গগনেন্দ্রনাথ একবার আড়চোখে সমীরের দিকে তাকিয়ে ধীর গভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে সমীর?
সমীর নীরবে মাথা নীচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইল।
কী, জবাব দিচ্ছ না কেন? একসঙ্গে সব বেড়িয়ে ফিরছিলাম, কোথায় তুমি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলে?
সমুদ্রের ধারে বেড়াচ্ছিলাম কাকা। মৃদুস্বরে সমীর জবাব দিল।
বেড়াচ্ছিলে? অত্যন্ত অসংযমী ও উজ্জ্বল হয়ে উঠছ তুমি দিন দিন সমীর। কিছুদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করছি, গতিটা তোমার ক্রমে অবাধ হয়ে উঠছে। ধ্বংসের মুখে তুমি ছুটে যাচ্ছ সমীর।
আমি–, সমীর যেন কী বলতে যাচ্ছিল প্রত্যুত্তরে।
গগনেন্দ্রনাথ প্রবল বিরক্তির সুরে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, যাক, তর্ক করো না। দোষী হয়ে দোষ ঢাকবার মত পাপ বা অন্যায় আর নেই। কার হুকুমে তুমি এতক্ষণ বাইরে ছিলে?
এমন সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী এসে ঘরে প্রবেশ করল, ঘরে ঢুকবার পথেই গগনেন্দ্রনাথের শেষের কথাগুলি তার কানে গিয়েছিল, সে সমীরের দিকে স্তব্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে চেয়ে রইল।
গগনেন্দ্রনাথ তীক্ষ্ণকণ্ঠে আবার প্রশ্ন করলেন, কী, চুপ করে আছ কেন, জবাব দাও? এত স্বাধীনতা তোমার কোথা থেকে এল? এত দুঃসাহস তোমার কেমন করে হয়?
প্রতিমা আর সহ্য করতে পারল না। তার মনের মধ্যে যেন আগুন জ্বলছিল, সে এবারে এগিয়ে এল, গগনবাবু, উনি আমার সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন, আমিই ওকে আটকে রেখেছিলাম; দোষ এতে যদি কিছু হয়ে থাকে তবে আমার, ওঁর নয়।
গগনেন্দ্রনাথ তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিলেন, আপনি কে আমি জানি না। কিন্তু আপনি যেই হোন, আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে একজন তৃতীয় পক্ষের মাথা ঘামানোটা আমি আদপেই পছন্দ করি না। দয়া করে আর আপনি আমার ভাইপোদের সঙ্গে মিশে কুপরামর্শ দিয়ে উচ্ছন্ন দেবেন না।
এসব আপনি কী যা খুশি তাই বলছেন গগনবাবু! তীব্র প্রতিবাদের সুরে প্রতিমা জবাব দিল।
অসহ্য ক্রোধে ও অপরিসীম লজ্জায় তার সমগ্র মুখখানা তখন রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
প্রতিমার কথার কোন জবাব না দিয়ে গম্ভীর স্বরে সমীরের দিকে তাকিয়ে গগনেন্দ্রনাথ বললেন, শোন সমীর, এভাবে উচ্ছন্নে যেতে তোমায় আমি দেব না। এ ধরনের অন্যায় যদি আবার কোনদিন তোমার দেখি তবে এমন ব্যবস্থা আমি করব যে, সারা জীবনের চোখের জলেও তোমার মুক্তি মিলবে না। এ অসহ্য! একেবারে অসহ্য এই অমার্জনীয় ঔদ্ধত্য। তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে লক্ষ্য করে আদেশের সুরে বললেন, চল সব ঘরে!
একটা তীব্র কুটিল দৃষ্টি প্রতিমার দিকে হেনে গগনেন্দ্রনাথ ধীরপদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন, তার পিছু পিছু অন্য সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত মাথা নীচু করে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল।
প্রতিমাও একপ্রকার ছুটে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ঘরের অন্য সব প্রাণী স্তম্ভিত বিস্ময়ে স্থাণুর মতই যে যার জায়গায় নীরবে বসে রইল।
***
সেই রাত্রে।
রাত্রি বোধ করি দেড়টা হবে। কিরীটীর চোখে ঘুম নেই।
অমিয় তার শয্যার উপরে শুয়ে অঘোরে নাক ডাকাচ্ছে।
কিরীটী একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের পিছনদিকের জানালার সামনে এসে দাঁড়াল।
বাইরে অন্ধকার প্রকৃতি কালো আকাশের ছায়ায় যেন চোখ বুজে পড়ে আছে।
সমুদ্রের একটানা গুম গুম গর্জন রাত্রির স্তব্ধ অন্ধকারের দু-কূল ছাপিয়ে যেন কানের কাছে এসে আছড়ে পড়ছে।
সহসা তার কানে এল কারা যেন পাশের ঘরেই চাপা উত্তেজিত স্বরে কী আলোচনা করছে।
না না, এ অসম্ভব। এই পরাধীনতার নাগপাশ, দিনের পর দিন এই অকথ্য অত্যাচার সত্যি আর সহ্য হয় না। প্রাণ আমার হাঁপিয়ে উঠেছে। এভাবে আর বেশীদিন থাকলে বুঝি পাগল হয়ে যাব আমি! অধীর–
মেজদা, এমনি করে অধীর হয়ো না ভাই। আর কটা দিনই বা বুড়ো—কতকাল আর বাঁচবে!
না না, বুড়োর মৃত্যুর আশায় দিন গুনে গুনে আর পারি না। ইচ্ছে করে দুহতে সব ভেঙে মুচড়ে যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাই।
কিন্তু যাবি কোথায়? পেট চলবে কী করে?
পেটের ভাবনা ভাবছিস তুই অধীর! ভিক্ষে করে খাব, তবু এ আর সহ্য হয় না। ভেবে দেখ তুই, ওকে খুন করা ছাড়া আর আমাদের মুক্তির উপায় নেই। ওকে খুন করা উচিত—ও মরুক। ও মরুক। এখন ওর পক্ষে মরণই মঙ্গল।
ছি ছি, এসব কী তুমি বলছো মেজদা?
অনেক দুঃখে, অনেক কষ্টেই বলছি। শীঘ্র যদি ও না মরে, আমিই নিজে হাতে ওকে এই পৃথিবী থেকে সরাব। হ্যাঁ, আমিই সরাব। এবং তার উপায়ও ভেবে রেখেছি। কেউ জানবে, কেউ সন্দেহমাত্র করতে পারবে না। অথচ নিঃশব্দে কাজ হাসিল হবে। শোন্ কী উপায় আমি ভেবেছি……
তারপর আর শোনা গেল না।
কিরীটী গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
পাশের ঘরেই অধীর থাকে।
কিন্তু…
***
দিন-দুই প্রতিমা কতকটা যেন ইচ্ছা করেই ওদের ধার দিয়ে গেল না। এড়িয়ে এড়িয়ে বেড়াল।
কিন্তু আচমকা আবার সেদিন আবছা ভোরের আলোয় সমুদ্র-কিনারে সমীরের সঙ্গে প্রতিমার দেখা হয়ে গেল।
সমুদ্রের বালুবেলায় একাকী সমীর দাঁড়িয়ে আছে।
পরিধানে ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি।
মাথার চুল এলোমেলো রুক্ষ, সাগর-হাওয়ায় আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
যেন এক বিষাদের প্রতিমূর্তি।
করুণায় প্রতিমার হৃদয় দ্রব হয়ে এল। আহা, কী অসহায়। প্রতিমা আর নিজেকে রোধ করে রাখতে পারলে না, এগিয়ে এল, নমস্কার সমীরবাবু।