হঠাৎ এমন সময় কার কণ্ঠস্বরে ঘরের সকলেই চমকে পিছন দিকে ফিরে তাকাল।
কার কথা হচ্ছে শুনি? আমারই কথা হচ্ছে বোধ হয়!
সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কে আপনি?
আমি সুবিমল চৌধুরী। আপনি?
সুব্রত রায়।
যাক ভালই হল, আপনি এসে গেছেন দেখছি, নমস্কার। শুনতে পাই কি, আমার সম্পর্কে কি কথা হচ্ছিল! শুনতে পেলে আমি নিজেই সবকিছু খোলসা করে দিতে পারতাম। কেননা আমার নিজস্ব ব্যাপার অন্যের চাইতে আমি নিজেই বেশী ভাল জানি আশা করি।
সুব্রত এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভাল করে সুবিমলের দিকে তাকিয়েছিলেন।
০৫. সুবিমল চৌধুরী
সুবিমল চৌধুরী।
লম্বায় প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি হবে। রোগা ঢ্যাঙ্গা পাতলা চেহারা। চোখ দুটি টানা টানা। দৃষ্টি যেন দুখানা ধারাল ছুরির ফলার মতই বুদ্ধিপ্রাচুর্যে ঝকঝকে।
টানা উদ্ধত ভ্রূ। নাকটা একটু বোঁচা। সামনের দুটি দাঁত একটু উঁচু। বাঁ গালের ওপরে একটি দুইঞ্চি পরিমাণ ক্ষতচিহ্ন। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। বেশভূষা অত্যন্ত পরিপাটী। দামী মারের গরম স্যুট পরিধানে। পায়ে দামী পালিশ করা চকচকে পয়েনটেড টো শু। মুখে বর্মা চুরুট।
সুবিমল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললে, আমি জানতাম, আমাকে আপনার প্রয়োজন হবে। তাই নিজেই চলে এলাম আপনাকে কষ্ট না দিয়ে। সত্যি আমি খুব খুশি হয়েছি মিঃ রায় যে, আপনি নিজেই কেসটা হাতে নিয়েছেন। কেননা আমার ধারণা, এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। মিঃ সরকারকে খুন করা হয়েছে!
মিঃ সরকার যে খুনই হয়েছেন, স্বাভাবিক মৃত্যু তার হয়নি বা হতে পারে না এ ধারণা হল কেন আপনার, মিঃ চৌধুরী?
সেই কথা বলতেই আমি এসেছি সুব্রতবাবু। আমার কথা সব শুনলেই হয়তো বুঝতে পারবেন, কেন আমার এ ধারণা হল!
বলুন।
সৌরীন্দ্রর সামনে আমি কোন কথা বলতে রাজী নই। ওকে এ ঘর থেকে আগে যেতে বলুন মিঃ রায়।
কিন্তু আমারও যা বলবার তা বলা এখনও শেষ হয়নি। তাছাড়া যা তুমি বলতে চাও, আমার সামনেই অনায়াসে বলতে পার। সৌরীন্দ্রবাবু বাধা দিলেন।
বলতে যে আমি পারব না তা নয় সৌরীন। কিন্তু তবু আমার ইচ্ছা নয় যে তুমি এখন এ ঘরে থাক। আমার মনে হয় এ সময় তোমার এ ঘরে না থাকাই ভাল। সুবিমলবাবু জবাব দিলেন।
সুব্রত এতক্ষণে কথা বললে, সৌরীনবাবু, আপনি না হয় পাশের ঘরে যান! প্রয়োজন হলে তখন আপনাকে আবার ডেকে পাঠাব!
বেশ যাচ্ছি। একটু রাগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করে সৌরীন্দ্রবাবু সে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
সুব্রত সুবিমলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, এবারে বলুন, মিঃ চৌধুরী! আপনি কি বলতে চান?
সুবিমলবাবু তখন বলতে লাগলো, জানি না আপনি জানেন কিনা মিঃ রায়, মিঃ গজেন্দ্র সরকার দূর সম্পর্কে আমার মামাত ভাই ছিলেন। এঁদের বাড়িতে আমার যথেষ্ট যাতায়াত এবং পরিচয়ও সেই সূত্রেই। এ বাড়ির সবকিছুই আমার একপ্রকার নখদর্পণে বলতে পারেন। মিঃ সরকার, মানে গজেনদা বয়সে আমার চাইতে অনেক বড় ছিলেন। তিনি যে সম্পর্কে। কেবলমাত্র আমার মামাত ভাই-ই ছিলেন তা নয়, সত্যিকারের একজন বন্ধুও ছিলেন। বলতে বলতে সুবিমলবাবুর স্বরটা যেন গাঢ় হয়ে এল, আজ তাকে হারিয়ে আমি সত্যিকারের একজন সহায়সম্বল হারালাম।
আমি জানি, গজেনদার বাবা যখন মারা যান, তখন তাঁর সম্বলের মধ্যে বৌবাজারে একটি ছোট সোনারূপার দোকান মাত্র ছিল। সেই দোকান থেকেই তিনি প্রভূত যত্নে ও অদম্য অধ্যবসায়ে আজকের এই এক বড় ব্যবসা ও ব্যাঙ্ক গড়ে তোলেন। গজেনদার বড় ছেলের বয়স যখন মাত্র একুশ বৎসর সেই সময় বৌদি মারা যান। তিনি আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন নি। অত বড় ধনী হলেও মনে তার এতটুকুও শান্তি ছিল না। তিনি নিজে ছিলেন অত্যন্ত ধীর, শান্ত ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক। তার মনে কেউ হাজার ব্যথা দিলেও মুখ ফুটে কোনদিন কারও কাছে কিছু বলতেন না। নিজের মনের কষ্ট চিরদিন নিজের মনেই চেপে রাখতেন।
যারা তাকে কোনদিন ভাল করে বুঝবার সুযোগ বা সুবিধা পেয়েছে, কেবলমাত্র তারাই তার মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারত কত বড় একটা দুঃখে তার মনটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। মনের কথা তিনি কখনও কাউকেই খুলে বলতেন না। তবে আমার কাছে তিনি মাঝে মাঝে দু-একটা কথা বলতেন। আমি জানি—অনেকখানি আশা করেই তিনি গণেনকে মানুষ করেছিলেন। কিন্তু গণেন ছিল অত্যন্ত উদ্ধত প্রকৃতির। একদিন সামান্য কারণে সে গজেনদার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তবু তিনি তাঁর পিতার কর্তব্য থেকে বিচলিত হন। নি। টাকাপয়সা দিয়ে তাকে পৃথকভাবে ব্যবসা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। ইদানীং অবিশ্যি আর ছেলের সঙ্গে তার প্রায় কোন সম্পর্কই ছিল না।
তারপর ছোট ছেলে সৌরীন—তাকে তিনি পড়াবার অনেক চেষ্টা করলেন। সৌরীন ছেলেটিও মেধাবী ছিল। হঠাৎ বি. এস-সি পাস করে পড়াশুনা ছেড়ে দিল। গোঁ ধরল আর সে পড়াশুনা করবে না। বছরখানেক সে বাড়িতে চুপচাপ বসে রইল। যত রকমের আড্ডায় ঘুরে ঘুরে বেড়ালো। তারপর সে শুরু করলে রেস খেলা। গজেনদা এ বাড়ির প্রত্যেকের জন্যই মাসিক একটা হাত-খরচ বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। সৌরীন মাসে দুশো, অশোক মাসে আড়াইশো, বিনয়দা মাসে দুশো করে টাকা পেত। সৌরীনের দুশো টাকায় চলত না। প্রায়ই সে গজেনদার কাছ থেকে আজ দুশো কাল একশো, এই রকম করে মাসিক ধার্য হাতখরচ ছাড়াও শ দুই-তিন করে টাকা বেশী নিত। এই সময়ই লৌরীন ব্যবসা দেখাশুনা করতে শুরু করলে। মাস দুয়েক আগে হঠাৎ একদিন সে দোকানের ক্যাশ থেকে গজেনদাকে কিছু না বলে গজেনদার নামে টাকা তুলে নেয়। দিন দুই বাদে হঠাৎ সেকথা গজেনদা দোকানের ক্যাশিয়ারের মুখে শুনতে পেলেন, বাপে ছেলেতে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেল। ঐদিন থেকেই বাপে-ছেলেতে মনোমালিন্য শুরু হল। এবং তারপর থেকেই প্রায়ই দুজনার মধ্যে পয়সা নিয়ে খিটিমিটি চলত।