কিরীটী হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণার হাত থেকে সেদিনকার দৈনিকখানা নিল। বললে, বল কি, চৌধুরী যে আমার বিশেষ বন্ধু!
বিখ্যাত দন্ত-চিকিৎসক
ডাঃ এন, এন, চৌধুরীর রহস্যময় মৃত্যু
গতকল্য বেলা সাতটার সময় বিখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডাঃ এন. এন. চৌধুরীকে ধর্মতলাস্থ তার শয়নকক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
অতীব নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক ভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। গলার সামনের দিকে একটা তিন ইঞ্চি পরিমাণ ভয়ঙ্কর ক্ষত ও বাম দিককার বুকেতে একটি চার ইঞ্চি পরিমাণ ক্ষত। মনে হয় যেন কোন তীক্ষ্ণ নখরে গলার ও বুকের মাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে। ডাঃ চৌধুরী মাত্র বছর-চোদ্দ আগে জার্মানী থেকে দন্ত চিকিৎসায় পারদর্শী হয়ে আসেন। শহরে দন্তচিকিৎসক হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম ও প্রতিপত্তি ছিল। ধনী পিতার তিনি একমাত্র পুত্র ছিলেন। নিজেও প্রভূত অর্থ উপায় করেছেন। তিনি অবিবাহিত ও সংযমী, অত্যন্ত বিনয়ী স্বাস্থ্যবান সুপুরষ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে দিন পনের আগে চেতলার অবসরপ্রাপ্ত আলিপুর জেলের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট গণনাথ মিত্রের হত্যার কথা মনে পড়ল। তাকেও একদিন প্রাতে তার শয়নকক্ষে ঐরূপ নৃশংস অবস্থায় পাওয়া যায়। তারও গলায় ও বাম দিককার বক্ষে ঐরূপ নৃশংস ক্ষত ছিল। পুলিসের কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে কী বলেন?
কিরীটী সংবাদপত্রটা কৃষ্ণার হাতে ফেরত দিতে দিতে বললে–
হবুচন্দ্র রাজা তার গবুচন্দ্র মন্ত্রী
পথেঘাটে সদা ঘোরে সশস্ত্র সান্ত্রী!
হঠাৎএকদা রাজা ডাকিলেন ‘গবু’!
রাজ্যে এত খুনোখুনি শুনিনি তো কভু!
কহিলেন গবু : তবে শোন মহারাজ,
নিশ্চয় ঘুমায় সান্ত্রী করেনাকো কাজ।
শুনি হবু বলে তবে চক্ষু করি লাল,
মাহিনা দিতেছি তবু একি হীন চাল!
আমি হবু, তবু রাজ্যে একি অনাচার
এখুনি মস্তকচ্যুত করহ সবার।
শুনি গবু বলে তবে, একি মহারাজ;
গরীবের শির লবে একি তব কাজ!
এমন সময় সুব্রত হাসতে হাসতে এসে ঘরে প্রবেশ করল। কার শির নিচ্ছ হে। কার আবার-তোমার?
অপরাধী জানিল না কি দোষ তাহার? বিচার হইয়া গেল তবু?
এসব কি শুনছি হে সুব্রতচন্দ্র? তোমার রাজ্যে কি আজকাল মানুষেই মানুষ খেতে শুরু করেছে?
হ্যাঁ, কন্ট্রোলের চালে মানুষের পেট ভরছে না, তাই মানুষের বুকের মাংস খুবলে খেতে হচ্ছে।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী বল তো?
মাথামুণ্ডু এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না, তবে চেষ্টার ত্রুটি করছি না।
.
কয়েকদিন পরে গভীর রাত্রে। শীতের মধ্যরাত্রি। স্বল্প কুয়াশার মৃদু অস্বচ্ছ অবগুণ্ঠনতলে কলিকাতা শহর যেন তন্দ্রানত।
ব্ল্যাক আউটের নিস্তেজ বাতির ম্রিয়মাণ রশ্মিগুলি কুয়াশার মায়াজালে আটকা পড়ে যেন মুক্তির আশায় পীড়িত হয়ে উঠেছে।
কিরীটী শ্যামবাজারে এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বাড়ি ফিরছে।
ট্রাম ও বাস বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তায় লোকচলাচল একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে বললেও চলে। শুধু হেথা-হোথা ফুটপাতের উপরে ও ঝোলানো বারান্দার আশ্রয়ে দু-একজন ভিক্ষুক নিঃসঙ্গ রাত্রির বুকে জীবনের স্পন্দনটুকু জাগিয়ে রেখেছে।
কিরীটী ইচ্ছা করেই গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। হীরা সিংকে বলে দিয়েছিল সে হেঁটেই বাড়ি ফিরবে।
প্রভুর এ ধরনের অদ্ভুত খেয়ালের সঙ্গে হীরা বিশেষ করেই পরিচিত ছিল, তাই বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।
কিরীটী গায়ে লংকোটটা চাপিয়ে পাইপটায় অগ্নিসংযোগ করে মৃদু মৃদু টান দিতে দিতে পথ চলছিল।
স্তব্ধ নির্জন রাত্রির একটা নিজস্ব রূপ আছে। প্রকৃতি সেখানে নিঃশেষে আপনাকে মুক্ত করে দেয়। দুহাতে নিঃস্ব করে আপনাকে বিলিয়ে দেয়।
মানুষের মন যেন সেখানে অনায়াসেই আপনাকে খুঁজে পায়, সেখানে কোন দম্ভ থাকে, কোন প্রশ্ন থাকে না, এইভাবে একাকী আপন মনে রাত্রির নিঃসঙ্গতায় পথ চলতে কিরীটীর বড় ভাল লাগে।
বৌবাজারের কাছাকাছি আমহার্স্ট স্ট্রীটের মোড়ে তখনও একটা পানের দোকানে দুএকজন খরিদ্দারের ভিড়। কিরীটী এগিয়ে চলে।
এত বড় জনকোলাহল-মুখরিত নগরী যেন কোন যাদুমন্ত্রের স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত্রি তখন প্রায় দেড়টা হবে—কিরীটী রসা রোড ও লেক রোডের কাছাকাছি এসে আবার তার পাইপটায় নতুন করে তামাক ভরে অগ্নিসংযোগ করে নিল।
সবে কয়েক গজ এগিয়েছে এমন সময় একটা দীর্ণ আর্ত চিৎকার নৈশ রাত্রির স্তব্ধ নির্জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে জেগে উঠল।
কিরীটী থমকে দাঁড়াল।
দীর্ণ চিৎকারটা যেন সহসা রাত্রির স্তব্ধ সমুদ্রে একটা আকস্মিক শব্দের ঢেউ তুলে সহসাই মিলিয়ে গেল।
কিরীটী ভাবলে, শুনতে ভুল হয়নি তো? অন্যমনস্ক ভাবে সে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করতে লাগল।
আবার সেই চিৎকার।
না, ভুল নয়। এ যে কোন মানুষের বুক-ভাঙা দীর্ণ চিৎকার!
কিরীটী উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়াল। আবার সেই চিৎকার!
মনে হচ্ছে যেন ডান দিককার কোন একটা বাড়ি থেকে আসছে সেই চিৎকারের শব্দ।
ডানদিকে কতকগুলো একতলা, দোতলা, তিনতলা নানা আকারের বাড়ি। ব্ল্যাক আউটের স্তিমিত আলোকে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই প্রতীয়মান হয়।
কিরীটী দ্রুতপদে অনুমানে শব্দটা যেদিক থেকে আসছিল সেইদিক লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল।
একটা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পাশের একটা সরু গলিপথ দিয়ে কে যেন ছায়ার মত দ্রুতপদে এগিয়ে এল।