বেশ চলুন।
যতীনবাবু উঠে জামাটা গায়ে চাপিয়ে বারীনবাবুর সঙ্গে ঘর থেকে বের হলেন।
গগনেন্দ্রনাথ তখনও একই ভাবে চেয়ারটার উপরে চুপটি করে শাল গায়ে জড়িয়ে বসে আছেন।
বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে বারীনবাবু উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললেন, আজ কেমন আছেন গগনবাবু?
গগনেন্দ্রনাথ জবাবে ঠিক কি যে বললেন তা শোনা বা বোঝা গেল না বটে, তবে বারীনবাবু মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকিয়ে বললেন, দেখলেন যতীনবাবু, লোকটা সত্যিই কি অভদ্র! শরীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, ঝাজাল স্বরে জবাব দিলেন, বেশ আছি। সত্যি, এত অভদ্র আমি, জীবনে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
যতীনবাবু চলতে চলতেই মৃদুস্বরে জবাব দিলেন, একে ভদ্রলোকের বেশ খিটখিটে মেজাজ, তারপর আবার অসুস্থ। গভর্নমেন্টে যাঁরা চাকরি করেন তাঁরা বুড়ো হয়ে পেনশন নেবার পর এইরকম খিটখিটে বদমেজাজী হন।
তার কারণ কি জানেন? বেশীর ভাগ বুড়োরাই আমাদের দেশে activelife ছেড়ে দেবার পর dispeptic হয়ে পড়েন। ফলে ভাল করে রাত্রে ঘুম হয় না, খিটখিটে হয়ে ওঠেন। বারীনবাবু জবাব দিলেন।
কিন্তু আপনিও তো বুড়ো হয়েছেন বারীনবাবু! আপনি তো কই খিটখিটে মেজাজের হননি? যতীনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ও থিওরিটা কিন্তু আমি মানতে পারলাম না বারীনবাবু।
কিন্তু এক-আধজনকে নিয়েই তো আর সকলকে বিচার করা চলে না যতীনবাবু! হাসতে হাসতে বারীনবাবু জবাব দিলেন।
ওঁদের সঙ্গে পথেই হোটেলের কিছু আগে ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর দেখা হয়ে গেল।
চক্রবর্তী তখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলের দিকে ফিরে আসছে।
অমিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে বারীনবাবু প্রশ্ন করলেন, ডাক্তার, অসুস্থ নাকি?
অমিয় কোনমতে জবাব দিলে, হ্যাঁ, জ্বর হয়েছে।
অমিয় দ্রুতপদে হোটেলে গিয়ে প্রবেশ করল।
পথে সমীরবাবুর সঙ্গেও ওঁদের দুজনের দেখা হল। সমীর তখন দ্রুতপদে হনহন করে হোটেলের দিকে ফিরছে।
ডাক্তার ডাকলেন, কিন্তু সমীর কোন জবাব দিল না ওদের ডাকে। সমীরের মাথার মধ্যে তখন উত্তেজনার আগুন জ্বলছে।
বারীনবাবু সমীরের অপস্রিয়মাণ দেহের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বললেন, পাগল! গুষ্টিসুদ্ধই পাগল!
***
বেলা প্রায় চারটে-পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীর একা একা হোটেলে ফিরে এল।
কাকার সঙ্গে দেখা করে সে দ্রুতপদে নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল এবং জামা কাপড় সমেতই নিজের শয্যার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে রইল।
মাথার মধ্যে তখন তার দপদপ করছে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রণধীরের স্ত্রী বিনতা ফিরে এল, এবং খুড়শ্বশুরের সঙ্গে কী খানিকটা কথাবার্তা বলে রণধীরের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।
***
সমীর কিন্তু হোটলের দোরগোড়া পর্যন্ত এসে আর হোটেলে প্রবেশ করল না। সাগরের কিনারে গিয়ে বসে রইল।
সে যখন হোটেলে ফিরে এল তখন প্রায় সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। সমীরের ফিরে আসবার কিছু আগেই বারীনবাবু ও যতীনবাবু হোটেলে ফিরে আসেন।
***
সন্ধ্যা প্রায় ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে এল এবং হোটেলে ফিরে সটান নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।
***
সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছটার সময় সকলে এসে খাবার ঘরে ঢুকলেন চা খাবার জন্য।
চা খেতে বসে হঠাৎ বিনতা বললে, কাকা তো চা খেতে এলেন না!
সকলেই একবার মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলো, কেননা চিরন্তন নিয়মের এ একটা ব্যতিক্রম।
রণধীর একজন হোটেল-ভৃত্যকে গগনেন্দ্রনাথকে চা পান করতে আসবার জন্য ডাকতে পাঠালে।
অল্পক্ষণ বাদেই চাকরটা দ্রতপদে ফিরে এল, তার সারা মুখে একটা ভীতত্রস্ত ভাব।
বিনতা জিজ্ঞাসা করলে, কিরে, বাবুকে ডেকেছিস?
মু কিছি বুঝি পারিলি নাহি। মু ডাকিলি, বাবু কড়কিছি কহিলে নাহি। আপন আসি দেখন্তু।
সে কি রে! সকলে উঠে দাঁড়াল এবং একসঙ্গে ঘর ত্যাগ করে সকলেই চলে গেল।
একটু পরেই একটা গোলমালের শব্দ শুনে প্রতিমা সেখানে গিয়ে হাজির হল।
সকলে স্তম্ভিত বিস্ময়ে গগনেন্দ্রনাথকে ঘিরে চারপাশে হতবুদ্ধির মত দাঁড়িয়ে আছে।
সকলের মুখেই একটা ভীত্যন্ত ভাব।
ব্যাপার কি, রণধীরবাবু? প্রতিমা ব্যগ্র-ব্যাকুল কণ্ঠে শুধাল।
কী জানি, বুঝতে পারছি না কিছু, দেখুন তো-ডাকছি সাড়া দিচ্ছেন না।
প্রতিমা শশব্যন্তে ভাল করে পরীক্ষা করতেই তার মুখখানা কালো হয়ে গেল, ধীর মৃদুস্বরে বললে, উনি আর বেঁচে নেই, মারা গেছেন।
সকলেই সমস্বরে বললে, সে কি!
কি করে যে এমনি ভাবে হঠাৎ গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু হল কেউ ভেবে পেল না।
প্রতিমা বললে, শুধু হর্টফেল করে মারা গেছেন। আগে থেকেই তো হার্টের অসুখে ভুগছিলেন।
কিন্তু আশ্চর্য, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুকে কেউ এক ফোটা চোখের জলও ফেললে না।
সকলেই যেন ভয়ানক নিশ্চিন্ত হয়েছে।
একটা যেন ভূতের বোঝা এতদিন তারা বয়ে বেড়াচ্ছিল, তার থেকে যেন সকলে মুক্তি পেয়েছে।
অমিয় যখন ব্যাপারটা শুনল, রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে দশটা হবে, সে-ও এল দেখতে। মৃতদেহ ভাল করে পরীক্ষা করেও তার মনটা যেন খুতখুত করতে লাগল।
***
দিন-দুই বাদে কিরীটী কোণারক থেকে ফিরে এল।
গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ শুনে সে-ও স্তম্ভিত হয়ে গেল।
কয়েকদিনের ঘটনাগুলি তার মনের মাঝে এসে নানা চিন্তার জট পাকাতে লাগল।
৩. মীমাংসার সুত্র
সেদিন সন্ধ্যায় সমুদ্রের কিনারায় বসে কিরীটী ও ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল-গগনেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু সম্পর্কে।