সহসা এমন সময় সমীর উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, না না, কখনও না। একেবারে মিথ্যা কথা।
কিন্তু সমীরবাবুর প্রতিবন্ধকে কোনরূপ কান না দিয়েই কিরীটী বলে যেতে লাগল, বেশ তাই যদি হয়, তাহলে এখন দেখা যাক, অধীরবাবুর দ্বারা তার কাকাকে খুন করা সম্ভব কিনা? অধীরবাবুর বিরুদ্ধে প্রমাণ কি? তারও মানসিক অবস্থা তার মেজদা সমীরবাবুর মতই ছিল এবং দু ভাই কতকটা একই মনোবৃত্তির। কেননা তার সঙ্গেই সেরাত্রে সমীরবাবু তাদের কাকাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
অধীরবাবু পাঁচটা দশ মিনিটের সময় হোটেলে ফিরে আসেন। তিনিও বলেছেন তিনি ফিরে এসেই সোজা প্রথমে তার কাকার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং তিনিও নাকি তার কাকার সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। অথচ সেই সময় কেউই তাকে তার কাকার সঙ্গে কথা বলতে দেখেননি। অর্থাৎ কেউ তার উক্তির সাক্ষী নেই। এক্ষেত্রে অধীরবাবুর চমৎকার একটা alibi আছে। কেউ তখন সেখানে ছিল না। বারীনবাবু, যতীনবাবু ও সমরবাবু বাইরে চলে গেছেন। ওঁদের সকলের movement–এর সময়তালিকা থেকেই তা প্রমাণিত হয়। তাই যদি হয় এবং তার ঐ alibi প্রমাণিত না হয়, তবে অধীরবাবুর পক্ষে এক্ষেত্রে তার কাকাকে খুন করা এতটুকুও অসম্ভব বা আশ্চর্যজনক নয়।
অধীর কিরীটীর দিকে সহসা চোখ তুলে চাইল। কী একটা করুণ মিনতি, কী দারুণ অবসন্নতায় ভরা তার দু-চোখের দৃষ্টি!
কিরীটী আবার বলতে লাগল, আরও একটা কথা, যেদিন গগনেন্দ্রবাবু খুন হন, তার পরদিন সকালে অধীরবাবুকে কেউ তার জানালা দিয়ে কোন একটা বস্তু বাড়ির পিছনের দিকে ফেলে দিতে দেখেছিলেন এবং সেটা হচ্ছে একটা হাইপোড়রমিক সিরিঞ্জ।
সহসা এমন সময় ডাঃ চক্রবর্তী বলে উঠল, কিন্তু আমিও পরদিন সকালে আমার হারিয়ে যাওয়া সিরিঞ্জটা আমার ঔষধের ব্যাগের উপরেই পাই।
কিরীটী বললে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি আপনার সিরিঞ্জটা পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু এটা আর একটা সিরিঞ্জ। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি অধীরবাবু?
অধীর জবাব দিলে, সেটা আমার নিজস্ব সিরিঞ্জ ছিল।
তাহলে আপনি স্বীকার করছেন যে, আপনিই সেদিন সকালে সে সিরিঞ্জটা জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কেন স্বীকার করব না?
সহসা এমন সময় বিনতা অধীরকে বাধা দিয়ে প্রবলভাবে বলে উঠল, অধীর, অধীর, এ তুমি কি বলছো ভাই! কিছুই তো আমি বুঝতে পারছি না।
বিস্মিত ও রাগান্বিত ভাবে অধীর তার বৌদির দিকে ফিরে তাকাল, এতে আশ্চর্য হবার বা না বুঝবার মত তো কিছুই নেই বৌদি। পুরাতন একটা সিরিঞ্জ আমার এক ডাক্তার বন্ধু আমাকে একসময় দিয়েছিল। সেটা সেদিন সকালে ফেলে দিয়েছি; কিন্তু আমি কাকাকে খুনও করিনি বা বিষও দিইনি।
এমন সময় প্রতিমা বলে উঠল, আমিই সিরিঞ্জটা কয়েক দিন আগে অধীরবাবুকে দিয়েছিলাম।
আশ্চর্য! সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সিরিঞ্জের ব্যাপারটা। তবু মনে হচ্ছে, কিরীটী বলতে লাগল, এর একটা মীমাংসাও যেন খুঁজে পাচ্ছি। দুটো সিরিঞ্জও পাওয়া যাচ্ছে। এবং তা থেকে দুটো ব্যাপার আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠছে। প্রথমটায় অধীরবাবুকে দোষী প্রমাণ করতে পারলে, হয়ত সমীরবাবুর নির্দোষিতা প্রমাণ হয়ে যায়, কিন্তু সব দিক ভাল করে দেখেশুনে আমাদের সুবিচারই করতে হবে। দেখা যাক, অধীরবাবু যদি নির্দোষ হন, তবে কিভাবে ব্যাপারটা ঘটতে পারে। তিনি হোটেলে ফিরে এলেন। তিনি তার কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন তিনি মৃত (?), তার তখন মনে হতে পারে যে হয়ত তার মেজদাই কাকাকে খুন করেছেন। কেননা তাঁরা দুজন মাত্র কয়েকদিন আগে এক রাত্রে তাদের কাকাকে এ পৃথিবী থেকে সরাবার কল্পনা করেছিলেন। ফলে ঐ কথাটা সহসা মনে উদয় হওয়ায় হয়ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কী করবেন, কী ঐ সময় করা উচিত—এই সব নানা সাত-পাঁচ ভেবে হয়ত শেষে তিনি ঐ সময় কোন কিছু না প্রকাশ করাই সব দিক থেকে বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করে সরে পড়েন এবং এর কিছুক্ষণ বাদে সমীরবাবু ফিরে এসে কাকার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যখন জানতে পারলেন যে তার কাকা মৃত তখন তিনিও ঐ এক কারণেই কিছু প্রকাশ না করে চুপ করে সরে পড়লেন। এদিকে হয়ত অধীরবাবু ঘরে ঢুকেই তার ঘরে সিরিঞ্জটা দেখতে পান এবং সাত-পাঁচ ভেবে সেটা সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে ফেলেন। পরের দিন সকালে সেটা বাড়ির পিছনদিকে ফেলে দেন। কেননা হয়ত তার সন্দেহ হয়েছিল, তার মেজদাই এ সিরিঞ্জ দিয়ে কাকাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছেন।
এ ছাড়াও আর একটা দিক দিয়ে মনে হয় অধীরবাবু নির্দোষ। তিনি আমাকে তার একটু আগে দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন যে তিনি দোষী নন। কিন্তু এমন কথা বলেননি যে তারা দোষী নন, কেননা তার মনে মেজদার প্রতি দৃঢ় সন্দেহ ছিল। কিন্তু আমার কানে ঐ তিনি ও তারার পার্থক্যটা এড়ায়নি। এর থেকেই হয়ত অধীরবাবুর নির্দোষিতা প্রমাণ হতে পারে।
ঘরের প্রত্যেকটি প্রাণীই যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত কিরীটীর কথা শুনছে। কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।
কিরীটী একটুখানি থেমে একটা নতুন সিগারেট ধরিয়ে মৃদু একটা টান দিল ও একগাল ধোঁয়া ছেড়ে আবার বলতে শুরু করল, আচ্ছা, এবারে সমীরবাবু নির্দোষ কিনা এইভাবে বিচার করে দেখা যাক। ধরা যাক, অধীরবাবুর কথাই সত্যি। গগনেন্দ্রনাথ পাঁচটা ত্রিশ মিনিটের সময় বেঁচেই ছিলেন। তাই যদি হয়, তবে কি ভাবে সমীরবাবু দোষী হতে পারেন? আমরা ধরে নিতে পারি, পাঁচটা পঞ্চান্ন মিনিটের সময় যখন তিনি বেড়িয়ে হোটেলে ফিরে আসেন, যখন তার কাকার সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন, সেই সময় তাকে তিনি খুন করেন। সে-সময় আশেপাশে লোক ছিল বটে, কিন্তু শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সেই স্বল্পালোকে অন্যের অজান্তে তার পক্ষে তার কাকাকে খুন করাটা এমন কিছু কষ্টসাধ্য বা আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। কিন্তু তাহলে ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর কথা মিথ্যে হয়ে যায় যে, তার মতে গগনেন্দ্রনাথের দেহ পরীক্ষা করবার অন্তত এক ঘণ্টা আগে মৃত্যু হয়েছে।