ছেলেমানুষী করো না কিশোর, শুতে যাও।
এখন একটু এখানেই থাকি, তোমরা খেয়ে এস, তারপর আমি যাবখন।
তীব্রস্বরে গগনেন্দ্রনাথ এবারে ডাকলেন, কিশোর?
সভয়ে ত্রস্ত কিশোর উঠে দাঁড়াল।
বিনতা কিশোরের সামনে এগিয়ে এল, চল কিশোের, আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, তাহলে তো ভয় করবে না!
গগনেন্দ্রনাথ গম্ভীর শান্ত স্বরে বলে উঠলেন, না। কেউ ওর সঙ্গে যাবে না। ও একাই যাবে। যাও কিশোর, শুতে যাও। ধীরপদে মাথা নীচু করে একপ্রকার টলতে টলতেই কিশোর ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
নিজের ঘরে এসে কিশোর অন্ধকারেই শয্যার উপরে কোনমতে লুটিয়ে পড়ল।
সত্যিই তার তখন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
বসবার ঘরে বারীনবাবু এক কোণায় বসেছিলেন, হঠাৎ তিনি গগনেন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে, কিশোর চলে গেলে বললেন, সত্যি হয়ত ও ভয় পায় একা একা শুতে, গগনবাবু। হাজার হোক ছেলেমানুষ তো।
গগনেন্দ্রনাথ তীব্রভাবে ফিরে দাঁড়ালেন, নিজের কাজ নিজে করুন মশাই, অন্যের কাজে মাথা ঘামাবার তো কোন দরকার নেই আপনার!
বারীনবাবুও তীব্রস্বরে জবাব দিলেন, সত্যি, আপনার মত অভদ্র আমি দেখিনি।
তীব্র ব্যঙ্গের স্বরে গগনেন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, তাই নাকি!
তারপরই কিছুক্ষণ বারীনবাবুর চোখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঘর হতে বের হয়ে যাবার জন্য ফিরে দাঁড়ালেন এবং চলতে চলতে কতকটা আত্মগতভাবে বলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না। মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি। সবই আমার মনে আছে। কোন মুখ আমি ভুলিনি।
***
প্রতিমা এতক্ষণ স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল ও শুনছিল।
ওঁরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই সে চুপিসাড়ে পায়ে পায়ে গিয়ে কিশোরের ঘরে প্রবেশ করল।
পায়ের শব্দে কিশোর চমকে প্রশ্ন করলে, কে? কে?
চুপ, চেঁচিও না। আমি প্রতিমা। প্রতিমা কিশোরের শয্যার পাশটিতে এসে দাঁড়াল।
কিশোর মৃদুস্বরে বললে, ডাঃ গাঙ্গুলী?
কিশোরের শয্যার পাশটিতে বসে, কিশোরের রোগতপ্ত কপালে হাত বুলোতে বুলোতে গভীর স্নেহের সঙ্গে প্রতিমা বললে, আমাকে তুমি প্রতিমাদি বলেই ডেকো কিশোর। আমার কোন ছোট ভাই নেই, তুমিই আমার ছোট ভাইটি। কেমন, তুমি আমার ভাই হতে তো?
হব।
তুমি বলছিলে একা একা নাকি তোমার এ ঘরে শুতে ভয় করে, কেন তোমার ভয় করে ভাই? প্রতিমা প্রশ্ন করলে।
কি জানি প্রতিমাদি, সত্যি আমার বড় ভয় করে। মনে হয় এই ঘরের আশপাশে অন্ধকারে কারা যেন সব লুকিয়ে আছে। যত রাত্রি বাড়তে থাকে তারা সব আমার বিছানার চারপাশে এসে ভিড় করে দাঁড়ায়। অন্ধকার থেকে চাপা গলায় ফিসফিস করে কারা যেন আমাকে ডাকে। আমি শুনতে পাই, দিনের বেলাতেও তারা আমাকে ডাকে। তারা গান গায়, তারা হাসে, তারা কাদে।
পাগল ছেলে! ও তোমার মনের ভুল। ওসব কিছু না।
বললে তুমি বিশ্বাস করবে না প্রতিমাদি, তাদের আমি খুব ভাল করে দেখতে পাই না বটে, কিন্তু তারা আমার চারপাশে সর্বদা ঘোরে, আমাকে চাপা গলায় কেবলই ডাকে, তা টের পাই।
এবারে আর দেখো ডাকবে না। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা ওষুধ এনে দিচ্ছি। প্রতিমা নিজের ঘরে গিয়ে একটা ভেরনল ট্যাবলেট নিয়ে এসে কিশোরকে খাইয়ে দিল। শীঘ্রই কিশোরের চোখের পাতায় ঘুম নেমে এল।
ঘুম আসছে প্রতিমাদি, ঘুমোই। কতদিন আমি ভাল করে ঘুমোই না।
সস্নেহে প্রতিমা জবাব দিল, হ্যাঁ, ঘুমোও।
অনেকদিন পরে সেরাত্রে কিশোর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল।
***
পরের দিন খুব প্রত্যুষে কিরীটী কোণারক দেখতে চলে গেল, এখানকার আবহাওয়ায় মনটা তার সত্যিই বড় বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রতিমা নিজের ঘরে বসে কি একখানা মনোবিজ্ঞানের বই পড়ছিল, ডাঃ চক্রবর্তী এসে ঘরে ঢুকল, চলুন প্রতিমা দেবী, সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে আসি।
প্রতিমা বই রেখে উঠে দাঁড়াল, চলুন।
বেরুবার পথে হঠাৎ প্রতিমার সমীরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল, সমীর যেন প্রতিমাকে দেখে কি বলবার জন্য একটু এগিয়ে এল, কিন্তু প্রতিমা সেদিকে লক্ষ্য না করে হনহন করে এগিয়ে গেল। আজ দুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথের শরীরটা অসুস্থ। বসবার ঘরে কাল থেকে আর আসেন না। সর্বদাই তাঁর ঘরের সামনে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে গায়ে কমলালেবু রঙের একটা শাল জড়িয়ে বসে থাকেন। মেজাজটা আরও খিটখিটে হয়ে উঠেছে। হোটেলের চাকর-খানসামাদের পর্যন্ত নানা কাজের খুঁত ধরে চেঁচামেচি করেন। খাবার ঘরে যান বটে, কিন্তু এক গ্লাস দুধ ও কিছু ফল খেয়ে উঠে আসেন।
কিশোরের সকালের দিকে জ্বর থাকে না বটে, কিন্তু সন্ধ্যার পরেই একটু ঘুষঘুষে জ্বর। আসে। চোখ মুখ গা হাত পা জ্বালা করে। অমিয় ও প্রতিমা কিশোরকে ভাল করে পরীক্ষা করে গোপনে গোপনে কি ঔষধপত্র দিচ্ছে। গগনেন্দ্রনাথ জানতে পারলে আর রক্ষা থাকবে না তা ওরা ভাল করেই জানে। ঠিক বলবেন, অনধিকার চর্চা!
***
আজ দুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথও যেমন বিকেলে কোথাও বেড়াতে বের হন না, ভাইপোদেরও যেতে দেন না বাইরে। সর্বদাই তারা ছায়ার মত গগনেন্দ্রনাথের চারপাশে ভিড় করে থাকে। প্রত্যেকের মুখের উপরে যেন একটা বিষাদের কালো মেঘ থমথম করে।
***
সেদিন সকাল থেকেই আকাশের বুকে একটা পাতলা কালো মেঘের যবনিকা দুলছে।
সাগর হয়েছে যেন একটু বিশেষ চঞ্চল।