***
বিনতা দেবী এসে ঘরে প্রবেশ করল।
কিরীটী মুখ তুলে একটিবার বিনতা দেবীর দিকে তাকাল।
মুখের দিকে চাইলে মনে হয় যেন প্রবল একটা ঝড় ওর মনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে।
মাথার চুল রুক্ষ মুখখানা শুকিয়ে গেছে।
কিরীটী বললে, বসুন বিনতা দেবী।
বিনতা ধীরে ধীরে সামনের চেয়ারটার উপরে বসল।
বিনতা দেবী, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই, আশা করি সঠিক জবাব পাব।
আমার সাধ্যমত আপনার প্রশ্নের জবাব দেব, মিঃ রায়।
আপনি সেদিন বিকেলে কখন ফিরে আসেন?
সাড় চারটের পর, পাঁচ-দশ মিনিট এদিক ওদিক হতে পারে।
আপনি শেষ কখন আপনার খুড়শ্বশুরকে জীবিত অবস্থায় দেখেছিলেন?
বেড়িয়ে ফিরে আসবার পর আমি কাকার সঙ্গে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে কথা বলি, তারপর আমার স্বামীর ঘরে চলে যাই। চা খেতে যাবার আগে পর্যন্ত সেই ঘরেই আমরা দুজনে ছিলাম।
কি কথা হয়েছিল আপনার সেই সময় কাকার সঙ্গে?
বিশেষ কিছুই নয়, তারই শরীর সম্পর্কে দু-একটা কথা হয়েছিল।
সেই সময় তাকে কোনপ্রকার অসুস্থ বা কোনরকম অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয়েছিল?
না।
আপনার শ্বশুরের শুশ্রুষা ও ঔষধপত্র দেওয়ার কাজ আপনিই বরাবর করতেন শুনেছি?
হ্যাঁ, তার কারণ বি. এ. পাস করে চাকরি নেওয়ার আগে আমি কিছুদিন নার্সিং শিখেছিলাম।
তাহলে ডাক্তারী আপনি কিছু কিছু জানেন বলুন?
তা একটু-আধটু জানি বললে বিশেষ ভুল হবে না মিঃ রায়। আমার এক মামাতো ভাই ডাক্তার ছিল, সে-ই আমাকে সাধারণ ডাক্তারী ও নার্সিং সম্পর্কে ছোটোখাটো অনেক কিছু শিখিয়েছিল এবং একসময় আমারও নার্সিং শিখবার প্রবল আগ্রহ ছিল।
হ্যাঁ, ভাল কথা, যে ঔষধের শিশিটা থেকে তিনি ঔষধ খেতেন সেটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হ্যাঁ, শিশিটা ভেঙে গিয়েছিল তাই ফেলে দেওয়া হয়েছে।
আচ্ছা আপনার খুড়শ্বশুর যে ঔষধটা প্রত্যহ খেতেন তার হার্টের ব্যারামের জন্য, তার মধ্যে ডিজিটসিন ছিল জানতেন?
না।
ডিজিটসিন posion-তা জানেন?
জানি।
আপনার স্বামী ও আপনি দুজনেই গগনেন্দ্রনাথের শাসনের আওতায় হাঁফিয়ে উঠেছিলেন?
সুস্থ ব্যক্তি মাত্রেরই সে অবস্থা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে এ বাড়ির বিষাক্ত আবহাওয়ায় থেকে থেকে আমার স্বামীর মনটা যেন আগাগোড়া শুকিয়ে গিয়েছিল। তিনিও যে একজন মানুষ এবং তাকে বাঁচাতে হলে যে মানুষের মত বাঁচা প্রয়োজন, সে কথা তাকে হাজারবার বুঝিয়েও বোঝাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত এই বিষাক্ত আবহাওয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমি এ বাড়ি ও আমার স্বামীকে ছেড়ে চলে যাব, এ কথাও কয়েকদিন আগে আমার স্বামীকে বলেছিলাম, যাতে করে তার ঘুমন্ত মনটা সাড়া দেয়।
আপনার কাকার মৃত্যুটা স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক বলে মনে হয়?
স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। ডাঃ চক্রবর্তীর যুক্তি মানতে আমি রাজী নই। তাছাড়া তার মৃত্যুতে এরা সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে; এত দীর্ঘদিন অশান্তির পর আজ যদি এরা। শাস্তি একটু পেয়েই থাকে, সে শান্তিটা আপনি নষ্ট করতে এভাবে উদ্যত হয়েছেন কেন মিঃ রায়? এরা তো আপনার কোনও অনিষ্ট করেনি। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, দিনের পর দিন এরা কী মানসিক যাতনাই সহ্য করেছে! মিঃ রায়, আপনাকে মিনতি জানাচ্ছি, এ প্রহসন বন্ধ করুন। এদের একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
শুনুন বিনতা দেবী, আমি বিশেষ কোন একটা ঘটনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখানে এসেছিলাম এবং এখানকার ঘটনা দেখে কেবলই আমার মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা যোগসুত্র আছে। তাছাড়া সত্যের পূজারী আমি, এমন কথা এখনও প্রমাণ হয়নি বা আমি বলিনি যে, আপনাদের মধ্যেই কেউ না কেউ দোষী। তাছাড়া সত্যিই যদি গগনেন্দ্রনাথ খুন হয়েই থাকেন, তবে কি সমাজের পক্ষে, জনসাধারণের পক্ষে এটা একটা প্রকাণ্ড দোষ নয়? খুনীকে নির্বিবাদে সকলের মধ্যে বিচরণ করতে দেওয়াটা কি দোষের নয়? ব্যাপারটা আমি শুধু আপনাদের দিক থেকে বিচার করছি না, করছি ব্যাপক ভাবেই। তাছাড়া এরকম একটা সন্দেহ যখন উঠেছেই, তখন সেই সন্দেহ নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে সন্দেহটাকে মিটিয়ে নেওয়াটাই কি মঙ্গলজনক নয়? আচ্ছা এখন আপনি যেতে পারেন। কিশোরকে একটিবার দয়া করে এ ঘরে পাঠিয়ে দেবেন, তাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
বিনতা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কিরীটী নিশ্চিন্ত ভাবে খাতার মধ্যে কতকগুলো কি নোট করতে লাগল।
ভীতচকিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে রুগ্ন এক বালক এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকাল, কী নাম তোমার খোকা? ঐ চেয়ারেই বস। কিশোর চেয়ারের উপরে বসে পড়ল।
আমার নাম?
হ্যাঁ, কী নাম তোমার?
দাঁড়ান। হ্যাঁ, আমার নাম কিশোর।
কিশোর! বাঃ, বেশ নামটি তোমার! তোমাকে সব চাইতে কে বেশী ভালবাসে কিশোর?
ভাল আমাকে কেউ বাসে না। আমি একা একা ঘরে শুয়ে থাকি। বড্ড ভয় করে আমার। সারারাত কারা যেন আমার বিছানার চারপাশে ঘোরে। তারা কেবলই আমাকে ডাকে। ওদের কাছে তো আমি যাব না-ওরা নিশ্চয়ই কাকার মত কেবল আমাকে বকবে। এই বড় বড় ছুরি তাদের হাতে, আমাকে নিশ্চয়ই তারা খুন করবে। তারাই, তারাই কাকাকে মেরে ফেলেছে। সেদিন আমার ঘরে তাদের একজন এসেছিল, সাদা ধবধবে পরীর মত পোশাক পরা। এমন সময় শুনলাম ডাঃ চক্রবর্তী যেন আমাকে ডাকছেন।