বসুন। সুব্রত বললে, আপনার নাম সৌরীন্দ্র সরকার?
হ্যাঁ।
কয়েকটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, সৌরীন্দ্রবাবু। আশা করি যথাযথ জবাব পাব।–হ্যাঁ ভাল কথা, আপনার কোন ঘড়ি নেই?
আছে, রিস্টওয়াচ!
ঠিক আছে? মানে ঘড়িটা চলছে?
না—ঘড়িটা রাত্রি দুটোর পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সকালবেলা চালিয়ে দিয়েছি আবার। এখন সোয়া দশটা-সৌরীন্দ্র তারপর অশ্রুঝরা কণ্ঠে হঠাৎ বলল, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই!
বলুন?
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, একটা মস্তবড় ষড়যন্ত্র করে আমার নিরীহ বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। খুনীকে ধরে দিন। যত টাকা লাগে আমরা দেব। চিরদিন আমরা সকলে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব।
অধীর হবেন না, সৌরীনবাবু। আমাদের যথাসাধ্য আমরা করব এবং আশা করি খুনীকে ধরতেও পারব। এখন আপনাকে যা জিজ্ঞাসা করি তার জবাব দিন।
বলুন।
কাল সন্ধ্যের পর থেকে আজকের সকাল পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?
কাল সকালে আমি ব্যাংকে চলে যাই। ব্যাংক থেকে ফিরতে প্রায় রাত্রি আটটা হয়। রাত্রি। নটার সময় খাওয়াদাওয়া সেরে যখন শুতে যাচ্ছি,–বাবা আমাকে ডেকে পাঠান বাবা তখন লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ছিলেন।
কতক্ষণ সেখানে ছিলেন?
তা প্রায় ঘণ্টাখানেক হবে।
অর্থাৎ রাত্রি দশটার সময় আপনি লাইব্রেরি ঘর থেকে বের হয়ে আসেন?
হ্যাঁ।
আপনার বাবার সঙ্গে যখন দেখা করতে যান, তাঁকে কোনরকম চিন্তিত বা তাঁর ব্যবহারে অস্বাভাবিক কোন কিছু চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছিলেন?
সৌরীন্দ্র এ কথায় যেন বেশ চিন্তিত হয়ে উঠল। তারপর ধীরে মৃদু স্বরে বললে, না।
আচ্ছা, ইদানীং আপনার বাবার ব্যবহারে কোনপ্রকার কিছু চাঞ্চল্য অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছিলেন?
না।
আপনার বাবার আপনার প্রতি ব্যবহার কেমন ছিল?
বাবা আমাকে যথেষ্টই ভালবাসতেন।
আপনার দাদার সঙ্গে আপনার বাবার ব্যবহার কেমন ছিল?
দাদার সঙ্গে ইদানীং আজ তিন বৎসর আমাদের বিশেষ কোন সম্পর্কই নেই। তবে বাবা চিরদিন একটু গম্ভীর প্রকৃতির লোক, বিশেষ কিছু বোঝা যেত না। কারও ওপরে অসন্তুষ্ট হলেও মুখে তিনি সেটা কোনদিনই প্রকাশ করতেন না।
আপনার বাবার কোন শত্রু ছিল বলে আপনার মনে হয়?
না। বাবা অত্যন্ত নির্বিরোধী ও শান্তিপ্রিয় লোক ছিলেন। কারও সঙ্গে গোলমাল তার হত না।
শুনেছি ইদানীং আপনি আপনার বাবার সঙ্গে আপনাদের ব্যবসা ও ব্যাংকের কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন?
হ্যাঁ।
আপনাদের ব্যবসার অবস্থা কেমন? মূলধন কত?
ব্যবসার অবস্থা ভালই। কোন গোলমাল নেই। মূলধন যে কত তা ঠিক ঠিক আপনাকে বলতে পারব না। অ্যাটর্নী রামলাল মিত্র মহাশয় আপনাকে সঠিক খবর দিতে পারবেন। তবে আন্দাজ উনিশ-বিশ লক্ষ টাকা হবে।
আপনার বাবার উইল সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
না।
হুঁ। আচ্ছা আপনার পিসতুতো ভাই অশোকবাবুকে আপনার কি রকম মনে হয়?
ভালই। অত্যন্ত সচ্চরিত্র ও মেধাবী ছাত্র। চিরকাল আমাদের বাড়িতেই মানুষ। বাবাও তাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন।
আর আপনার কাকা বিনয়বাবু?
কাকাকে বাবা খুবই ভালবাসতেন এবং মনে হয় কাকাও বাবাকে শ্রদ্ধাভক্তি করতেন।
আপনার কাকা যে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে আছেন তার জন্য আপনার বাবা অসন্তুষ্ট হন নি?
না। শুনেছি প্রথম প্রথম দুএক মাস বাবা কাকাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু কাকা চিরকালই একটু একগুয়ে ও জেদী। কারও কথাই তিনি শুনতেন না। শেষে আর বাবা কিছু বলতেন না।
আপনার বাবার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে পারেন?
না।
কাল রাত্রে আপনার বাবার সঙ্গে আপনার কি কথা হয়?
ক্ষমা করবেন, সেটা আমাদের ফ্যামিলি সংক্রান্ত, একেবারে আমাদের নিজস্ব কথা। সে সম্পর্কে আপনাকে আমি কিছুই বলতে পারব না। তবে এটা জানবেন তার সঙ্গে এ মৃত্যুর কোন সংস্পর্শই নেই।
সুব্রত কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর মৃদুস্বরে বললে, রাত্রি দশটার পর আপনি আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলে সোজা নিজের ঘরেই চলে যান। আপনি তো আপনার বাবার পাশের ঘরেই থাকেন। রাত্রে কোনপ্রকার শব্দ বা গোলমাল শুনেছিলেন কি?
আজ্ঞে না। সারাদিনের পরিশ্রমে অত্যন্ত ঘুম পেয়েছিল। ঘরে এসে বিছানায় শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ি।
রাত্রে তাহলে কোনরকম কিছু অস্বাভাবিক গোলমাল বা শব্দ শোনেননি?
না। তাছাড়া ঘুম আমার একটু চিরকালই গভীর।
আজ সকালে কখন জানতে পারেন যে, আপনার বাবা মারা গেছেন?
সুবিমলের চিৎকারে চাকর রামচরণ গিয়ে আমার ঘুম ভাঙায়।
সুবিমলকে আপনার কিরকম মনে হয় সৌরীনবাবু?
সৌরীন্দ্র সুব্রতর প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার মুখের রেখায় রেখায় যেন একটা সুস্পষ্ট ক্রোধ ও বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেই আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।
সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার সৌরীন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, শুনলাম সুবিমলবাবু নাকি প্রায়ই আপনার বাবার কাছ থেকে টাকা নিতেন।
হ্যাঁ। একটা first class বেহিসেবী। তিনশো টাকা মাইনে পায়। তাতেও তার একলার কুলোয় না। শুনি সে জুয়াও খেলে।
অকস্মাৎ এমন সময় সুব্রত তার পকেট থেকে আজ সকালের প্রাপ্ত চিঠিখানা বের করে সৌরীন্দ্রর চোখের সামনে ধরে বললে, বলতে পারেন, এই চিঠিখানা কার লেখা? হাতের লেখাটা চেনেন?
সৌরীন্দ্র চিঠিখানার ওপরে একটিবার মাত্র দৃষ্টি বুলিয়েই যেন অত্যন্ত চঞ্চল ও বিস্মিত হল, হ্যাঁ, এ তো সুবিমলেরই হাতের লেখা। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এ সুবিমলেরই লেখা চিঠি। সুবিমলই এ চিঠি লিখেছে। কিছুদিন আগে একবার টাকার ব্যাপারে সুবিমলের সঙ্গে বাবার ঝগড়াও হয়েছিল। বাবা সুবিমলকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তারপর সে আবার একদিন রাত্রে এসে বাবার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে মিটমাট করে নেয়।