কিরীটী গম্ভীর স্বরে বললে, আছে বৈকি। আমার সময়-তালিকাটার বারো নম্বর পয়েন্টটা বিবেচনা করে দেখুন। সাড়ে ছটার সময় যখন চা খেতে সকলে খাবার ঘরে গেছেন, গগনেন্দ্রনাথকে চা পান করতে ডাকবার জন্য ভৃত্যকে তার কাছ পাঠানো হয়েছিল।
সমীর বললে, আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না মিঃ রায়!
অধীরও সঙ্গে সঙ্গে বললে, আমিও বুঝলাম না।
কিরীটী জবাব দিলে, ও বুঝতে পারছেন না, না? গগনেন্দ্রনাথকে ডাকতে একজন ভৃত্যকে পাঠানো হয়েছিল কেন? চিরদিন আপনার ভাইরা একজনের মধ্যে যে কেউ বা বিনতা দেবীই তাকে চা পান করবার বা খাবার সময় ডাকতে যেতেন। কেননা সেটাই আপনাদের কাকা বেশী পছন্দ করতেন। কাকাকে ডাকতে যাওয়া আপনারা আপনাদের একটা কর্তব্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে ইদানীং সর্বদাই আপনাদের মধ্যে একজন
একজন তার কাছে কাছে থাকতেন। সমীরবাবু ও বিনতা দেবী দুজনেই তাদের জবানবন্দীতে একথা স্বীকার করেছেন। তাই যদি হয়, তবে সেদিন সন্ধ্যায় চা পান করবার জন্য আপনাদের মধ্যে কেউ একজন তাকে না ডাকতে গিয়ে ভৃত্যকে পাঠানো হয়েছিল কেন? এ বাড়ির প্রচলিত নিয়মের কেন ব্যতিক্রম হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায়?
কেউ আপনারা ডাকতে যাননি, কেননা ঘটনার আকস্মিকতায় আপনারা সকলেই তখন বিমূঢ় ও বিবশ হয়ে গিয়েছিলেন। কী করা উচিত না উচিত এ প্রশ্নটাই আপনাদের প্রত্যেককে তখন বিচলিত করে তুলছিল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মনে আপনারা ভাবছিলেন, কেন আপনাদের মধ্যে একজন কাকাকে ডাকতে যাচ্ছে না। তার কারণ একটা ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদের জন্য মনে মনে আপনারা প্রত্যেকেই তখন অবশভাবে অপেক্ষা করছিলেন।
বিনতা দেবী জবাব দিলেন, না, তা হয়। আমরা প্রত্যেকেই সেদিন ক্লান্ত ও অবসন্ন। অবশ্য স্বীকার করি আমাদেরই একজনের কাউকে ডাকতে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু যেহেতু আমাদের মধ্যে কেউ যায়নি বলেই যে আমাদের মধ্যে কেউ দোষী এ যুক্তিটা ছেলেমানুষের যুক্তির মত হল না?
কিরীটী বললে, হয়ত বা তাই। কিন্তু বিনতা দেবী, আপনি বা সমীরবাবুই বেশীরভাগ সময় ও কাজটা করতেন, সেকথা দুজনেই তো আপনারা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেদিন রাত্রে ইচ্ছা করেই আপনি তাকে ডাকতে যাননি। কিন্তু কেন আপনি যাননি জানেন? কিরীটীর স্বর সহসা যেন ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ ও ধারাল হয়ে উঠল, তার কারণ আপনি তখন জানতেন যে আপনার শশুর মৃত। হ্যাঁ, আপনি জানতেন। গভীর উত্তেজনায় কিরীটীর গলার স্বর কাঁপতে লাগল।
বিনতা দেবী প্রত্যুত্তরে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী তার কথায় ক্ষেপমাত্র করে বলতে লাগল, না না, আমি আপনার কোন কথা বা কোন যুক্তিই মানতে চাই না। শুনুন মিসেস মল্লিক, আমি—যা আমি কিরীটী রায় বলছি, আমাকে চেনবার ও জানবার অবকাশ হয়ত আপনার হয়নি, তাহলে এভাবে নিজেকে লুকোবার এই হাস্যকর প্রয়াস নিশ্চয়ই করতেন না।
স্বীকার করি আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা এবং অনেকের চাইতে ঢের বেশী বুদ্ধি রাখেন। কিন্তু তবু আমার চোখে ধূলো দেবার মত ক্ষমতা আপনার নেই। অবিশ্যি এটা ঠিকই যে বেড়িয়ে ফিরে এসে যে সময় আপনি গগনবাবুর সঙ্গে দেখা করেন, সে সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু হোটেলেই ছিলেন এবং তারা আপনাকে গগনবাবুর সঙ্গে কথা বলতেও দেখেছেন। তারা শুধু দূর থেকে আপনাকে গগনবাবুর সঙ্গে কথা বলতেই দেখেছিলেন, কিন্তু কী কথা যে আপনি বলছিলেন তা তারা শুনতে পাননি। কেননা এত দূর থেকে সেটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আসলে সে-সময় আপনি যে সেখানে কী করছিলেন তার কোন প্রমাণই আমাদের হাতে নেই। তবু এ বিষয়ে আমার একটা theory আছে বা কল্পনা করেছি।
আগেই বলেছি আপনার বুদ্ধি আছে। খুব তাড়াতাড়ি যদি আপনি যে কোন ভাবেই হোক আপনার খুড়শ্বশুরকে এ সংসার থেকে সরাবার ইচ্ছা করতেন তবে সেটা সহজেই এবং অনেকদিন আগেই করতে পারতেন। একটুখানি বুদ্ধি আর তার সঙ্গে একটুখানি সুযোগের যোগাযোগ। কিন্তু তাড়াতাড়ি কাজটা না শেষ করে হয়ত বিশেষ একটা সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। আপনি হয়ত সকালবেলা কোন এক সুযোগে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে ঢুকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা ও সিরিঞ্জটা চুরি করে এনেছিলেন। কাউকে খুন করবার মত ঔষধ বেছে নেওয়া আপনার পক্ষে বিশেষ কষ্টকর ছিল না। কেননা নার্সিং আপনি কিছুদিন শিক্ষা করেছিলেন। ডাক্তারী ঔষধপত্র সম্পর্কে বেশ কিছু জ্ঞান আপনার আছে। আপনি ইচ্ছা করেই ডাক্তারী ব্যাগ থেকে ডিজিট্যালিনের শিশিটা বেছে নেন, ঠিক যে ধরণের ঔষধ আপনার শ্বশুর খেতেন। আপনি সিরিঞ্জে ঐ ঔষধ ভরে রাখেন ও উত্তেজনার বশে গগনেন্দ্রনাথের শরীরে প্রয়োগ করে তাকে খুন করেন। কিন্তু কাজ হাসিল হয়ে যাবার পর সিরিঞ্জটা আর ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে রাখবার সুযোগ পাননি, কেননা সেই সময় ডাঃ চক্রবর্তী তার ঘরে শুয়ে জ্বরের ঘোরে কাপছিলেন।
আগে থাকতেই সব আপনি planকরে রেখেছিলেন। দূর থেকে বারীনবাবু ও যতীনবাবু গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে দেখেছেন মাত্র। আপনি অনায়াসেই গগনেন্দ্রনাথের হাতে ইনজেকশন করে বিষপ্রয়োগ করেছিলেন। বুড়ো রোগগ্রস্ত মানুষ, বাধা দেবার বা চিৎকার করবারও সুযোগ পাননি হয়ত এবং বিষপ্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটেছিল। কাজ শেষ করে আবার হয়ত কথা বলবার ভান করে বা অভিনয় করে আবার তাঁর পাশে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান। দূর থেকে যতীনবাবু ও বারীনবাবু সে সময় আপনাকে দেখতে পান। তারা ভেবেছেন আপনি তার সঙ্গে কথা বলছেন, খুবই এটা স্বাভাবিক। কে আপনাকে এক্ষেত্রে সন্দেহ করতে পারে বলুন! তারপর আপনি সেখান থেকে ফিরে আপনার স্বামীর ঘরে ঢুকে বাকি সময়টা তার সঙ্গেই কথাবার্তা বলে কাটান, সেখান থেকে আর অন্য কোথাও যাননি।