মৃত। মৃতদেহ সেখানে চেয়ারের উপরে বসে আছে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, কী করব-কী করা উচিত! চিৎকার করে সকলকে একবার যেন ডাকতে গেলাম, কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে আমার কোন স্বর বের হল না। তখন আমি ধীরে ধীরে আমার ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। কাউকে কোন কথা বললাম না। আমিও তার হাতে ইনজেকসনের দাগ দেখেছিলাম। আমি জানি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। করতে পারে না। তবু আপনাকে বললাম। বলে রণধীর হাঁপাতে লাগল।