এ কথাও ঠিক যে বেলা তিনটে থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত কিশোর তার নিজের ঘরে ছিল না। তার প্রমাণ পেয়েছি। কিশোর তার জবানবন্দিতে একটা বিশেষ কথা বলেছিল। ডাঃ চক্রবর্তী নাকি জ্বরের ঘোরে তার নাম ধরে ডাকছিলেন। কিন্তু কিশোর যে ঘরে থাকে সেখান থেকে ডাঃ চক্রবর্তীর ঘর দূরে, জ্বরের ঘোরে সেখান থেকে ডাকলেও সে ডাক শোনা যেতে পারে না। তাছাড়া ডাঃ চক্রবর্তীও জ্বরের ঘোরে কিশোরকে নাকি স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আসলে ডাক্তারের সেটা স্বপ্ন নয়, কিশোরকে সশরীরেই তার ঘরে সেদিন দেখেছিলেন তার শয্যার পাশে। তিনি মনে করেছিলেন, ওটা তার স্বপ্ন বা জুরবিকার। আসলে সত্যি সত্যি কিশোর সে-সময় ডাঃ চক্রবর্তীর ঘরে গিয়েছিল। এমনও তো হতে পারে, কিশোর সেই সময় তার কাকাকে খুন করে ডাক্তারের ঘরে সিরিঞ্জটা রাখতে গিয়েছিল।
কিশোর মুখ তুলে কিরীটীর দিকে তাকাল। তার মাথার তৈলহীন রুক্ষ এলোমেলো চুলগুলি মুখের চারপাশে ও ঘাড়ের উপর এসে ঝাপিয়ে পড়েছে। বড় বড় সুন্দর টানা টানা দুটি চক্ষু। সে চোখের দৃষ্টিতে কোন ভাব নেই। যেন সহজ অসহায় উদাস ব্যথায় ক্লান্ত, অশ্রুআবিল।
এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী বলে উঠল, আশ্চর্য!
কিন্তু মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়ে এটা কি একেবাবেই অসম্ভব ডাঃ চক্রবর্তী? কিরীটী প্রশ্ন করলে।
কিন্তু তাদের বাধা দিয়ে বিনতা দেবী যেন একপ্রকার চিৎকার করেই বললে, না না, এ অসম্ভব! এ অসম্ভব! এ হতে পারে না!
কেন হতে পারে না বিনতা দেবী?
তীক্ষ্ম ধারাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটী বিনতা দেবীর দিকে তাকাল। সাপের দৃষ্টির মত সম্মোহন সে দৃষ্টিতে, যেন অন্তর্ভেদী ধারাল তীক্ষ্ণ আলোর রশ্মির মত অনুসন্ধানী। বিনতার অন্তস্তল পর্যন্ত ভেদ করছে। বিনতা বললে, হ্যাঁ, অসম্ভব। এ শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, এ আপনার বাতুলতা।
কিশোর চেয়ারটার উপরে একটু নড়েচড়ে বসল। তার ভাবলেশহীন পাথরের মত খোদাই করা মুখের উপরে যেন সহসা একটা চাপা কৌতূহলের আভা ফুরিত হচ্ছে।
কিরীটী একবার মাত্র তীব্র দৃষ্টিতে বিনতা দেবীর দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল, আপনি একজন সত্যিকারের বুদ্ধিমতী মহিলা বিনতা দেবী। আপনারবুদ্ধির প্রশংসা কিরীটী রায়ও করছে।
আপনি কি বলতে চান, মিঃ রায়? তীক্ষ্ম স্বরে বিনতা দেবী প্রশ্ন করল।
আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাই বিনতা দেবী যে, এতক্ষণে সত্যিই আমি বুঝতে পেরেছি তীক্ষ্ণ ধারাল বুদ্ধির একটা চমৎকার মুখোশ আসল সত্যিকারের রূপটাকে ঢেকে রেখেছে। সত্যিই আপনি প্রশংসার যোগ্য। বাংলাদেশের সাধারণ ঘরোয়া মেয়েদের মধ্যে এতখানি বুদ্ধির প্রখ্য ইতিপূর্বে আমার চোখে আর পড়েছে কিনা বলতে পারি না।
কুণ্ঠায় ও লজ্জায় বিনতা দেবীর দৃষ্টি নত হয়ে এল। কিরীটী বলতে লাগল, লজ্জিত হবেন না মিসেস মল্লিক। তোষামোদ বা চাটুকার্য আমার পেশা নয়। এ বাড়ির অদ্ভুত জীবনধারার সঙ্গে আপনি আপনার নিজস্ব গড়ে-ওঠা জীবনধারাকে অতি কৌশলের সঙ্গে যেন খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। বাইরে আপনি আপনার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করতেন, তাঁর মতেই মত দিয়ে চলতেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আপনি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়েই ঘৃণা করতেন, তার সমগ্র কাজ ও ব্যবহারকে অন্যায় অবিচার বলে অবজ্ঞা করতেন। কিছুদিন থেকে আপনি ভাবছিলেন এবং আপনার স্বামীকে নিয়ে এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যাবার জন্য উত্তেজিত করছিলেন। আপনি ভেবেছিলেন তা যদি পারেন তবেই নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে তিল তিল করে যে নাগপাশের বন্ধনে আপনার স্বামী বাঁধা পড়েছিলেন, তার প্রভাবকে অস্বীকার করবার মত মনের শক্তি আর আপনার স্বামীর ছিল না।
অনেক চেষ্টাতেও যখন আপনি আপনার স্বামীকে আপনার মতে আনতে সক্ষম হলেন, তখন অতি অদ্ভুত উপায়ে আপনার স্বামীর ঘুমিয়ে পড়া মনকে জাগিয়ে তুলবার জন্য আঘাত হানবার কল্পনা করলেন। তাকে ভয় দেখালেন, আপনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জন করবেন। আপনি সত্যিই আপনার স্বামীকে ভালবাসেন। এটা আপনার স্বামীকে মাত্র ভয় দেখানোর উপায় ভেবেছিলেন, একথা শুনলে যদি আপনার স্বামী। শেষ পর্যন্ত ফিরে দাঁড়ান। এবং হয়েছিলও তাই। আপনার কথায় সত্যি এতদিন পরে। রণধীরবাবুর ঘুমিয়ে পড়া পৌরুষের গোড়ায় আঘাত লাগল। এতদিনকার কাকুতিমিনতি যা করতে পারেনি, এক কথায় সেটা সম্ভব হল। এমনিই হয়। কখন কী সামান্য ঘটনা হতে যে মানুষের মনের মূলটা পর্যন্ত নড়ে ওঠে, চিরদিনকার যুক্তি শিথিল হয়ে আসে, কেউ তা বলতে পারে না। রণধীরবাবুর মনের গোড়াতেও ঝড় উঠল। তিনি হয়ত ভাবলেন, যার জন্য এত দুঃখ, এত কষ্ট, তাকে শেষ করে ফেলতে পারলেই সব আপদের শান্তি হয়, তাই হয়ত তিনি শেষ পর্যন্ত…
বিনতা প্রবল ভাবে বাধা দিল, না, না, এ আপনার ভুল কিরীটীবাবু। আপনি ভেবেছেন। আমার স্বামীকে আমি সেদিন ঐ কথা বলবার পর আমার স্বামী খুব রেগে বা চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু আসলে তা তিনি হননি। তাছাড়া আমি সেদিন বিকেলে বেড়িয়ে ফিরে আমার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করে সোজা আমার স্বামীর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করি, এবং চা খেতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা দুজনে সে ঘরে বসে গল্প করেছি। তার মৃত্যুর জন্য আমি হয়ত বা দায়ী হতে পারি, অর্থাৎ আমার শ্বশুরকে আমার মনের অভিসন্ধির কথা বলে তার দুর্বল শরীরে আঘাত দিতে পারি, হয়ত সে আঘাতের ফলে তার হঠাৎ মৃত্যু হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়, এবং সত্যি যদি হয়ে থাকে, তাহলেও আমার বিরুদ্ধে আপনার কোন প্রমাণই নেই মিঃ রায়।