শরীরটা সকাল থেকেই যেন কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, আবার ম্যালেরিয়া জ্বর আসছে কিনা বুঝতে পারছি না। অমিয় বললে।
প্রতিমা হাসতে হাসতে বললে, ডাক্তার মানুষের অসুখ, এ তো ভাল নয়! কই দেখি। আপনার নাড়ীটা?
নাড়ী দেখে প্রতিমা বললে, না, জ্বর নেই, তবে pulseটা একটু rapid, চলুন সমুদ্রের ধারে একটু হাওয়ায় বেড়িয়ে আসবেন, হয়ত ভাল লাগতে পারে।
অমিয় জামাটা গায়ে দিতে দিতে উঠে দাঁড়াল, চলুন।
হোটেল থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে দুজনে সমুদ্রের কিনারে কিনারে বালুবেলার উপর দিয়ে হেঁটে চলল।
অনেকটা দূর গিয়ে অমিয় বললে, আসুন প্রতিমা দেবী, এখানে একটু বসা যাক।
***
রণধীর ও অধীর দুজনে হোটেল থেকে বের হয়ে গেল। পিছু পিছু বিনতাও বের হয়ে গেল।
একমাত্র কিশোর শুধু গেল না, নিজের ঘরে শুয়ে রইল।
***
ধীরে ধীরে দিনের আলো নিভে আসছে।
দিনের শেষের রক্তিমাভ শেষ সূর্যরশ্মি সমুদ্রের নীল জল লাল করে তুলেছে।
অমিয় প্রতিমার দিকে ফিরে বললে, জুর বোধ হয় এসে গেল প্রতিমা দেবী, বড্ড শীতশীত করছে। আমি ফিরে যাই।
প্রতিমা শশব্যন্তে উঠে দাঁড়ালেন, আমিও সঙ্গে যাচ্ছি চলুন।
না না, অমিয় প্রতিবাদ করে উঠল, আমি একাই যেতে পারব, আপনার মিথ্যে কষ্ট করতে হবে না।
কষ্ট! এতে আবার কষ্ট কি বলুন তো?
না না, আমি একাই ফিরে যাচ্ছি।
অমিয় চলে গেল। প্রতিমা সাগরের দিকে চেয়ে গুনগুন করে গাইতে লাগল।
আমার দিন ফুরাল, ব্যাকুল বাদল সাঁঝে,
বনের ছায়ায় জল ছল ছল সুরে
হৃদয় আমার কানায় কানায় পুরে
ক্ষণে ক্ষণে ঐ গুরু গুরু তালে
গগনে গগনে গভীর মৃদঙ্গ বাজে।
কোন দুরের মানুষ কেন এলো কাছে
মনের আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে,
বুকে দোলে তার বিরহ-ব্যথার মালা,
গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা
মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি
হার মানি তার অজানা মনের মাঝে।
প্রতিমা দেবী?
কে? প্রতিমা চমকে ফিরে তাকাল, ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে সমীর।
সমীরবাবু! আসুন, বসুন। বলে প্রতিমা আবার অন্যদিকে মুখ ফেরাল।
আমি আমার সেদিনকার ব্যবহারের জন্য সত্যই অনুতপ্ত প্রতিমা দেবী। আমাকে ক্ষমা করুন। কুণ্ঠিত স্বরে সমীর বললে।
ক্ষমা! কী বলছেন আপনি সমীরবাবু? আপনি তো কোন অন্যায়ই করেন নি। সত্যিই আপনার কাকা যখন আপনাদের অন্যের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না…
সত্যি প্রতিমা দেবী, মাঝে মাঝে যে আমার কী হয়, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যায় মাথার মধ্যে। সত্যি এ বাঁধন আমার অসহ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি নিরুপায়, মুক্তির
কোন পথই খুঁজে পাই না..কী আমি করব বলতে পারেন?
চলে আসুন সমীরবাবু, ঘরের বাঁধন ছিড়ে চলে আসুন। আমি তো ভেবে পাই না, কী করে দিনের পর দিন এই শাসন সহ্য করে আসছেন। আমি হলে এতদিন পাগল হয়ে যেতাম, না হয় আত্মহত্যা করতাম।
হয়ত শেষ পর্যন্ত আর কিছুদিন এভাবে থাকতে হলে আত্মহত্যাই আমাকে করতে হবে। আমি বড় ক্লান্ত।
পুরুষমানুষ আপনি, আত্মহত্যা করবেন কেন? ছিঃ ছিঃ, ওসব কথা কল্পনায়ও মনে স্থান দেবেন না। এ অত্যাচারকে আপনার জয় করতে হবে। মনে সাহস আনুন।
সত্যি এ বাঁধন আমি ছিড়ে ফেলব। এমনি করে কেউ কোনদিনই আমাকে বলেনি। কিন্তু …, সহসা সমীর গভীর আগ্রহে প্রতিমার একখানা হাত চেপে ধরে বললে, আমি পারব, তুমি যদি আমার সহায় হও প্রতিমা! তুমি যদি আমার পাশে এসে দাঁড়াও! বলবল প্রতিমা, তুমি আমার সহায় হবে! আজই আমি এর একটা মীমাংসা করব।
ধীরে ধীরে প্রতিমা তার ধৃত হাতখানা ছাড়িয়ে নিল, সমীর! বললে প্রতিমা, আমি তোমার সহায় হলেই কী তুমি জয়ী হতে পারবে?
পারব। সত্যি তোমার মুখের দিকে চাইলে যেন আমার মনে সাহস আসে, নিজেকে যেন খুঁজে পাই। তারপর হঠাৎ উঠে পড়ে সমীর বললে, এখুনি আমি চললাম প্রতিমা। মনে হঠাৎ যা উঠেছে, এখনি যদি এর সংশোধন না করি, আবার আমি সাহস হারিয়ে ফেলব। আমি যাই। সমীর দ্রুতপদে স্থানত্যাগ করে চলে গেল।
সমীরের ক্রম অপস্রিয়মাণ গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহসা গভীর স্নেহে প্রতিমার চোখের কোল দুটি জলে ভরে উঠল।
***
যতীনবাবু নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে কি একটা মাসিকের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। সহসা ওপাশের বারান্দা থেকে কি একটা গোলমালের আওয়াজ কানে এল। উনি মুখ তুলে দেখলেন, একটা খানসামা দ্রুতপদে বারান্দা অতিক্রম করে কিশোরের ঘরের দিকে চলে গেল। যতীনবাবু বুঝলেন, কোন কারণে আবার গগনেন্দ্রনাথ খানসামার উপরে চটে গেছেন। তিনিই বোধ হয় তাকে গালাগাল দিচ্ছিলেন। চেয়ে দেখলেন, গগনেন্দ্রনাথ একটা শাল গায়ে দিয়ে নিত্যকারের মত ইজিচেয়ারটার উপর হেলান দিয়ে বসে আছেন। আচ্ছা মাথা খারাপ যাহোক! যতীনবাবু আবার পড়ায় মনোনিবেশ করলেন; কেননা এ ধরনের ব্যাপার রোজই প্রায় দুচারবার হয়।
***
বারীনবাবু বেড়াতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যতীনবাবুর ঘরের সামনে দাঁড়ালেন, যতীনবাবু!
কে, বারীনবাবু? আসুন।
চলুন না সাগরের ধার থেকে একটু বেড়িয়ে আসা যাক।
এখুনি যাবেন? আর একটু বেলা পড়লে গেলে ভাল হত না?
হাতঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে বারীনবাবু বললেন, বেলা আর আছে কই, সোয়া চারটে বাজে। শীতকালের বেলা, তারপর আবার মেঘে মেঘে সন্ধ্যা হতে বেশী দেরিও হবে না।