সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া বইছে বাঁধনহারা।
সাগরের বুকে ঢেউয়ের সে কি মাতামাতি!
বড় বড় উঁচু কালো ঢেউগুলি যেন সাদা দাঁতের পংক্তি বের করে সমগ্র বিশ্বদুনিয়াকে গিলবার জন্য ক্ষুধিত লালসায় শত বাহু বাড়িয়ে বহুঙ্কারে ছুটে এসে বালবেলার উপরে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। দ্বিপ্রহরের দিকে হোটেলের উপরতলায় সকলেই প্রায় সেদিনকার সমুদ্রের সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে সাগরকিনারে চলে গেলেন।
গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ঘরের সামনে আরামকেদারায় চুপটি করে বসে আছেন।
কিশোর তার ঘরে শুয়ে, বাকি সবাই গগনেন্দ্রনাথের চারপাশে বসে। হঠাৎ একসময়ে গগনেন্দ্রনাথ ভাইপোদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, তোমরাও আজ সব সমুদ্র দেখে এস। দুদিন তোমরা ঘরের মধ্যে আটকা আছ। যাও, সবাই ইচ্ছামত বেড়িয়ে এস। কিন্তু দেখো, সন্ধ্যা পর্যন্ত যেন বাইরে থেকো না।
কাকার কথা শুনে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এ শুধু আশ্চর্যই নয়, অভাবনীয়ও বটে।
এমনি করে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আজ পর্যন্ত জ্ঞানত এর আগে কোনদিন তাদের মিলেছে কিনা তারা মনে করতে পারে না।
বদ্ধ ঘরের বদ্ধ হওয়ায় তীব্র অনুশাসনের গণ্ডির মধ্যেই তারা আবদ্ধ।
সকলেই একে একে উঠে দাঁড়াল। কেননা অসম্ভব অভাবনীয় হলেও কাকার আদেশ বা অনুমতিকে অবহেলা করার মত তাদের কারো দুঃসাহস নেই।
সমীরই সবার আগে গায়ে পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। কয়েকদিন হল সমর রায় নামে একজন কবি ও আটিস্ট এসে বারীনবাবুর পাশের ঘরখানি অধিকার করেছে।
সমরবাবুর বয়েস ছাব্বিশ-সাতাশের বেশী হবে না। রোগা লিকলিকে দেহের গঠন। মাথাভর্তি এলোমেলো ঝাকড়া ঝাকড়া বাবরী চুল কাধের উপরে লুটিয়ে আছে। গায়ের রং কালো। চোখমুখ বেশ তীক্ষ্ণ তবে একটা মেয়েলী ঢং আছে। চোখে পানে, একটা সরু সিল্কের কারের সঙ্গে গলদেশে দোদুল্যমান।
সমরবাবু অতি-আধুনিক কবি। রবীন্দ্র-শেষ যুগে যেসব কবি আপনাতে আপনি দ্যুতিমান, নক্ষত্রনিচয় রবি-প্রতিভাকে স্নান করে দেবার দুর্বার বাসনায় উচ্চকণ্ঠে সগৌরবে আপনাদের বিজয়-দুন্দুভি পিটছেন, সমর রায় তাঁদেরই একজন।
রবীন্দ্রনাথ নাকি কোন একজন অতি আধুনিক কবির কবিতা পড়ে বলেছিলেন, অমুকের কবিতা যদি কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন, তবে সত্যিই তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো।
জানি না কেউ বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন কিনা তাঁকে।
সমীর চিরদিনই কবিতার ভক্ত। সমরবাবু একজন কবি শুনে তার মনটা সহজেই সমরবাবুর দিকে একটু ঝুঁকেছিল।
দূর থেকে সমরবাবুর উদাস বধূ কৈ বধূ কৈ ভাব সমীরের মনে একটা বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিল সন্দেহ নেই।
সে সমরবাবুর সঙ্গে আলাপ করবার জন্য সুযোগ খুঁজছিল।
সমীর যখন কাকার আদেশে হোটেল থেকে সাগরের দিকে বেড়াতে যাবার জন্য বেরুচ্ছে, হঠাৎ দরজায় সমরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
সমরবাবুও তার খাতা ও ঝরনা কলম নিয়ে তখন সমুদ্রের দিকে চলেছেন।
দুজনের দরজার গোড়ায় দেখা হতেই সমীর হাত তুলে সমরবাবুকে নমস্কার জানাল। সাগরের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সহজেই দুজনের আলাপ-পরিচয় জমে উঠল।
সমীর বলছিল, আপনি যে একজন কবি তা আমি শুনেছি সমরবাবু, কোন্ কোন্ কাগজে আপনি কবিতা লেখেন?
সমরবাবু জবাব দিলেন, সব কাগজেই প্রায় লিখি।
তবু?
যেমন ধরুন, পথহারা পাখী, কবরখানা, কসাইঘর, কারা-প্রাচীর-সব পত্রিকাতেই আমি লিখি।
ভারতবর্ষ প্রবাসীর সঙ্গে সমীরের পরিচয় আছে বটে কিন্তু সমরবাবু বর্ণিত কাগজগুলোর নাম দু-একবার শুনলেও চোখে দেখার সৌভাগ্য তার কোনদিনও হয়নি, অতএব সে চুপ করেই পথ চলতে লাগল।
সহসা একসময় আবার সে প্রশ্ন করলে, এখানে এসে অবধি নতুন কোন কবিতা আপনি লেখেননি সমরবাবু?
হ্যাঁ, একটা লিখছি, শুনবেন? এখনও কিন্তু শেষ হয়নি।
হ্যাঁ, বলুন না?
তবে শুনুন, সমর চলতে চলতেই কবিতা আওড়াতে শুরু করলেন। কবিতার নাম :
পুরীর সমুদ্র
হে সমুদ্র? তুমি কি একটা পাখী,
পশু না হংসডিম্ব?
কিংবা রেলের লাইন, কাঁটা তারের বেড়া
জেলের কয়েদীদের চোখের জল।
তুমি কার বেদনা দীর্ঘশ্বাস;
কার ছেঁড়া চটিজুততা!
কিংবা কোন কেরানীর হেঁড়া পাতলুন!
পথিকের ক্ষয়ে যাওয়া শুক্তলা,
যুদ্ধের ধূসর তাঁবু
তোমার গর্জনে শুনি সৈনিকের মার্চ,
যেন পায়ে অ্যামুনিশন বুট।
কিংবা রাইফেল মেসিনগান
বোমারু হাওয়াই জাহাজ!
আমি হতবাক!
সমরবাবু হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, এই পর্যন্তই লিখেছি, বাকি এখনও লেখা হয়নি, ভাব তো সব সময় মাথায় আসে না। ভাব বা প্রেরণা মনের একটা অস্বাভাবিক ক্ষণমুহূর্ত। কিন্তু কেমন লাগল কবিতাটা আপনার সমীরবাবু?
সমীর বোকার মতই যেন হঠাৎ বলে ফেললে, বেশ। কিন্তু বুঝলাম না তো!
সমরবাবু সোল্লাসে বলে উঠলেন, বোঝেননি তো? ঐখানেই আমাদের অতি আধুনিক কৃতিত্ব। আমাদের কবিতা ভাবীকালের জন্য। এই যে প্রতীক্ষিত বেদনা, এর একটা বিপুল রূপ—এ তো সকলের চোখে ধরা পড়বার নয়!
***
ঘরের মধ্যে খাটের উপরে শুয়ে ডাঃ চক্রবর্তী সমগ্র দেহখানি একটা কম্বলে ঢেকে কি একখানা বই পড়ছিল।
ভিতরে আসতে পারি কি? বাইরে থেকে প্রতিমার গলা শোনা গেল।
ডাঃ চক্রবর্তী শশব্যন্তে উঠে বসল শয্যার উপর, আসুন প্রতিমা দেবী।
প্রতিমা হাসতে হাসতে এসে ঘরে প্রবেশ করল। তারপরই ডাঃ চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বললে, এ কি, অসময়ে বিছানায় শুয়ে যে?