ইঙ্গ-আমেরিকা আজ চিৎকার করছে বটে, জার্মানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যই তাদের জগতে এক শান্তিময় জীবনধারা নিয়ে আসা। জার্মানীই যেন এইসব যত দুঃখ ও অমঙ্গলের মূল। কিন্তু মনে মনে ব্রিটিশ, জার্মানী, জাপান সবাই একই দলের পথিক। শুধু বিভিন্ন কর্মধারা মাত্র। ভাল করে ভেবে দেখুন দিকি, প্রকৃতপক্ষে পশুর চাইতে বেশী কি? খুব delicately balanced- একমাত্র উদ্দেশ্য বেঁচে থাকা। খুব দ্রুত এগিয়ে চলাও যেমন জাতি ও দেশের পক্ষে ক্ষতিকর, পেছিয়ে থাকাও তাই। কেবল বেঁচে থাকতে হবে, দ্রুতও নয়, অতি শ্লথও নয়, মাঝামাঝি। দেশ বা জাতি সেও তো সমষ্টিগত মানবই।কথায় কথায় অনেক দূরে চলে এসেছি।
ডাঃ চক্রবর্তী একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, আমার মনে হয়, গগনেন্দ্রনাথ বহুকাল ধরে বহু লোকের উপরে প্রভুত্ব করে করে, মানুষের উপরে অত্যাচার নিষ্ঠুরতা করে, বেদনা দিয়ে দিয়ে, আজ ওঁর মনের সহজ প্রবৃত্তিই গড়ে উঠেছে ঐ বেদনা দেওয়া ও অত্যাচার করার মধ্যে। সেই প্রাগৈতিহাসিক পাশবিক বর্বর আনন্দ, শুধু আগের মতো শারীরিক বেদনা দেওয়ার পরিবর্তে দিচ্ছে মানসিক বেদনা। এ ধরনের মনোবিকার খুব বড় একটা বেশী দেখা যায় না। আর এদের সঙ্গে যুদ্ধ করাও বড় কঠিন। সে চায় অন্যের উপরে তার প্রভুত্ব থাকবে। এবং সেই প্রভুত্বের দোহাই দিয়ে অন্যের উপরে করবে সে অত্যাচার। এতেই তার আনন্দ।
প্রতিমা বলেছিল, এটা কি পাশবিক নয়, এইভাবে অত্যাচারের মধ্য দিয়ে আনন্দ ভোগ করা?
নিশ্চয়ই। ডাঃ চক্রবর্তী বলেছিলেন, কিন্তু সবচাইতে মজা হচ্ছে, অত্যাচারী এখানে বুঝতেই পারছে না কী সে করছে, এখানে সে তার অবচেতন মনের দ্বারা চালিত হচ্ছে।
প্রতিমা এরপর জিজ্ঞাসা করেছিল, কিন্তু কাকার এই অত্যাচার থেকে ভাইপোরা নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে না কেন আঃ চক্রবর্তী?
ডাঃ চক্রবর্তী জবাব দিয়েছিলেন, ওইখানেই তো আপনার ভুল ডাঃ গাঙ্গুলী। তারা তা পারে না। একটা মুরগীকে একটা ঘরের মধ্যে সাদা চক দিয়ে মেঝের উপরে একটা লাইন টেনে, মুরগীর ঠোঁটটা সেই সাদা লাইনের উপরে রেখে দিলে যেমন তার মনে হবে সেই লাইনের সঙ্গেই সে বাঁধা পড়েছে, আর সে নড়তে পারবে না, গগনেন্দ্রনাথের ভাইপোদেরও মনের অবস্থা ঠিক তাই, তাদের সম্মোহিত করেছে যে সে ছাড়া আর তাদের উপায় নেই, মুক্তি নেই।
আচ্ছা এই যে একটা পরিস্থিতি, এ তো অতগুলো লোকের পক্ষে ভয়ঙ্কর অমঙ্গলজনক। প্রতিমা বললে।
নিশ্চয়ই, সেকথা একবার বলতে, হাজারবার!
প্রতিমা রুদ্ধস্বরে বলেছিল, তবে তো এই শয়তান বুড়োকে খুন করাই উচিত। ওই শয়তানকে খুন করতে পারলে এখনও হয়ত ওদের বাঁচবার আশা আছে। এখনও হয়ত ওদের মনের সব কিছু মরে শুকিয়ে যায়নি। এখনও হয়ত ওদের মনের মাঝে আলো আসে, ফুল ফোটে।
কী বলছেন আপনি প্রতিমা দেবী? বিস্মিত কণ্ঠে ডাঃ চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন। ঠিকই বলছি, দশজনের মঙ্গলের কাছে একজনের মৃত্যু সে তো বড় বেশী কথা নয়, এর মধ্যে অন্যায় কী-ইবা আছে? একবার ঐ বেচারীদের কথা ভেবে দেখুন তো ডাঃ চক্রবর্তী। দিনের পর দিন দীর্ঘকাল ধরে কী যাতনাটাই না তারা সহ্য করছে!
প্রতিমা নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে গিয়েছিল, সমীরের কথা তার যেন এতক্ষণ মনেই ছিল না। সহসা সমীরের ভয়চকিত কণ্ঠস্বরে ও চমকে উঠল, আমি যাই, অনেক রাত হল।
কাকা হয়ত খুজবেন।
বসুনা না আর একটু! প্রতিমা বললে।
না না, আমি যাই। একটা ভয়ঙ্কর অস্বস্তিতে যেন সমীরের কণ্ঠস্বর ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে, সহসা সে মাতালের মত অস্থির পদে টলতে টলতে চলে গেল।
সেই অন্ধকারে বালুবেলার মধ্যে বসে সমীরের ক্রমঅপস্রিয়মাণ গতিপথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সহসা কেন জানি না প্রতিমার চোখের কোল দুটি জলে ভরে এল।
সাগরে বুঝি জল উঠেছে, সহসা একটা ঢেউ এসে প্রতিমার পায়ের অনেকখানি ও লুণ্ঠিত শাড়ির আঁচলটা ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল।
অল্প দূরেই কিরীটীর হাওয়াইন গিটারের মধুর সুর সমুদ্রে সাগরবেলায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিমা আকাশের দিকে অশ্রুসজল দৃষ্টি তুলে তাকাল। কালো আকাশের বুকে হীরার কুচির মত নক্ষত্রগুলি জ্বলছে আর জ্বলছে।
নীচে সাগর তেমনিই ঢেউয়ে ঢেউয়ে মাতামাতি করে চলেছে। উদ্দামতারও বিরাম নেই, গর্জনেরও বিরাম নেই।
***
স্বর্গদ্বার হোটেলের নীচের তলায় বসবার ঘরে তখন অনেকেই জমায়েত হয়েছে। রাত্রি পৌনে আটটা।
ঘরের এক কোণে গগনেন্দ্রনাথ একটা আরাম-কুরসীর উপরে গায়ে একটি দামী শাল জড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন। পাশেই আর একটা চেয়ারে বসে বিনতা উল বুনছে, তার অল্পদূরে বসে বই পড়ছে রণধীর, তার পাশে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে কিশোর চোখ বুজে পড়ে আছে। অধীর গগনেন্দ্রনাথ বাঁপাশে বসে একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন আনমনে। ঘরের অন্যদিকে যতীনবাবু ও বারীনবাবু মুখোমুখি বসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন। অল্পদুরে একখানা সোফার উপরে বসে ডাঃ চক্রবর্তী কী একটা মোটা ডাক্তারী বই পড়ছেন।
সমীর এখনও এল না? গগনেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন যেন কতকটা আপন মনেই। দিনদিনই সে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছে। কপালে ওর অনেক দুখ আছে।
এমন সময় ক্লান্তপদে সমীর এসে ঘরে প্রবেশ করল।