১। সমীরবাবুরা সকলে ও সমরবাবু তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় হোটেল থেকে বেড়াতে বের হন।
২। তিনটে পনের মিনিটের সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ও ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী বেড়াতে বের হন।
৩। চারটে পনের মিনিটের সময় বারীনবাবু ও যতীনবাবু বেড়াতে যান।
৪। চারটে কুড়ি মিনিটের সময় ডাঃ চক্রবর্তী জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসেন।
৫। চারটে পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীরবাবু বেড়িয়ে হোটেলে ফিরে আসেন।
৬। চারটে চল্লিশ মিনিটের সময় তার স্ত্রী বিনতা দেবী ফিরে আসেন ও ফিরে তার খুড়শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেন।
৭। চারটে পঞ্চাশ মিনিটের সময় বিনতা দেবী তাঁর স্বামীর ঘরে যান।
৮। পাঁচটা দশ মিনিটের সময় অধীরবাবু বেড়িয়ে ফিরে আসেন।
৯। পাঁচটা চল্লিশ মিনিটের সময় বারীনবাবু, যতীনবাবু ও সমরবাবু ফিরে আসেন।
১০। পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় সমীরবাবু ফিরে আসেন।
১১। ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে আসেন।
১২। ছটা তিরিশ মিনিটের সময় ভৃত্য গগনেন্দ্রনাথকে চা খেতে ডাকবার জন্য গিয়ে দেখে তিনি মৃত।
***
কিরীটী বলতে লাগল, উপরিউক্ত সময়ের তালিকা বিচার করলে দেখা যাচ্ছে তিনটে পাঁচ মিনিটের সময় সমীরবাবু অন্য ভাইদের সঙ্গে হোটেল থেকে বেড়াতে বের হন। গগনবাবু তখন বেঁচে ছিলেন। বেড়াতে গিয়ে সমীরবাবু ও প্রতিমা গাঙ্গুলীর সঙ্গে কথাবার্তা হয়। প্রতিমা দেবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ একসময় তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে আসেন। তার কথামত পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময় হোটলে এসে ঢোকেন। তিনি হোটেলে এসে তার কাকার সঙ্গে দেখা করেন ও কথাবার্তা বলেন; তারপর নিজের ঘরে চলে যান ও ছটার সময় সকলের সঙ্গে চা খেতে খাবার ঘরে আসেন। তিনি তার জবানবন্দিতে বলেছেন, পাচটা পঞ্চাশ মিনিটের সময়ও নাকি তার কাকা বেঁচে ছিলেন। কিন্তু পরের একটা ব্যাপারে বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টই যে তার কথা ঠিক নয় বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সাড়ে ছটার সময় গগনবাবুকে চা পান করতে ডাকতে গিয়ে ভূত তাকে মৃত অবস্থায় পায়। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী নিজে একজন ডাক্তার। তিনি বলেছেন তার ডাক্তারী বিদ্যানুযায়ী গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু, যখন তাকে মৃত বলে আবিষ্কার করা হয়, তারও একঘণ্টা আগে ঘটেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে ডাঃ গাঙ্গুলী ও সমীরবাবুর কথা যদি সত্যি বলে মেনে নিই, তবে একজনের statement অন্যজনের statement-এর সঙ্গে আদপেই মিলছে না। Conflicting statements! যদি মেনে নিই যে ডাঃ গাঙ্গুলী ঠিক বুঝতে পারেননি….
সহসা এমন সময় কিরীটীকে বাধা দিয়ে প্রতিমা বলে উঠল, না মিঃ রায়, আমি আপনাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি ভুল আমার হয়নি। তাছাড়া অত সহজে আমি ভুল করি না।
কিরীটী বললে, বেশ, তাই যদি মেনে নিই, তবে এই ধরনের conflicting statement থেকে দুটো conclusion আমরা করতে পারি। হয় ডাক্তার গাঙ্গুলী অথবা সমীরবাবু দুজনের একজন ইচ্ছা করে মিথ্যা কথা বলছেন!
প্রতিমা কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বলতে লাগল, কিন্তু ধরে নিই যদি সমীরবাবুই এক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলছেন, দেখা যাক কেন তিনি মিথ্যা কথা বলছেন। তার এ ধরনের মিথ্যা বলবার গোপন উদ্দেশ্য আছে কিনা? ধরে নেওয়া গেল ডাঃ গাঙ্গুলীর কথাই সত্য, তার ভুল হয়নি বা তিনি ইচ্ছা করে মিথ্যা কথা বলছেন না, সমীরবাবু হোটেলে ফিরে এসে কাকার সঙ্গে যখন দেখা করেন, তার আগেই তার কাকা মারা গেছেন, অর্থাৎ তিনি গিয়ে তার কাকাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান এবং ধরে নিই, যদি সত্যি তাই হয়েই থাকে, তবে সেই অবস্থায় তাঁর পক্ষে তখন কি করা সম্ভব?
হয় তিনি ঘাবড়ে গিয়ে সাহায্যের জন্য সকলকে ডাকাডাকি শুরু করতে পারেন, অথবা ধীরভাবে তখুনি গিয়ে সকলকে ব্যাপারটা জানান কি হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি প্রথমে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যান। তারপর কোন কিছু ভেবে কাউকে ও বিষয়ে কোন কথা না বলাই শ্রেয় বিবেচনা করে নিঃশব্দে সে স্থান ত্যাগ করে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করেন। কী বলেন আপনি সমীরবাবু, তাই নয় কি?
সমীরবাবু বাধা দিয়ে বললেন, ব্যাপারটা তাহলে একেবারে হাস্যকর বা ছেলেমানুষির মত দাঁড়ায় না কি?
তাহলে বলতে হয়, কিরীটী বললে, ডাঃ গাঙ্গুলীই হঠাৎ ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসময় সম্বন্ধে ভুল করেছেন! কিন্তু তার আগে আমরা ভাবব, এ ধরনের ব্যবহার করা আপনার পক্ষে তখন সম্ভব ছিল কিনা। কেননা তাতে এও প্রমাণ হয় যে, আপনি নির্দোষ। কেননা আপনি যখন আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করতে যান, তিনি তখন মৃত। বেশ এখন ধরা যাক, তাই যদি ঘটে থাকে এবং সত্যিই সমীরবাবু নির্দোষ হন, তবে তার ঐদিনের ঐ অদ্ভুত ব্যবহারের একটা মীমাংসায় আমরা আসতে পারি কিনা? এর মীমাংসা সহজেই হয়, যদি তাকে নির্দোষ ধরে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তার সেই রাত্রের কথাগুলো, যা তিনি তার ভাইকে বলেছিলেন তাঁর কাকার সম্পর্কে সেটাও মনে রাখতে হবে আমাদের। তিনি হোটেলে ফিরে এসে কাকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যখন দেখলেন। তার কাকা মৃত, তার দোষী মন ও দোষী স্মৃতিতে সহজেই একটা সম্ভাবনা জেগে ওঠা স্বাভাবিক যে তাদের সেই রাত্রের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে-কিন্তু তার দ্বারা হয়নি। অর্থাৎ তিনি যখন সে পরিকল্পনাকে কার্যে পরিণত করেননি তখন নিশ্চয়ই তার সঙ্গী করেছে। ফলে প্রথমেই হয়ত তার ছোটভাই অধীরের কথা মনে পড়ল। কেননা তারা দুজনেই এ কল্পনা করেছিলেন।