সমুদ্রের নীল জল কালো হয়ে উঠছে।
আজ যেন সমুদ্র বড় বেশী উতলা।
আবছা আলোয় কালো কালো ঢেউগুলি শুভ্র ফেনার মালা গলায় দুলিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ছুটে আসছে।
প্রতিমা গান গাইছিলঃ
ওগো কোন্ সুদূরের পার হতে আসে,
কোন্ হাসি কান্নার ধন।
ভেবে মরে মোর মন,
ভেসে যেতে চায়
এই কিনারার সব চাওয়া সব পাওয়া।
বাঃ, চমৎকার গান তো আপনি! কী মিষ্টি আপনার গানটি।
চমকে প্রতিমা ফিরে তাকাল।
সন্ধ্যার ঘনায়মান আঁধারে তার ঠিক পশ্চাতে বালুবেলার উপরে যেন দীর্ঘ এক অস্পষ্ট ছায়ার মতই দাঁড়িয়ে আছে সমীর। যেন খাপ-খোলা একখানা বাঁকা তলোয়ার।
কে, সমীরবাবু?
সমীর প্রতিমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল, বললে, হাঁ। কিন্তু আমার নাম আপনি জানলেন কি করে? আপনার নাম তো আমি জানি না!
প্রতিমা মৃদু হাসলে, তারপর স্মিতভাবে, বললে, আপনি আমার নাম জানেন না সমীরবাবু, কিন্তু আমি আপনার নাম জানি। আমার নাম প্রতিমা গাঙ্গুলী, পেশা ডাক্তারী। বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন যে?
বসব? কণ্ঠে যেন একরাশ মিনতির বেদনা ঝরে পড়ল।
কী অসহায়, করুণ!
হ্যাঁ, বসুন না। আপনাকে এই হোটেলে প্রথম দিন থেকে দেখা অবধিই আপনার সঙ্গে আমার আলাপ করবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আপনারা কারো সঙ্গে কথাও বলেন না, মেশেনও না। খাবার ঘরে যান, চুপচাপ খেয়ে চলে আসেন।
সমীর ততক্ষণে প্রতিমার অল্প একটু দূরে সাগরবেলার উপরে বসে পড়েছে। প্রতিমা বলছিল, কেন আপনারা কারো সঙ্গে মেশেন না, কথা বলেন না সমীরবাবু?
সমীর চুপ করে বসে রইল।
সমীরবাবু, এই চমৎকার জায়গায় এসেও আপনারা ঘরের মধ্যেই বসে থাকেন। কেমন করে থাকেন? ভাল লাগে? বাইরে আসতে কি ইচ্ছে হয় না? আমি তো এখানে আসা অবধি এক মুহূর্তও ঘরে থাকতে পারি না। সমস্ত মন যেন কেবলই বাইরে ছুটে আসে।
হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে করে প্রতিমা দেবী, কিন্তু কই পারি না তো! কেন পারি না? কেন বাইরে আসতে পারি না আমি বুঝতে পারি না, একটা প্রবল নিষেধ যেন ঘরের মধ্যে আমায় পিছু টেনে রাখে, আমার সমস্ত গতিকে নষ্ট করে দেয়।
চলে আসবেন বাইরে, যখন মন চাইবে।
মন তো বাইরে ছুটে আসতে সব সময়ই চায় প্রতিমা দেবী। বলতে পারেন, কেমন করে ঘর ছেড়ে বাইরে আসতে হয়? সমীর বলল।
কী সরল প্রশ্ন!
প্রতিমা ডাঃ চক্রবর্তীর মুখে এদের সব কথাই শুনেছিল।
শুনে সে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এও কি সম্ভব নাকি?
সে বলেছিল ডাঃ চক্রবর্তীকে, কেন এরা সব ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয় না? কেন এরা বিদ্রোহী হয়ে বাইরে ছুটে আসে না?
ডাঃ চক্রবর্তী জবাব দিয়েছিলেন, একদিন হয়তবা এরা বিদ্রোহী হতে পারত, কিন্তু আজ আর তারা পারবে না। মনের সে শক্তি আজ ওরা নিঃশেষে হারিয়েছে। আজ শুধু নিরুপায় বেদনায় ছটফট করবে, কিন্তু প্রতিকার তার করতে পারবে না। একদিন নয়, দুদিন নয়, দীর্ঘদিনের এই সম্মোহন—আজ আর এর থেকে তো ওদের নিস্তার নেই ডাঃ গাঙ্গুলী!
কেন নেই ডাঃ চক্রবর্তী? প্রতিমা প্রশ্ন করেছিল।
আমার ওদের সঙ্গে বেশ কিছুদিনের পরিচয়, অমিয় বলতে লাগল, কৌতূহলবশেই একটু একটু করে গগনেন্দ্রনাথের পূর্ব ইতিহাস আমি সংগ্রহ করেছি। প্রথম জীবনে গগনেন্দ্রনাথ লোকটা জেলের কয়েদীদের রক্ষী ছিলেন। দিনের পর দিন একদল অস্বাভাবিক অপরাধীদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ওঁর মনের সহজ প্রবৃত্তিগুলো একটু একটু করে বিকৃত হয়ে গেছে। হয়ত গগনেন্দ্রনাথ মনে মনে নিষ্ঠুরতা ভালবাসতেন না। কিন্তু যেহেতু তাকে জেলের কয়েদীদের রক্ষী হতে হয়েছিল, কর্তব্যের খাতিরেই হোক বা আইনের খাতিরেই হোক নিত্যনিয়মিত একদল অস্বাভাবিক লোকের সঙ্গে মিশে মিশে, ভেড়ার মত সর্বদা তাদের আইনের নাগপাশে বেঁধে রেখে চালনা করতে করতে হয়ত বা মনে মনে নিজের অজ্ঞাতেই একদিন অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিলেন। এক কথায় অন্যের উপরে ক্ষমতা প্রয়োগ করবার হয়ত একটা দুর্মদ উম্মাদ কামনা চিরদিনই ওঁর অবচেতন মনের মধ্যে সুপ্ত বস্তুর মত ঘুমিয়ে ছিল। একদিন হয়ত সেই অবচেতন মনের অলঙ্ঘ্য ইঙ্গিতেই জেলের কয়েদীদের রক্ষার কাজ বেছে নিয়েছিলেন প্রয়োজন হিসাবে, মনের অবচেতন লালসার তৃপ্তিসাধন করতে।
মনোবিজ্ঞানে বলে, আমাদের অবচেতন মনে অনেক সময় অনেক অদ্ভুত বাসনাই গোপন থাকে। ক্ষমতা প্রয়োগের একটা দুর্বার বাসনা, একটা পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা, ধ্বংস করবার একটা বন্য বর্বর আদিম ইচ্ছা-ঐসব প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম মানব-প্রবৃত্তি-আজওঁ ওগুলো আমাদের সভ্যতার চাকচিক্যের অন্তরালে আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। আদিম বর্বর যুগের সেই বন্য নিষ্ঠুরতা, উন্মাদ প্রলোভন, পাশবিকতা—আজ আমরা সভ্যতার আবরণে সেটা ঢেকে রাখতে অনেক কায়দা-কানুন শিখেছি বটে, স্বীকার করি, কিন্তু তবু সেই আদিম বর্বর অবচেতন প্রবৃত্তিগুলি যখন আমাদের মনে প্রবল হয়ে ওঠে, তখন আমাদের একান্ত অজান্তেই আমরা নিরুপায় হয়ে ধরা দিতে বাধ্য হই সেই সব প্রকৃতির হাতে। কোথায় ভেসে যায় আমাদের সভ্যতা, এত কষ্টে অর্জিত শিক্ষার গিল্টির আবরণ। মনের সেই চিরন্তন আদিম বর্বরতা ক্ষুধার্ত লালসায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।
দুঃখের বিষয় আজ আমরা আমাদের জীবনের সব কিছুতেই যেন সেই আদিম বন্য বর্বর প্রবৃত্তির প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। জাতীয় জীবনে, রাজনীতিতে, সমাজে, রাষ্ট্রে, সভ্যতায়। দয়া হতে, ভ্রাতৃত্ব হতে আজকের এই মনুষ্যত্বের এটা একটা রিঅ্যাকশন। আজকের এইসব চলিত নীতিগুলো দেখে অনেক সময় মনে হয় বুঝি খুব সঠিক চিন্তাপূর্ণ ও মঙ্গলজনক একটা গভর্মেন্ট গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে সে গভর্মেন্ট একদিন জোর করে চালু করা হয়েছিল, ভয় ও নিষ্ঠুরতার উপরে তার ভিত্তি উঠেছিল গড়ে। সেদিনকার সেই ভয় ও নিষ্ঠুরতার ভিত্তিতে গড়া গভর্মেন্টই আজ আমাদের মনের চিরন্তন আদিম ও ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতাকে মনের সভ্যতার গিল্টি-করা দরজাটা খুলে বাইরে বের করে দিয়েছে। তাই তো আজ জগতে জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে এত হানাহানি, এত রক্তারক্তি, এত যুদ্ধবিগ্রহ।