লোকটার সর্বাঙ্গে কালো রঙের পোশাক। মাথায় একটা কালো রঙের ফেল্ট টুপি। একপাশে ঈষৎ নামানো। লোকটা এসে দ্রুতপদে পথের ধারে একটা গ্যাসপোস্টের নীচে দাঁড়াল। কিরীটী দু-তিন হাত দূরে একটা গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখতে লাগল, অথচ লোকটা কিন্তু কিরীটীকে দেখতে পেল না। লোকটার সর্বাঙ্গ যেন একটা গভীর উত্তেজনায় কাঁপছে। গ্যাসপোস্টের খানিকটা আলো তির্যক গতিতে লোকটার মুখের ডানপাশে এসে পড়েছে।
সেই স্তিমিত আলোয় লোকটার চোখ দুটো যেন কী এক ভয়ঙ্কর ক্ষুধিত জিঘাংসায় আগুনের ভাটার মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মাথার চুলগুলো ডান দিককার কপালে এসে পড়েছে।
একজোড়া পাকানো গোঁফ।
লোকটা পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ঘন ঘন মুখ মুছতে শুরু করল।
এমন সময় পাশের একটা বাড়ি থেকে প্রচও একটা গোলমালের শব্দ শোনা গেল।
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা চমকে রাস্তায় নেমে দ্রুতপদে চলতে লাগল এবং ঘন ঘন পিছনপানে তাকাতে লাগল। কিরীটীও নিঃশব্দ পদসঞ্চারে লোকটাকে অনুসরণ করল। লোকটা আরও দ্রুতবেগে রাস্তাটা পার হতে লাগল। কিরীটীও তার চলার বেগ বাড়িয়ে দিল।
কিন্তু কিরীটী লোকটার কাছাকাছি পৌঁছবার আগেই রাস্তার ধারে রক্ষিত একটা সাইকেলে চেপে লোকটা সোঁ সোঁ করে নিমেষে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
কিরীটী যখন সেখানে এসে পৌঁছল, দেখলে সাইকেলটা যেখানে ছিল সেইখানে রাস্তার উপরে কী একটা কাপড়ের মত পড়ে আছে।
নীচু হয়ে কিরীটী জিনিসটা তুলে নিল হাতে।
নিশ্চয়ই লোকটা রুমালটা তাড়াতাড়িতে ফেলে গেছে।
কিরীটী রুমালটা হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে রাস্তার ওপাশে যেখান থেকে তখনও গোলমাল আসছিল সেইদিকে এগিয়ে গেল।
গোলমালটা আসছিল একটা গেটওয়ালা দোতলা বাড়ি থেকে।
বাড়িটার কক্ষে কক্ষে তখন আলো জ্বলে উঠেছে। অনেক লোক চলাফেরা করছে।
কিরীটী গেট খুলে এগিয়ে গেল।
দরজার সামনে অল্পবয়স্ক একটি যুবককে দেখে কিরীটী তাকেই প্রশ্ন করলে, কী ব্যাপার মশাই?
কে আপনি? যুবক প্রশ্ন করলে।
একজন পথিক ভদ্রলোক, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, গোলমাল শুনে দেখতে এলাম, ব্যাপার কী?
কী আর বলব মশাই!…যুবকের কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল।
কিরীটী স্পষ্টই বুঝতে পারলে কোন কারণে যুবক অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
কী, ব্যাপার কী?
ব্যাপার যে কী তা কি আমিই বুঝতে পারছি! ভৌতিক কাণ্ড মশাই!
ভৌতিক কাণ্ড! বলেন কী?
তাছাড়া আর কী? মানুষ যে মানুষকে ওভাবে খুন করতে পারে, এ যে স্বপ্নেরও অতীত।
খুন?
হ্যাঁ, খুন।
পুলিসে সংবাদ দিয়েছেন?
না, দিইনি তো!
ফোন আছে বাড়িতে?
আছে।
চলুন শীগগির পুলিসে একটা ফোন করা যাক।
কিরীটী যুবকের সঙ্গে বৈঠকখানায় এসে ফোনের রিসিভার তুলে নিল, হ্যালো বড়বাজার…
ওপাশ থেকে জবাব এল, হ্যালো, কে?
কে, সুব্রত? কিরীটী প্রশ্ন করলে এপাশ থেকে।
হ্যাঁ, ব্যাপার কী? কিরীটী না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। শীঘ্র এস। ..নং রসা রোডে একজন খুন হয়েছেন।
খুন? এত রাত্রে?
আরে ছাই, এসোই না!
তুমি থাকছ তো?
হ্যাঁ আছি, এস তাড়াতাড়ি। কিরীটী রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
তারপর যুবকের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন, দেখি কোথায় খুন হয়েছে।
আসুন। নিস্তেজভাবে যুবক কিরীটীকে আহ্বান করল।
উপরের একটা ঘরে যুবকের পিছু পিছু কিরীটী এসে প্রবেশ করল।
.
বেশ প্রশস্ত সাজানো-গোছানো একখানা ঘর। মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো। ঘরের একপাশে একখানা দামী খাটে নিভাজ একটি শয্যা বিছানো।
একপাশে একটি টেবিল ও একটি বুকসেলফ, টেবিলের উপরে কাগজপত্র পাকার করা আছে।
একপাশে একটি লোহার সিন্দুক। টেবিলের সামনে একটি গদি-মোডা চেয়ার। টেবিলের উপরে সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা একটি টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। তারই আলোয় ঘরটি আলোকিত।
মেঝেয় কাপেটের উপরে দামী স্লিপিং স্যুট পরা কে একজন উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
পিঠের দিকে স্লিপিং স্যুটটা ছিন্নভিন্ন, রক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠেছে।
কিরীটী এগিয়ে দেখল, পিঠের উপরে প্রকাণ্ড দু-তিনটি গভীর ক্ষত।
মনে হয় কোন এক হিংস্র রক্তপিপাসু জন্তু যেন তীক্ষ্ণ দন্তাঘাতে লোকটার পিঠের মাংস খুবলে নিয়েছে।
উঃ, কী ভয়ানক পৈশাচিক দৃশ্য!
কিরীটী পকেট থেকে টর্চ বের করে ভূপতিত ব্যক্তিকে আলোতে আরও ভাল করে দেখতে লাগল।
একবার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখতে পেল, নাকমুখ দিয়ে রক্তাক্ত ফেনা গড়াচ্ছে।
চোখ দুটো খোলা, যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতে চায় মুখে-চোখে একটা অস্বাভাবিক আতঙ্ক যেন প্রকট হয়ে উঠেছে।
কিরীটী লোকটার বুকে হাত দিয়ে দেখলে, না, লোকটার নিঃসন্দেহে মৃত্যু হয়েছে।
গলার উপরে ও কিসের নীল দাগ! ও যে আঙুলের দাগ বলেই মনে হয়! হ্যাঁ, লোকটাকে কণ্ঠনালী চেপে নিষ্ঠুরভাবে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।
কিন্তু কী ভয়ঙ্কর পৈশাচিকতা, কী দানবীয় নিষ্ঠুরতা!
কিরীটী একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং অদূরে স্থাণুর মত দণ্ডায়মান যুবকের মড়ার মত রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকাল।
চলুন এ ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া যাক।
কিরীটী মৃদুস্বরে যুবককে বললে।
দুজনে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে দুখানা চেয়ার অধিকার করে বসল।
বাইরে তখন চার-পাঁচজন ভৃত্য উঁকিঝুঁকি মারছে।
উনি আপনার কে হন? কিরীটীই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশ্ন করলে।