কিরীটী বললে, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় একথা কেন তোর মনে হচ্ছে কুনো?
দেখ কিরাত, আমি একজন ডাক্তার। মৃতদেহ আমি সেরাত্রে ভাল করেই পরীক্ষা। করেছিলাম এবং বুড়োর ডান হাতের উপরে কি দেখেছিলাম, জানিস?
কি?
ছোট একটি রক্তবিন্দু ও হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ ফোটাবার দাগ। একটা pinpoint puncture! সেটা দেখেই আমার মনে কি একরকম সন্দেহ হয়। তাছাড়া আর একটা জিনিস সে-রাত্রে ঘটেছিল। আমি যখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলে ফিরে আসি, কুইনাইন খাবার জন্য আমার ডাক্তারী ব্যাগটা খুলতে গিয়ে দেখি, ব্যাগের মধ্যে আমার 2.5 c.c.হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা নেই। জ্বরে তখন আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথা বনবন করছে। তবুও একবার ব্যাগটা খুঁজলাম, কিন্তু সিরিঞ্জটা পেলাম না। বুঝতে পারলাম না সিরিঞ্জটা কোথায় গেল, কেননা এখানে আসা অবধি সিরিঞ্জটা আমি একদিনও ব্যবহার করিনি। কিন্তু আশ্চর্য হলেও, সে ব্যাপার নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে শুয়ে পড়লাম কম্বল মুড়ি দিয়ে। তারপর রাত্রি প্রায় দশটার সময় গগনবাবুর মৃতদেহ দেখে আবার ঘরে এসে শুই, এবং রাত্রি তিনটের সময় আবার আর এক দফা কাঁপিয়ে জ্বর আসে।
পরের দিন জ্বর ছাড়লে সকালে মুখ ধুতে উঠে দেখি আমার ব্যাগের উপরেই সিরিঞ্জটা রয়েছে এবং সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতেই বুঝতে পারলাম, সিরিঞ্জটা ব্যবহৃত হয়েছে। তখন স্পষ্টই বুঝতে পারলাম, সিরিঞ্জটা কেউ নিয়েছিল, আবার রাত্রে কোন একসময় ফিরিয়ে রেখে গেছে।
কিন্তু সিরিঞ্জটা কে নেবে? কেনই বা নেবে? আচমকা তখন গগনেন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ল। নানা চিন্তায় আমার মাথা ঘুরতে লাগল।
বিকেলের দিকে সিরিঞ্জটা নিয়ে শহরের একজন কেমিস্টের কাছে গিয়ে সিরিঞ্জের মধ্যে অবশিষ্ট পদার্থটা পরীক্ষা করাতেই দেখা গেল, সেটা ডিজিটসি।
সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা বিদ্যুৎ-চমকের মত মনে এল। গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন; তবে কি কেউ overdose ডিজিটসিন ইজেক্ট করে তাকে হত্যা করেছে?
পাগলের মতো হোটেলে ফিরে এলাম, কেননা আমার ডাক্তারী ব্যাগে এক শিশি ডিজিটকসিন ছিল, কিন্তু আশ্চর্য, হোটেলে ফিরে এসে ব্যাগের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও সে ডিজিটসিনের শিশিটা পেলাম না। ভেবে দেখ, গগনেন্দ্রনাথ হার্টের ব্যারামে ভুগছিলেন, এক্ষেত্রে তাকে একটা overdose ডিজিটকসিন দিয়ে মারা কত সহজ!
কিরীটী এতক্ষণ গভীর মনোেযোগর সঙ্গে অমিয়র কথা শুনছিল, এখন বললে, হুঁ, ব্যাপারটা আগোগোড়াই সন্দেহজনক! কিন্তু তুই কি একথা কাউকে বলেছিস কুনো?
না। তবে একবার ভেবেছিলাম পুলিসে একটা সংবাদ দেব, কিন্তু পরে সাত-পাঁচ ভেবে তোর অপেক্ষায় বসে আছি। তোর কি মত এখন তাই ব! বলে অমিয় কিরীটীর মুখেরদিকে তাকাল।
আচ্ছা ধরে নিচ্ছি, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, কোন foul play আছে, কিন্তু কে খুন করতে পারে? কিরীটী প্রশ্ন করল।
খুন এক্ষেত্রে ভাইপোদেরই মধ্যে কেউ করতে পারে। গগনেন্দ্রনাথের অত্যাচারে প্রত্যেকেই দিনের পর দিন সহ্যের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছেছিল। এক্ষেত্রে বুড়োকে তাদের কার পক্ষেই খুন করাটা অসম্ভব নয়। দীর্ঘদিন একটা tension-এর মধ্যে থেকে থেকে মনের এমন একটা unsecured অবস্থা এসেছিল, যেখানে হঠাৎ ঝোকের মাথায় খুন করাটা এমন কিছুই নয়।
সত্যিই কি সত্য ব্যাপারটা জানতে চাস অমি? তাহলে কিন্তু পুলিসের সাহায্য নিতে হবে, এখানকার থানা-ইনচার্জ কে জানিস?
হ্যাঁ জানি, খোঁজ নিয়েছি, একজন বাঙালী ভদ্রলোক। কটকেই ডোমিসাইলড। নাম অমরেন্দ্রনাথ মিত্র।
পরের দিন অমরবাবুর সঙ্গে দেখা করে কিরীটী ও অমিয় সমগ্র ব্যাপার আলোচনা করল। সমগ্র ব্যাপারটা শুনে অমরবাবু অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।
ফলে ঠিক হল, ডাঃ চক্রবর্তীর evidence-এর উপরে নির্ভর করে ব্যাপারটার একটা investigation করা হবে। রীতিমত আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান শুরু হল।
রণধীর প্রথমটা অত্যন্ত আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু আইনের যুক্তিতে বাধ্য হয়েই তাকে ঘটনার স্রোতে আপনাকে অসহায়ের মত ছেড়ে দিতে হল।
***
অমরবাবুর উপস্থিতিতেই কিরীটী কাজ শুরু করলে। প্রথমে সে প্রত্যেকের (যারা যারা হোটেলের নীচের তলায় ছিলেন) জবানবন্দি নিতে শুরু করলে। প্রথমেই ডাক পড়ল রণধীরের।
কিরীটী প্রশ্ন করতে শুরু করল, আপনার নাম রণধীর মল্লিক?
হ্যাঁ।
আপনি সর্বশেষ কখন আপনার কাকাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান?
আমি বেড়িয়ে ফিরে এসে কাকাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাই। কাকার সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে যখন নিজের ঘরে গিয়ে হাতঘড়িটা খুলে শুয়ে পড়ি, তখন আমার মনে আছে বেশ স্পষ্টই ঘড়িতে চারটে পঁয়ত্রিশ মিনিট।
সময়টা আপনার ঠিক মনে আছে?
আছে।
তারপর আর আপনি আপনার কাকার সঙ্গে দেখা করেননি?
না।
অর্থাৎ আপনি বলতে চান যে আপনার কাকা মৃত জানবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত হোটেলে ফিরে আসা থেকে আর আপনার কাকার সঙ্গে দেখা হয়নি?
না।
বেশ, আপনি বেড়িয়ে এসে ঘরের মধ্যে গিয়ে শুয়েছিলেন কেন?
আমার শরীরটা ভাল ছিল না, মাথাটাও ধরেছিল, তাই।
আপনি যখন ঘরে শুয়েছিলেন, আপনার সঙ্গে আর কারো দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ, প্রায় মিনিট পনের বাদে আমার স্ত্রী এসে আমার ঘরে ঢোকে।