সকলেই উদগ্রীব হয়ে উঠল, প্রত্যেক ভাইয়ের মুখেই যেন একটা ভীতি-চিহ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
কিন্তু আর একটা কথাও এই সঙ্গে ভাবতে হবে কিরীটী, যেভাবে সাজিয়ে খুন করা হয়েছে, ততখানি জ্ঞান বা মনের গঠনশক্তি কিশোরের ছিল কিনা সন্দেহ। অবশ্য এ ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্তেরা খুব সহজ ও সাধারণ ভাবেই খুন করে। ভেবেচিন্তে চাতুর্যের সঙ্গে করে না, যেটা এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। সে যদি খুন করত, তবে একটা spectacular ভাবেই খুন করত-যা এক্ষেত্রে হয়নি।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা খুন হবার পর, তোমার কি মনে হয় ডাক্তার, বাকি সবাই জানতে পেরেছিল?
ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ। আমার মনে হয় এঁরা জানতেন এবং সেটাই আমার মনে সর্বপ্রথম সন্দেহের উদ্রেক করে। এমন ধরনের একদল ভীতু লোক ইতিপূর্বে আমি দেখিনি। এদের দেখলেই মনে হয়, যেন এরা প্রত্যেকেই ইচ্ছা করে কিছু গোপন করে রেখেছেন।
তাই যদি হয়, কিরীটী জবাব দিল, তবে এঁদের মুখ দিয়েই বলিয়ে নেব আসল ব্যাপারটি কি?
ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, অসম্ভব। তা তুমি পারবে না।
না, অসম্ভব নয়। তুমি হয়ত জান না, সাধারণ কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই এঁদের মুখ দিয়ে আমি অনেক সত্য কথা ইতিপূর্বে বের করি নিয়েছি এবং বাকি সত্যটুকুও আজকের আলোচনার মধ্য দিয়ে বলিয়ে নেব। মোটামুটি ভাবে সাধারণত মানুষ সত্য কথাই বলতে চায় বা বলেও থাকে।
তার কারণ মিথ্যা কথা বলবার চাইতে সত্য কথাটা বলা অনেক সহজ। কেননা সত্য কথা বলতে ভাবতে হয় না বা চিত্ত করতে হয় না, আপনা থেকে যেন আপনিই বের হয়ে আসে। তুমি একটা মিথ্যা কথা বলতে পার, দুটো বা তিনটি বলতে পার, কিন্তু কেবলই অনবরত একটার পর একটা শুধু মিথ্যা কথাই বলে যেতে পার না। সেটা অসম্ভব।
সত্য একসময় তোমার অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবেই এবং তখুনি সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে এদের প্রশ্ন করে ও খোঁজ নিয়ে যতটুকু জেনেছি, তার থেকে মোটামুটি ভাবে কতকগুলো point খাড়া করেছি। যেমন :
১। গগনেন্দ্রনাথ তাঁর হার্টের ব্যারামের জন্য প্রত্যহ নিয়মিত ভাবে এমন একটা ঔষধ খাচ্ছিলেন, যার মধ্যে একটা ingredient হচ্ছে ডিজিট্যালি।
২। ডাঃ চক্রবর্তীর একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ তার মেডিকেল ব্যাগ থেকে খোয়া যায় সেদিন।
৩। গগনেন্দ্রনাথ তার ফ্যামিলির কাউকে বাইরের কোন তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে মিশতে দিতে একেবারেই পছন্দ করতেন না ও কোথাও বের হতে দিতেন না।
৪। কিন্তু ঐদিন বিকালে সকলকেই বাইরে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং হোটেলে তিনি একা ছিলেন।
৫। সমীরবাবু তার জবানবন্দিতে প্রথমে বলেছিলেন তিনি বেড়িয়ে যখন ফিরে আসেন তখন ঠিক সময় কত তা তিনি জানতেন না, কেননা তার ঘড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে বলেন, তিনি তাঁর কাকার হাতের রিস্টওয়াচ দেখে সময় ঠিক করে নেন।
৬। ডাঃ চক্রবর্তী ও কিশোর পাশাপাশি ঘরে থাকতেন।
৭। সাড়ে ছটার সময় চা খাবার জন্য যখন সকলে প্রস্তুত তখন সবাই খাবার ঘরে বসে, তবু একজন ভৃত্যকে গগনেন্দ্রনাথকে চা খেতে আসবার জন্য ডাকতে পাঠানো হয়েছিল।
৮। গগনেন্দ্রনাথ একদিন বলেছিলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না, মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি, সব আমার মনে আছে। সব মুখই আমার মনে আছে।
যদিচ আমি প্রশ্নগুলো, কিরীটী বলতে লাগল, আলাদা আলাদা ভাবে টুকেছি, তথাপি একসঙ্গে সব কটি point বিচার করা যায়। যেমন প্রথম দুটো পয়েন্ট, গগনেন্দ্রনাথ তার হৃদরোগের জন্য নিয়মিত ভাবে একটা ঔষধ পান করতেন, যার মধ্যে একটা ingredient ছিল ডিজিট্যালিন। ডাঃ চক্রবর্তীর একটু হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ খোয়া যায়। ঐ দুটো পয়েন্টই এই কেসে আমার মনকে সর্বপ্রথম সন্দেহাম্বিত করে তোলে। আমার আর এখন বলতে বাধা কিছুই নেই যে, এই দুটি প্রশ্ন আমার বিচারে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এবং অমিল বলে মনে হয়। বুঝতে পারছেন না আপনারা বোধ হয় আমি কি বলতে চাচ্ছি। শীঘ্রই সব আমি বুঝিয়ে দেব। শুধু এইটুকুই সকলে মনে রাখুন, উপরিউক্ত এই দুটি point আমার কাছে মনে হয়, যার মীমাংসা সর্বপ্রথম হওয়া প্রয়োজন এই কেসে। সকলেরই জবানবন্দি আমি নিয়েছি, এখন সেই জবানবন্দি থেকে যেটুকু তথ্য আপনাদের সকলের মুখ থেকে আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি সেই সম্পর্কেই আলোচনা করা আমাদের এই মিলনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
কিরীটী একটুখানি থেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করলে, গোড়া থেকেই শুরু করছি। সর্বপ্রথম সমীরবাবুর কথাই বিচার করে দেখা যাক। তার পক্ষে তার কাকার জীবন নেওয়া সম্ভব ছিল কিনা? তিনি একদিন গভীর রাত্রে তার ভাই অধীরবাবুর সঙ্গে তাদের কাকার জীবন নেওয়ার সংকল্প করছিলেন আমি তা নিজের কানে শুনেছিলাম। আমি জানি সেসময় সমীরবাবু একটি ভয়ানক মানসিক উত্তেজনার মধ্যে ছিলেন। ঐ ব্যাপারের সময় তার মনে আরও একটা অন্য উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলীর সস্নেহ আকর্ষণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক, প্রতিমা দেবীর দিকে তার মন তখন ঝুঁকেছে। তার তখনকার মানসিক অবস্থায় তার পক্ষে যে-কোন কাজ করা আশ্চর্য নয়। তিনি তার বর্তমান জীবনের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে উঠেছিলেন। এবং সেই অবস্থায় তার কাকার সম্মোহন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শেষ উপায় বেছে নেওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক। অথবা যে কল্পনাটা তার একদা মানসিক উত্তেজনার মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছিল, সেটাকেও কার্যে পরিণত করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। ভাল কথা, কথাপ্রসঙ্গে আপনাদের ঐদিনকার ঐ সময়ের গতিবিধির একটা তালিকা তৈরী করেছি, সে সম্পর্কেও একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক।