লাহোর মেডিকেল কলেজে ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপনা করেন।
বড়দিনের ছুটিতে পুরীতে বেড়াতে এসেছেন।
বয়স প্রায় সাতাশ-আটাশ বৎসর হবে। রোগা ছিপছিপে গড়ন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল পরিষ্কার।
টানা টানা দুটি স্বপ্নময় চোখ।
সুশ্রী মুখখানি জুড়ে একটা কমনীয়তা যেন ঢল ঢল করে।
ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ।
আমাদের নীচের তলার বাসিন্দাদের নিয়েই ঘটনা, তাই উপরের বাসিন্দাদের এখানে বৃথা বর্ণনা করে কারো বিরক্তিভাজন হতে চাই না। গগনেন্দ্রনাথের ভাইপোদেরও এখানে একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার।
রণধীর মল্লিকের বয়স ত্রিশের মধ্যে আগেই বলেছি। বেশ মোটাসোটা নাদুসনুদুস চেহারা। গায়ের বর্ণ গৌর, নাক চোখ মুখে কোন বুদ্ধির প্রাধ্য নেই বটে, তবে শিশুর মত একটা সহজ সরলতা বিরাজ করে।
অত্যন্ত শান্ত, গোবেচারী নিরীহ, আরামপ্রিয়। মিতভাষী চোখের দৃষ্টিতে একটা সদা-সশঙ্কিত ভাব। একান্ত নির্জনতাপ্রিয়। বেশীর ভাগ সময়ই বই পড়ে কাটায়।
মেজো সমীরের বয়স প্রায় সাতাশের কাছাকাছি হবে।
ভাইদের মধ্যে সমীরেরই গাত্রবর্ণ সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল। ভাইদের মধ্যে সব চাইতে বেশী লম্বা, রোগাটে গড়ন, ধীর শান্ত নমনীয়।
চোখ দুটি টানা-টানা, গভীর আঁখিপল্লবের নীচে সমুদ্রে নীল জলের মত গভীর নীলাভ শান্ত উদাস দৃষ্টি। চোখের কোল দুটি সর্বদাই ছলছল করে। মাথার কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। বিস্ত, এলোমেলো। উন্নত খড়গের মত বাঁকা নাসিকা যেন উদ্ধত বিস্ময়ে মুখের উপরে ভেসে আছে।
পাতলা লাল দুটি ঠোঁট, মুক্তা-পংক্তির মত শুভ্র একসারি দাঁত।
মুখখানি সদাই বিষণ্ণ, চিন্তাযুক্ত। যেন একখানি জলভরা মেঘ। বেশীর ভাগ সময়ই চুপচাপ একা একা বসে কী যেন ভাবে।
সেজো বা তৃতীয় অধীর বেশ বলিষ্ঠ গঠন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল-শ্যাম। চোখমুখে একটা উদ্ধত দৃষ্টি। কথা একটু যেন বেশীই বলে, কিন্তু ব্যবহারে একটা যুদ্ধ-ক্লান্ত সশঙ্কিত ভাব। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যে।
সর্বকনিষ্ঠ কিশোর। রুগ্ন পাংশু চেহারা।
মনে হয় চিরদিন শুধু রোগেই কেবল ভুগছে।
চোখেমুখে একটা ভীত সশঙ্কিত ভাব। দেখলে করুণা হয়।
এ বাড়ির বৌ বিনতা।
এক কথায় যেন একখানি লক্ষ্মীর সচল প্রতিমা।
চোখেমুখে একটা উদ্ধত বুদ্ধির প্রখ্য।
বুড়ো গগনেন্দ্রনাথের সর্ববিধ সেবার কাজ হাসিমুখে সে-ই করে। দিবারাত্র ছায়ার মতই বুড়োর আশেপাশে ঘোরে।
সমীর সব সময়ই বৌদিকে সাহায্য করে।
প্রকাণ্ড এক রূদ্ধকারার মধ্যে বিনতা যেন আলোর একটুখানি আভাস। গভীর বেদনার মাঝে একফোঁটা আঁখিজল।
এ বাড়ির সকলের মধ্যে যে শঙ্কার একটা কালো ভয়াবহ ছায়া থমথম করছে তার মাঝে যেন একটা আশার বিদ্যুৎ-শিখা এই বিনতা।
বিনতা বড় গরীবের মেয়ে। মামার দয়ায় মামার বাড়িতেই চিরকাল অবহেলা অনাদরে মানুষ।
জন্মাবধি তার ব্যথার সঙ্গেই পরিচয়। আশ্রয় তার চিরসাথী, হাসি তার কেউ নয়।
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে তীক্ষ্ণ মেধাবী।
নিজের অক্লান্ত চেষ্টায় স্কলারশিপ নিয়ে বি. এ. পাস করে লাহোরে এক স্কুলে চাকরি নিয়ে যায়। মাঝখানে কিছুদিন নার্সিংও পড়েছিল। গগনেন্দ্রনাথ তখন লাহোর সেন্ট্রাল জেলে সুপারিনটেনডেন্ট। বিনতা থাকত গগনেন্দ্রনাথেরই পাশের একতলা ছোট্ট বাড়িটায়। কেমন করে যে রণধীরের সঙ্গে বিনতার আলাপ হল, কাকার দুর্জয় শাসনের গণ্ডি ডিঙিয়ে কেমন করে যে সেই আলাপ গভীর হতে গভীরতর হল এবং শেষটায় বিনতা স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রণধীরের পিছু পিছু বধূবেশে গগনেন্দ্রনাথের পাষাণ-প্রাচীরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল সে আজও এক বিস্ময়।
বাইরে থেকে এ বাড়ির যে ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিক আবহাওয়া, যেটা কোনদিনই বিনতার চোখে ধরা পড়েনি, আজ সেইটাই বিনতার সর্বাঙ্গে যেন সুকঠিন লৌহ-শৃঙ্খলের মতই তাকে জড়িয়ে ধরল এ বাড়ির মধ্যে পা দেওয়ার কিছুকালের মধ্যেই।
শীঘ্রই চিরস্বাধীন বাধাহীন মন তাঁর হাঁপিয়ে উঠল।
ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিক এ বাড়ির আবহাওয়া। যেন একটা দুর্জয় গোলকধাঁধা। এখানে সব কিছু একজনের বাঁধাধরা সুকঠিন নিয়মের মধ্যে চলে।
যেন একটা প্রকাণ্ড অজগর সাপের বিষাক্ত দৃষ্টির তলায় সকলে সম্মোহিত পঙ্গু হয়ে আছে।
এখানে জীবনের স্পন্দন নেই, আছে মৃত্যুর গভীর নীরবতা। এখানকার বাতাসে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। হাঁফ ধরে।
পুরীতে এসে অবধি গগনেন্দ্রনাথ বেশীর ভাগ সময়ই তাঁর ঘরের সামনে বারান্দায় একটা আরামকেদারার উম্বরে দামী সাদা শাল গায়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকেন, তাঁর আশেপাশে বাড়ির আর সকলে বসে থাকে।
মাঝে মাঝে গগনেন্দ্রনাথ সমুদ্রের তীরে বেড়াতে যান; সঙ্গে সবাই যায়। আবার সন্ধ্যার পরে একত্রে সবাই হোটেলে ফিরে আসে।
দিনমণি একটু আগে সাগরজলে আবির গুলে অস্ত গেছেন। সাগর-কিনারে বালুর ওপরে সাগরজলের দিকে নিমেষহারা দৃষ্টি মেলে একাকী নীরবে বসে আছে প্রতিমা।
কোলের উপরে পড়ে আছে রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতাখানা।
মাথায় আজ সে সাবান দিয়েছিল, রুক্ষ বিস্ত চুলগুলি হাওয়ায় উড়ছে। পরিধানে তার আজ গেরুয়া রঙের একখানা খদ্দরের শাড়ি, গায়ে ডিপ আকাশ-নীল রঙের হাতকাটা ব্লাউজ।
প্রতিমা দেখছিল, সন্ধ্যার ধূসর ম্লান ছায়া একটু একটু করে সারা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে।