প্রতিমা দেবী বাধা দিয়ে বলে উঠল, আমার ধারণা নির্ভুল।
কিরীটী বলতে লাগল, আরও একটা সম্ভাবনা এক্ষেত্রে আছে। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী সমীরবাবুর ফিরবার কিছু পরেই হোটেলে ফিরে আসেন। যদি সমীরবাবুর কথামত সে-সময় তার কাকা বেঁচেই থেকে থাকেন, তাহলে আমাদের ধরতে হবে ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীই নিশ্চয়ই গগনবাবুকে খুন করেছেন। তিনি জানতেন গগনবাবু অসুস্থ। মানসিক বিকৃতি তার ঘটেছে। সমাজেরও বিশেষ করে এদের family-র পক্ষে তিনি মূর্তিমান অমঙ্গল ও অশান্তি। এবং সেই সঙ্গে এই অত্যাচারিতদের দেখে এঁদের জন্যে তার মনে একটা অনুকম্পাও জেগেছিল। হয়ত সেই কারণেই এঁদের বাঁচাতে নিজ হাতে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করেছেন।
সহসা ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী বাধা দিয়ে বলে উঠল, না, আমি খুন করিনি।
কিন্তু মনে পড়ে কি প্রতিমা দেবী, আপনি একদিন ডাঃ চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ঐ শয়তান বুড়োকে খুন করা উচিত। ঐ শয়তানকে খুন করতে পারলে এখন হয়ত ওদের বাঁচবার আশা আছে…..দশজনের মঙ্গলের কাছে একজনের মৃত্যু সে তো বড় বেশী কথা নয়…
প্রতিমা বললে, হ্যাঁ, এ কথা একদিন কথায় কথায় ডাঃ চক্রবর্তীকে বলেছিলাম বটে, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি, সেই শয়তান দুর্দান্ত অত্যাচারী বিকৃতমস্কি লোকটাকে যতই আমি ঘৃণা করি না কেন, তাকে সত্যি সত্যি খুন করব এমন কথা স্বপ্নেও আমি কোনদিন ভাবিনি। না, তাকে খুন করা দূরে থাক, তাকে মরবার পর ছাড়া স্পর্শ পর্যন্ত করিনি।
কিরীটী গম্ভীরভাবে বললে, তাহলে বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হয় ডাক্তার যে, আপনি না হয় সমীরবাবু আপনাদের মধ্যে একজন নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলছেন!
এবারে সমীর সহসা চিৎকার করে বলে উঠল, আপনারই জিত হল মিঃ রায়। সত্যিই আমি মিথ্যা কথা বলেছি। আমি যখন বেড়িয়ে ফিরে কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন তিনি মৃত। আমি অত্যন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই ঘটনার আকস্মিকতায়। কী করব প্রথমটা বুঝে উঠতে পারি না, সব গোলমাল হয়ে যায়। আমি তাঁকে বলতে যাচ্ছিলাম, তার নাগপাশের অধীনে আর আমি থাকব না। আমি চলে যাব। আজ থেকে আর আমি এ বাড়িতে থাকব না। আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন। রাস্তায় রাস্তায় আমি ভিক্ষা করে খাব তবু তোমার মত শয়তানের কৃপাপ্রার্থী হয়ে এ কয়েদখানায় আর আমি বাঁচতে চাই না। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তখন তিনি মৃত, তাঁর শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা প্রাণহীন। আমার মনে ঠিক সেই কথাটাই জেগেছিল, যা একটু আগে আপনি অধীর সম্পর্কে বলেছিলেন, যে অধীর হয়ত শেষে কাকাকে খুন করেছে এবং আমি কাকার ডান হাতের উপরে একবিন্দু রক্ত দেখেছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল যে তাকে কোন কিছু ইনজেকশন করা হয়েছে।
কিরীটী সহসা বলে উঠল, এই একটা পয়েন্ট যাতে আমি স্থিরনিশ্চিত হতে পারিনি যে, কীভাবে আপনি আপনার কাকার প্রাণ নেবার সংকল্প করেছিলেন। তবে একটু ধারণা করেছিলাম যে, আপনার কল্পনার সঙ্গে সিরিঞ্জের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমাকে যদি বিশ্বাস করেন তবে বাকিটা বলুন।
সবই বলব মিঃ রায়, একটা ইংরাজী বইতে পড়েছিলাম, একজন একজনকে ইনজেকশন করে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছিল। সেই থেকেই ঐভাবেই খুন করবার একটা দুষ্ট চিন্তু সর্বদা আমার মাথায় ঘুরত।
এখন বোঝা যাচ্ছে, ঐজন্যই আপনি শেষ পর্যন্ত একটা সিরিঞ্জ কিনেছিলেন।
না, কিনিনি, বৌদির বাক্স থেকে সেটা চুরি করে নিয়েছিলাম।
সহসা বিনতা দেবী যেন লজ্জায় লাল হয়ে উঠে বললে, কিন্তু আমি-আমি সে কথা জানতাম না।
কিরীটী বললে, এতক্ষণে দুটো সিরিঞ্জের রহস্য উদঘাটিত হল। যেটা বিনতা দেবীর ছিল, সমীরবাবু সেটা চুরি করলেন। পরে অধীরবাবু সমীরবাবুর ঘরে সেটা পেয়ে সন্দেহবশে মেজদাকে বাঁচাবার জন্য বাড়ির পিছনে ফেলে দিলেন। বেশ, তাহলে আবার আমাদের সময়তালিকাটি পুনর্বিচার করে দেখা যাক।
তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় সমীরবাবু, সমরবাবু ও রণধীরবাবু সব বেড়াতে বের হন।
তিনটে পনের মিনিটের সময় ডাঃ চক্রবর্তী ও ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী বেড়াতে বের হন।
চারটে পনের মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু বেরিয়ে যান।
চারটে কুড়ি মিনিটের সময় জুরে কাঁপতে কাঁপতে ডাঃ চক্রবর্তী ফিরে আসেন।
চারটে পয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীরবাবু ফিরে আসেন।
চারটে চল্লিশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী ফিরে এসে গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তার সঙ্গে কথা বলে স্বামীর ঘরে যান প্রায় চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময়।
পাঁচটা দশ মিনিটের সময় অধীরবাবু ফিরে আসেন।
পাঁচটা চল্লিশ মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু ফিরে আসেন।
পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় সমীরবাবু ফিরে আসেন।
ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে আসেন।
ছটা তিরিশ মিনিটের সময় গগনেন্দ্রনাথ মৃত আবিষ্কৃত হন।
এই সময় তালিকা সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী যখন ফিরে এসে তার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে রণধীরবাবুর ঘরে চলে যান ও পাঁচটা দশ মিনিটের সময় যখন অধীরবাবু ফিরে আসেন—এই যে কুড়ি মিনিট সময় তার মধ্যে (অধীরবাবুর কথা যদি সত্যি বলে মেনে নিই) গগনেন্দ্রনাথ খুন হয়েছেন।
এখন কথা হচ্ছে, ঐ কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যে কে তাকে খুন করতে পারে! ঐ সময় ডাঃ গাঙ্গুলী ও সমীরবাবু দুজনে এক জায়গায় ছিলেন। যতীনবাবুর (যাঁর গগনেন্দ্রনাথকে খুন করবার মত কোন সঙ্গত কারণই থাকতে পারে না) একটা alibi আছে বটে, তিনি, বারীনবাবু ও সমরবাবু একসঙ্গে ছিলেন। রণধীরবাবু ও তার স্ত্রী বিনতা দেবী পাশের ঘরেই ছিলেন; ঐ সময়ে ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী তার ঘরে একা একা শুয়ে জ্বরে গোঙাচ্ছেন। হোটেলে নীচের তলায় আর কেউই প্রায় ছিল না। ঐ সময় কারো কাউকে খুন করবার অপূর্ব সুযোেগ হতে পারে। এমন কি কেউ হোটেলের নীচের তলায় ঐ সময় ছিল যে গগনেন্দ্রনাথকে খুন করতে পারে? বলতে বলতে কিরীটী আড়চোখে একটিবার অদূরে উপবিষ্ট কিশোরের দিকে তাকাল। তারপর আবার বলতে লাগল, একজন সে-সময় সেখানে ছিল—সে হচ্ছে কিশোর। কিশোর সেদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আগাগোড়া হোটেলে নিজের ঘরেই ছিল। হোটেলের বাইরে যায়নি।