আপনি জানতেন যে, আপনার কাকা নিত্য হার্টের অসুখের জন্য যে ঔষধটা ব্যবহার করতেন তার মধ্যে ডিজিটকসিন ছিল?
না, আমি তো ডাক্তার নই।
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন; দয়া করে অধীরবাবুকে পাঠিয়ে দিন এ ঘরে।
নমস্কার। সমীর উঠে দাঁড়াল।
নমস্কার।
কিরীটী টেবিলের উপরে রক্ষিত খাতাটায় কী কতকগুলো নোট করছিল মাথাটা নীচু করে, ধীরে ধীরে অধীর এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী মুখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অধীরের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে–সামনে বসুন। আপনি শ্রীযুক্ত অধীর মল্লিক?
অধীর চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে বললে, হাঁ।
অধীরবাবু, আপনাকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করব, আশা করি আপনি তার যথাযথ সত্যি জবাব দেবেন।
নিশ্চয় দেব। কী জানতে চান বলুন?
বেশ, আপনার কথা শুনে সুখী হলাম। আচ্ছা অধীরবাবু, আপনার কাকার এই আকস্মিক মৃত্যু, এটা স্বাভাবিক বলে আপনার মনে হয়, না অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয়?
অত্যন্ত স্বাভাবিক। যাঁরা এই সামান্য সাধারণ ব্যাপারের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক কিছুর ধারণা করছেন, তাদের মতের সঙ্গে আমি একমত নই।
কেন?
কেন আবার কী, বুড়ো মানুষ, দীর্ঘকাল ধরে হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন, মারা গেছেন হার্ট ফেল করে, এতে অস্বাভাবিক বা আশ্চর্য হবার কী আছে?
কিন্তু আপনার মতের সঙ্গে একজন বিচক্ষণ ডাক্তার মত মেলাতে পারছেন না, তার ধারণা আপনার কাকার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
কেন?
তার কারণ আপনার কাকার হাতে তিনি ইনজেকশনের দাগ দেখেছিলেন। তাছাড়া তার মেডিকেল ব্যাগের মধ্যে এক শিশি ডিজিটসিন ছিল, সেটা ও একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ তার ব্যাগ থেকে আপনার কাকার মৃত্যুর দিন খোয়া যায়! সিরিঞ্জটা পরদিন পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু ঔষধের শিশিটা এখনও পাওয়া যায়নি। ডিজিটসিন তীব্র বিষ। ডাঃ চক্রবর্তীর ধারণা, ডিজিটসিন overdose-এ কাকার শরীরে প্রবেশ করিয়েই তার আকস্মিক মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। সোজা কথায় বলতে পারেন, তাকে খুন করা হয়েছে। আমাদেরও বিশ্বাস তার সে ধারণা নির্ভুল।
অধীর খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল।
হঠাৎ আবার কিরীটী প্রশ্ন করলে, আপনি সেদিন কখন বেড়িয়ে ফেরেন অধীববাবু?
প্রায় পাঁচটা দশ হবে।
হুঁ। ঠিক সময়টা আপনার মনে আছে কি করে?
আমি হোটেলে ফিরেই খাবার ঘরে গিয়ে খানসামার কাছে এক পেয়ালা চা চাই; খাবার ঘরের ওয়াল-ক্লকের দিকে আমার নজর পড়ে, তাতে তখন পাঁচটা বেজে পনের মিনিট।
বেশ। আপনি বেড়িয়ে ফিরে এসে আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
না।
বেড়িয়ে ফিরবার পর থেকে সন্ধ্যাবেলা চা পান করতে যাবার আগে পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন?
আমার নিজের ঘরে শুয়েছিলাম।
বেশ। আচ্ছা অধীরবাবু, আমি কোণারকে যাবার আগের রাত্রে আপনার ঘরে, রাত্রি তখন প্রায় দেড়টা হবে, কার সঙ্গে আপনি কথা বলছিলেন? কে সে?
কিরীটীর প্রশ্নে অধীর যেন সহসা অত্যন্ত চমকে উঠল, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, মেজদার সঙ্গে।
সমীরবাবুর সঙ্গে?
হ্যাঁ।
আপনার মেজদা কী বলছিলেন, মানে কী সম্পর্কে কথা হচ্ছিল আপনাদের দুজনের মধ্যে?
আমার মনে নেই।
কার সম্পর্কে কথা হচ্ছিল, তাও কি মনে নেই?
না। সঠিক আমার মনে নেই।
এবার কিরীটী তীক্ষ্ণ গম্ভীর স্বরে বললে, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন অধীরবাবু। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন তো, আপনি সত্যি কথা বলছেন, আপনার মনে নেই?
অধীর চুপ করে বসে রইল, চোখ নীচু করেই।
শুনুন অধীরবাবু, কিরীটী রায়ের সঙ্গে বোধ হয় আপনার পরিচয় নেই, তাহলে এভাবে মিথ্যে কথা বলতে সাহস পেতেন না। আপনার সেদিকার কথা হয়ত মনে না থাকতে পারে, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, আপনাদের সে-রাত্রে যে কথাবার্তা হয়েছিল তার কিছু কিছু আমার কানে গিয়েছিল, দুর্ভাগ্যই হোক আর সৌভাগ্যই হোক। আপনাদের মধ্যে কেউ বলছিলেন, না, এ আর সহ্য হয় না, ভেবে দেখ তুই, ওকে খুন করা ছাড়া আর আমাদের মুক্তির উপায় নেই। ওকে খুন করাই উচিত। ও মরুক, ও মরুক। এখন ওর পক্ষে মৃত্যুই মঙ্গল। এবং সেই একই ব্যক্তি এ কথাও বলেছিলেন, আমি নিজে হাতেই ওকে এই পৃথিবী থেকে সরাব। হ্যাঁ, আমিই সরাব এবং তার উপায়ও আমি ভেবেছি। কে এ কথাগুলি সেরাত্রে বলেছিলেন অধীরবাবু, এবং কাকেই বা এ পৃথিবী থেকে সরাবার ষড়যন্ত্র হচ্ছিল?
উত্তেজনায় ভয়ে তখন অধীরের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে, সে কোনমতে একটা ডোক গিলে অতি মৃদু ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বললে, মেজদা কথাগুলো বলছিল, কিন্তু আপনি কি বিশ্বাস করেন আমরা তাকে খুন করেছি?
খুন করেছেন এমন কথা তো আমি বলছি না অধীরবাবু! কিন্তু কথাগুলো…
মিঃ রায়, আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাকার শাসনে নিষ্পেষিত হয়ে, এমন মানসিক অবস্থা আমাদের হয়েছিল যে, কখন কোন উত্তেজনার মুহূর্তে যদি কিছু আলোচনা করে থাকি সেটা কি সত্যি হবে? মানুষ যখন যা মনে ভাবে তাই কি সে করে বা করতে পারে? মনে মনে কখনও খুন করবার কথা ভাবলেই কি খুন করা যায়, আপনি মনে করেন মিঃ রায়?
কিন্তু করা কি একেবারেই অসম্ভব অধীরবাবু?
না না, এ আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমরা আবোল-তাবোল কিছু উত্তেজনার মুখে আলোচনা করলেও, সেটাকে সত্যতায় পরিণত করবার কল্পনাও করিনি।
আপনি এখন যেতে পারেন অধীরবাবু। আপনার বৌদিকে একটিবার দয়া করে পাঠিয়ে দিন।