গজেনদার উইলের ব্যাপারটাও আমি জানি। তার সম্পত্তি সমান দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগ, নানা প্রকারের হিতকর প্রতিষ্ঠানে দান করা হবে। দ্বিতীয় ভাগ, সমান অংশে চার ভাগ—একভাগ সৌরীন, একভাগ অশোক, একভাগ বিনয়দা, আর এক ভাগ আমি! উইলের ব্যাপারেও সৌরীনের খুব আপত্তি ছিল। কিন্তু গজেনদা সৌরীনের কোন কথাই শোনেন নি। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার ইতিমধ্যে ঘটেছিল। কিছুদিন আগে সৌরীন তার এক বন্ধুর কাছ থেকে দুহাজার টাকা ধার নেয়। সেই ব্যাপার নিয়ে আজ কয়েকদিন থেকেই সৌরীন ও গজেনদার মধ্যে রাগারাগি চলছিল। এসব থেকে নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারবেন—মানে আমি কি বলতে চাইছি—
সুব্রত শান্তকণ্ঠে বললে, হুঁ। আচ্ছা সে জন্যই কি আপনি সকালে আজ আমার কাছে চিঠি দিয়েছিলেন মিঃ চৌধুরী?
সুবিমল যেন আকাশ থেকে পড়েছে হঠাৎ। বিস্ময়ে হতবাক। বললে, চিঠি!
হ্যাঁ, আপনিই তো আজ সকালে আমাকে চিঠি দিয়েছেন! এই তো সেই চিঠি, বলতে বলতে সুব্রত পকেট থেকে সেই আকাশ-নীল রংয়ের খামের চিঠিখানা সুবিমলবাবুর হাতে তুলে দিয়ে তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সুবিমলবাবু সুব্রতর হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে তাকাতে তাকাতে বলে, আশ্চর্য! আশ্চর্য!
চিঠিখানা আপনারই লেখা তো সুবিমলবাবু? সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুবিমলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে।
আশ্চর্য, অবিকল আমারই হাতের লেখা। কিন্তু আমি শপথ করে বলতে পারি সুব্রতবাবু, বিশ্বাস করুন, এ চিঠিটা আমার লেখা নয়!
আর চিঠির কালিটা?
আরও আশ্চর্য, ঠিক এই ধরনের কালিই আমার কাছে আছে। এটা একটা special কালি। Chinese violet ink. আমার এক বন্ধু আর্টিস্ট কিছুদিন হল চীন থেকে ফিরেছে। সেই আমাকে মাস সাতেক আগে কালিটা উপহার দিয়েছিল। মাঝে মাঝে আমি কালিটা ব্যবহার করি বটে এবং কালিটা প্রায় ফুরিয়েও এসেছে।
আপনার সেই বন্ধুটির নাম কি জিজ্ঞাসা করতে পারি?
নিশ্চয়ই। বন্ধুটির নাম সুবোধ দত্ত। আমহার্স্ট স্ট্রীটে..নং-এ থাকে। তাকে জিজ্ঞাসা করলেই আপনি সব জানতে পারবেন।
সুব্রত নোটবুক বের করে নাম-ঠিকানা টুকে নিল।
সুবিমলবাবু, আপনাকে আমার আরও কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে!
বলুন।
গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?
সুবিমলবাবু সুব্রতর কথায় মৃদু হাসলো, আপনি বোধহয় জানেন না মিঃ রায়, রাজলক্ষ্মী মিলে আমি চাকরি করি। গতকাল সন্ধ্যা সাতটার পর মিল থেকে বাড়ি ফিরেছি। চা খেয়ে Rainbow Club-এ যাই। রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত আমি Rainbow Club-এই ছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে সোয়া ছয়টা নাগাদ গজেনদার এখানে আসি।
কেন?
আমার কিছু টাকার প্রয়োজন ছিল।
তারপর?
আমি জানি তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘণ্টাখানেক লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনা করেন। তাই বরাবর তার লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে ঢুকি। এবং ঘরে ঢুকেই তাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পাই। তখনই ডাকাডাকি করে সকলকে জাগাই এবং পুলিশে খবর দিতে বলে হোটেলে চলে যাই। হোটলে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, পুলিশ এলে হয়তো আমাকে তাদের প্রয়োজন হতে পারে—তাই আবার চলে এলাম।
আপনি তাহলে মধ্যে মধ্যে মিঃ সরকারের কাছে টাকা নিতেন?
হ্যাঁ, নিতাম।
আচ্ছা শেষ কবে আপনার মিঃ সরকারের সঙ্গে দেখা হয়?
দিন পাঁচেক আগে সন্ধ্যার পর এখানে এসেছিলাম, সেই শেষ দেখা। তারপর আর দেখা হয়নি।
সুব্রত এবার বললে, আচ্ছা সুবিমলবাবু, আপনি এখন যেতে পারেন। প্রয়োজন হলে আবার আপনার ওখানেই গিয়ে দেখা করব। কখন আপনাকে আপনার হোটেলে পাওয়া যেতে পারে?
সকালে বেলা এগারোটা পর্যন্ত। আর সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত। আটটার পরে Rainbow Club-এ গেলেও দেখা পাবেন। প্রত্যহই আমি সেখানে যাই।
সুবিমলবাবু এবার উঠে দাঁড়ালেন, আচ্ছা তাহলে আসি। নমস্কার।
সুবিমলবাবু ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
৬. সুব্রত গণেনবাবুকে এরপর ডেকে পাঠলো
সুব্রত গণেনবাবুকে এরপর ডেকে পাঠলো।
মিঃ তালুকদারের মুখের দিকে তাকিয়ে সুব্রত বললে, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ তালুকদার, মিঃ সরকারের লাইব্রেরির বড় ওয়াল ক্লকটা, তার হাত-ঘড়িটা, অশোকের ঘরে টীপয়ের ওপরে রাখা রিস্টওয়াচটা, সৌরীনবাবুর রিস্টওয়াচটা—সব কটাই ঠিক রাত্রি দুটোর সময় বন্ধ হয়ে গেছে।
সুব্রতর কথা শেষ হবার আগেই গণেন এসে ঘরে প্রবেশ করে।
মোটাসোটা গোলগাল চেহারা।
মাথার সামনের দিকে দুপাশে টাক দেখা দিয়েছে। কপালের ও রগের দুপাশের চুলে পাক ধরেছে। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে অ্যাশকলারের দামী গরম স্যুট। পায়ে পালিশ করা চকচকে শু। বয়েস বোধ করি—চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মধ্যে হবে। মুখখানা গম্ভীর।
সুব্রতই প্রথম কথা বললে, আসুন। নমস্কার। আপনারই নাম—
নমস্কার, গণেন্দ্রনাথ সরকার।
বসুন ঐ চেয়ারটায়। সুব্রত অঙ্গুলি-নির্দেশে একখানা চেয়ার দেখিয়ে দিল।
গণেন্দ্র চেয়ারটার উপর উপবেশন করল।
আপনিই মহালক্ষ্মী ব্যাংকের প্রোপ্রাইটার?
না, অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার।
ও!
অতঃপর দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ!
আবার সুব্রত প্রশ্ন করলে, কাল সারা দিনরাত্রিতে আপনি কোথায় ছিলেন?
সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাংকে ছিলাম। তারপর মার্কেটে যাই। কয়েকটা জিনিসপত্র আমার কেনবার ছিল। জিনিসপত্র কিনতে কিনতে আমার রাত্রি নয়টা বাজে। নয়টার শোতে মেট্রোতে ছবি। দেখতে যাই। এই দেখুন তার টিকিট। বলতে বলতে রাত্রি নয়টার শোর টিকিটের একটা অংশ। গণেনবাবু পকেট থেকে বের করে দেখাল।