তা একটু আছে। কেননা আমাদের দুজনের নিজস্ব সে-সব কথা। এ কেসের সঙ্গে কোন সম্পর্কই নেই।
আপনার সঙ্গে সমীরবাবুর কতদিনের আলাপ?
এখানে এসেই আলাপ হয়।
সমীরবাবু লোক কেমন বলে আপনার মনে হয়?
ভালই। প্রতিমার মুখখানা সহসা কেন না-জানি রাঙা হয়ে উঠল।
কিরীটী মনে মনে হাসতে হাসতে আবার প্রশ্ন করলে, ভালই মানে? আপনার তাকে ভাল লাগে, বলুন?
এ প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য কি, মিঃ রায়?
আচ্ছা কখন আপনি হোটেলে ফিরে আসেন?
সন্ধ্যা প্রায় ছটার সময়।
আপনি প্রথমে গগনেন্দ্রনাথের মৃতদেহ পরীক্ষা করে বলেন যে তিনি মারা গেছেন?
হ্যাঁ।
আচ্ছা আপনি যখন গগনেন্দ্রনাথের দেহ পরীক্ষা করেন, তার কতক্ষণ আগে তার মৃত্যু হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?
ঘণ্টাখানেক আগেই বলে মনে হয়েছিল।
তাহলে আপনার ডাক্তারী মতে গগনেন্দ্রনাথকে মৃত আবিষ্কৃত হবার এক ঘণ্টা আগে তার মৃত্যু হয়েছিল?
হ্যাঁ, তাই।
আপনারা, মানে আপনি, বারীনবাবু ও সমরবাবু একসঙ্গে বেড়িয়ে ফিরেছিলেন?
হ্যাঁ।
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।
***
পরের দিন যতীনবাবু কিরীটীর ঘরে এসে বললেন, মিঃ রায়, আপনার সঙ্গে একটা বিশেষ কথা ছিল।
বলুন?
যতীনবাবু পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে কিরীটীর হাতে দিতে দিতে বললেন, এই সিরিঞ্জটা আমি গগনবাবু যেদিন মারা যান, সেদিন একজনকে ঘরের পিছনদিককার জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে দেখি। আগের দিন রাত্রে কয়েকটা বাজে কাগজের সঙ্গে আমার একটা জরুরী চিঠি বাড়ির পিছনদিকে ভুলে ফেলে দিয়েছিলাম, পরদিন সকালবেলা যখন সেটা খুঁজতে যাই, হঠাৎ সামনের দিকে আমার একটা জানালা খোলার শব্দে নজর পড়ায় দেখতে পাই, অধীরবাবু তার ঘরের পিছনদিককার জানালা থেকে এটা ফেলে দিলেন। তিনি আমাকে দেখতে পাননি কিন্তু আমি তাকে স্পষ্ট দেখেছিলাম, পরে কৌতূহল হতে গিয়ে দেখি একটা সিরিঞ্জ। কাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম এটা হয়ত আপনার কাজে লাগতে পারে, তাই এটা আপনাকে দিতে এসেছি।
আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ যতীনবাবু, একটা সন্দেহ আমার মিটল।
৪. আলোকের সন্ধানে
কিরীটীর বসবার ঘর।
রাত্রি তখন প্রায় পৌনে নটা হবে।
খাওয়াদাওয়া সকলের হয়ে গেছে, কিরীটী একটা খোলাখুলি আলোচনা করবার জন্য সকলকেই তার ঘরে আহ্বান করেছে। রণধীর, বিনতা দেবী, সমীর, অধীর, কিশোর, ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী, ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী, বারীন চৌধুরী, যতীনবাবু, সমর রায় ও স্থানীয় থানাইনচার্জ অমরেন্দ্রবাবু।
***
কিরীটী বলছিল, ভদ্রমোহদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আজ রাত্রে আপনাদের এখানে কেন আমি ডেকে পাঠিয়েছি জানেন? একটা খোলাখুলি আলোচনা করবার জন্য। একটা কথা সর্বাগ্রে আপনাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত, ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর মতের সঙ্গে আমিও একমত। অর্থাৎ গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাকে খুন করা হয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং আমি তা প্রমাণ করব। কিন্তু করবার আগে আমি সকাতরে অনুনয় জানাচ্ছি, যদি আপনাদের মধ্যে কেউ কোন কথা গোপন করে থাকেন তবে আমাকে এখনও বলুন।
কিন্তু সকলেই স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল, কারও মুখে কোন কথা নেই।
বেশ তবে শুনুন, গম্ভীর স্বরে কিরীটী বলতে শুরু করল, প্রথম থেকে চিন্তা করে দেখতে গেলে, ডাঃ চক্রবর্তীর মতামতটা অবহেলা করলে চলবে না। তিনি তার মতটা চিন্তা করেই দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন এই হত্যাকাণ্ড দলবদ্ধভাবে হয়েছে, না কোন একজনের দ্বারাই হয়েছে। কথা হচ্ছে মানসিক উত্তেজনার ফলে কেউ কাউকে খুন করতে পারে কিনা? ডাঃ চক্রবর্তী, আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, আপনার এ বিষয়ে মতামত কি?
ডাঃ চক্রবর্তী বললেন, হ্যাঁ, তা হতে পারে, অত্যন্ত মানসিক চিন্তা বা উত্তেজনার ফলে খুন করা কিছুই অসম্ভব নয়।
কিরীটী জবাব দিল, সেরকম মানসিক উত্তেজনা এঁদের সকলেরই ছিল। বহুদিন ধরে এঁরা প্রত্যেকে এদের জীবনের সঙ্গে অন্যের জীবনের তুলনামূলক পার্থক্যটা সব সময় রূঢ় ভাবেই দেখতেন। রণধীরবাবুর মনের অবস্থা যা ছিল, সমীরবাবুরও তাই। একটা মানসিক বিদ্রোহ তিল তিল করে বহুদিন ধরে নিরন্তর একটা মানসিক উত্তেজনার ফলে গড়ে উঠেছে। অধীরবাবুর মানসিক অবস্থাটাকে apathy বলা চলে, কিন্তু কিশোরের অবস্থা আপনার কি বলে মনে হয় ডাঃ চক্রবর্তী?
মানসিক অবস্থা তার ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডাঃ চক্রবর্তী বলতে লাগলেন, সে ইতিমধ্যে Schizophreniaর symptoms দেখতে শুরু করেছিল। তার জীবনের প্রতি রূঢ়তা ও নির্বিমুখতা তাকে নিরন্তর পীড়িত করছিল। এক কথায় যাকে suppression বলা চলে, তা থেকে সে ক্রমে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছিল। তার মন সব অদ্ভুত deluison বা স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করছিল। সে নিজেকে কখনো কখনো শত্রু ও ভয়ঙ্কর সব লোকেদের দ্বারা পরিবেষ্টিত দেখত। এটা বিশেষ চিন্তার কথা। কেননা এই ধরণের মনের অবস্থা থেকেই অনেক সময় খুন করবার একটা প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। এখানে suferer খুন করে খুন করবার জন্য নয়। নিজেকে অত্যাচার থেকে বাঁচাবার জন্য। ওদের মানসিক বিকারের দিক থেকে বিচার করে দেখতে গেলে এটা খুবই rational–স্বাভাবিক।
হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করলে, তবে কি তোমার মনে হয় ডাক্তার, কিশোরই তার কাকাকে খুন করেছে?