পুরী-স্বর্গধাম
১৩ ডিঃ, ৪৩
প্রিয় কিরাত,
হঠাৎ গগনবাবুর অনুরোধে পুরী চলে এলাম। সকলে স্বর্গধাম হোটেলে এসে উঠেছি। বেশ লাগছে। কলকাতার ধুলো বালি রোগের বাইরে প্রকৃতির এই গম্ভীর পরিস্থিতিতে মনের সব কটি দুয়ারই যেন খুলে গেছে। সকালে বিকালে শুধু সমুদ্রে বিরাট রূপ নয়নভরে দেখি। কখনও ভয়ঙ্কর, কখনও স্নিগ্ধ, কখনও শান্ত….সে এক অপূর্ব। আয় কটা দিন থেকে যাবি, আমি একটা আলাদা ঘর নিয়েছি, সেখানেই থাকতে পারবি। আসবি তো রে! ভালবাসা রইল।
তোর কুনো
২. ঘনীভূত
নীল! নীল! নীল।
পুরীর সাগর।
কী একটা বিরাট অপূর্ব সীমাহীন অনন্ত বিস্ময়।
বিশ্বপ্রকৃতি যেন বিরাট এক নীলাম্বরী গায়ে জড়িয়ে অসীমের মাঝে ড়ুব দিয়েছে।
অকুল পারাপারহীন নীলাঞ্জনে দৃষ্টি মিগ্ধ হয়ে আসে।
অসীম নীলাকাশ যেন স্নেহে আকুল অসীম বারিধির শান্ত শীতল বক্ষে নিঃস্ব করে আপনাকে আপনি উজাড় করে ফেলে দিয়েছেন। শুধু হেরি এক বিপুল মহান নীলিমা! যেদিকে চক্ষু ফিরাই! এ কি অপূর্ব! মহাবিস্ময়ে সমগ্র ইন্দ্রিয়কে মুগ্ধ করেছে!
কিরীটী মুগ্ধ হয়ে গেল।
একদিন মাত্র এখানে এসেছে সে, কিন্তু একটি দিনেই যেন তার সমগ্র মনখানি মুক্ত অবাধ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। কাজকর্ম চিন্ত সব কোথায় চলে গেছে।
গতকাল রাত্রি প্রায় বারোটা পর্যন্ত এই সমুদ্রের ধারে বালুবেলার উপরে সে বসে বসে কাটিয়েছে।
অনেক রাত্রে যখন শুতে যায়, দু-চোখের নিদ্রালু ভারী পাতার সঙ্গে যেন অদ্ভুত এক স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে।
স্বৰ্গৰ্বার হোটেল থেকে সাগরের বেলাভূমি মাত্র একরশি পথ দুরে। একতলার খোলা বারান্দায় দাঁড়ালে সাগরের বিপুল রূপ দু-চোখের দৃষ্টি জুড়ে ভাসতে থাকে।
সারাটা রাত এক অদ্ভুত চাপা গুম গুম গর্জন। যেন সাত-সাগরের অতলতলে কোন এক লৌহকারার অন্তরালে অনাদিকালের বন্দী দৈত্য মুক্তির লাগি লৌহকপাটের গায়ে মাতা খুঁড়ে খুঁড়ে গর্জন করছে।
বিরামহীন ছেদহীন সে গর্জনধ্বনি।
বিশেষ করে রাত্রির অন্ধকারে বিশ্বচরাচর যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, সমুদ্রের কান্না যেন কী এক করুণ বেদনায় সাগরবেলায় কেঁদে কেঁদে ফেরে।
ছোট মাঝারি বড় কালো কালো ঢেউগুলো শুভ্র ফেনার মুকুতা-কিরীট মাথায় পরে সাগরবেলার করুণ বেদনায় কেবলই আছড়ে আছড়ে পড়ে।
মাটির কাছে বারিধির সেই চিরন্তন মিনতি, ওগো বন্ধু, ওগো আমার শান্ত মাটি, আমায় গ্রহণ কর! আমায় ধন্য কর! আমায় পূর্ণ কর।
একজন পাগল সদাচঞ্চল খেয়াল খুশিতে উদ্দাম বাঁধনহারা, অন্যজন শান্ত-ধীর।
***
স্বর্গদ্বার হোটেল।
হোটেলটি একজন উড়িষ্যাবাসী বাঙালী ভদ্রলোকের। সাগরের প্রায় কোল থেকেই উঠেছে স্বর্গদ্বার হোটেলটি।
আরাম ও পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে সত্যই প্রশংসনীয়। ঘরগুলি খোলামেলা, পরিপাটী সাজানো-গোছানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুপ্রশস্ত।
হোটেলটি সর্বসমেত দোতলা।
উপরে ও নীচে অনেকগুলি ঘর।
সর্বদাই হোটেলটি নানাজাতীয় লোকের ভিড়ে ভর্তি থাকে। একতলা ও দোতলায় খোলা বারান্দা। সেখানে সোফা, আরাম-কেদারা প্রভৃতিতে বসবার বন্দোবস্ত আছে।
উপরে ও নীচে দুটি খাবার ঘর।
গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ভাইপোদের নিয়ে নীচেরই কয়েকখানি ঘরে বসবাস করছেন।
কিরীটী ডাঃ অমিয়র সঙ্গে একই ঘরে থাকবার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে।
গগনেন্দ্রনাথ সর্বসমেত পাঁচখানি ঘর নীচের তলায় ভাড়া নিয়েছিলেন। একখানিতে তিনি থাকেন। তাঁর ডান দিককার ঘরে রণধীর সস্ত্রীক, বাঁয়ের ঘরে কিশোর, তার পাশের ঘরে সমীর এবং তার পাশের ঘরে অধীর।
কোন ঘরের সঙ্গে কোন ঘরের যোগাযোগ নেই, প্রত্যেক ঘরের সঙ্গে আলাদা আলাদা সংলগ্ন ছোট্ট একটি বাথরুম আছে। তাছাড়াও একটি সকলের ব্যবহারের জন্য বড় স্নানঘর আছে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াত করতে হলে বারান্দা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়।
রেলিং দেওয়া প্রশস্ত বারান্দার সামনেই প্রশস্ত একটি বাঁধানো চত্বর, চত্বরের সীমানায় লোহার রেলিং, তারপরেই সদর রাস্তা, রাস্তার নীচে সাগরের বেলাভূমি।
গগনেন্দ্রনাথের ফ্যামিলি ছাড়াও নীচের তলায় আরো তিনজন বাস করেন।
কিরীটীদের পাশের ঘরেই থাকেন বারীন রায় নামে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয়। দীর্ঘ ছয় ফুট, বলিষ্ঠ গঠন। এত বয়স হয়েছে তবু শরীরের গাঁথুনি দেখলে বিস্মিত হতে হয়। মাথায় সাদা চুল ব্যাক-ব্রাশ করা। দীর্ঘলম্বিত ধবধবে সাদা দাড়ি।
চোখে সোনার ফ্রেমে কালো কাঁচের চশমা। চোখের গোলমাল আছে বলে তিনি রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করেন। অতি সৌম্য প্রশান্ত চেহারা, হাসিখুসী আমুদে লোক। অত্যন্ত রসিক।
ভদ্রলোক অবিবাহিত, বাংলার বাইরে পাণ্ডববর্জিত মুলুকে কোথায় কোন্ বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনা করে এতকাল কাটিয়েছেন। কার্য থেকে বিশ্রাম নিয়ে এখন দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
বেশ সচ্ছল অবস্থা।
তাছাড়া বারীনবাবুর পাশের ঘরে যতীন ঘোষ বলে এক ভদ্রলোক থাকেন।
ভদ্রলোক চিররুগ্ন। অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে, স্বাস্থ্যকর জায়গায় কেবল ঘুরে ঘুরে বেড়ান।
তাঁর পাশের ঘরে থাকেন তরুণী কুমারী ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী।
মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. পাস করে বিলেত থেকেও ধাত্রীবিদ্যার ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন।