বসুন। আপনার নাম অশোক?
আজ্ঞে অশোক সেন।
ঐ সময় সুব্রত হঠাৎ প্রশ্ন করে, আপনার টেবিলের ওপরে রাখা ঘড়িটা লক্ষ্য করেছেন কিদুটো বেজে বন্ধ হয়ে আছে?
না তো!
লক্ষ্য করেন নি?
না।
মিঃ সরকারের ভাগ্নে হন তো আপনি?
হ্যাঁ।
আপনাকে দেখে যেন মনে হচ্ছে, রাত্রে আপনার তেমন ভাল ঘুম হয়নি। কাল রাত্রি জেগে খুব পড়াশুনা করেছিলেন বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সামনেই ফিফথ ইয়ারের পরীক্ষা।
কাল কত রাত্রি পর্যন্ত জেগেছিলেন?
তা প্রায় রাত্রি একটা হবে।
আপনি তো মিঃ সৌরীন সরকারের ঠিক পাশের ঘরেই থাকেন! কোন প্রকার অস্বাভাবিক শব্দ বা গোলমাল কিছু সৌরীনবাবুর ঘরে বা আপনার মামার ঘরে শুনেছিলেন কি?
না।
আচ্ছা মামাবাবুর সঙ্গে আপনার কি রকম সম্পর্ক ছিল?
তিনি আমাকে খুবই ভালবাসতেন। নিজের ছেলে সৌরীন্দ্রর থেকে কোন অংশেই তিনি আমাকে কম ভালবাসতেন না। তাছাড়া আজ প্রায় ষোল বছর মামার কাছেই তো আছি।
কাল কোথাও বের হয়েছিলেন আপনি?
সন্ধ্যা সাতটার সময় আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ঘরে ঢুকি। তারপর সারারাত ঘরেই। ছিলাম।
খেতে বের হননি?
না। কয়েকদিন থেকেই আমার খাবার চাকরেরা ঘরেই রেখে যায়। এ বাড়িতে সকলেই নটার মধ্যে খাওয়া শেষ করে। রাত্রি জেগে পড়তে হয় বলে আজ মাসখানেক থেকে আমি ঘরে বসেই খাই। কাল রাত্রে একটার সময় খেয়ে শুতে যাবার আগে গোপালকে ডেকে এঁটো থালাবাসন নিয়ে যেতে বলি। গোপাল এসে নিয়ে যায়।
তাহলে সারা রাত্রি আপনি ঘরেই ছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনার মামার তার ছেলেমেয়ের প্রতি ও তাঁর ছোট ভাইয়ের প্রতি ব্যবহার কি রকম ছিল বলতে পারেন?
গণেনদা তো এ বাড়িতে থাকেন না। মামার মতের সঙ্গে তার মত মেলে না, তাই তিনি আলাদা ভাবে ব্যবসা করছেন এবং আজ প্রায় তিন বৎসর আলাদা বাসা ভাড়া করে বালিগঞ্জেই থাকেন। আর ছোট ছেলে সৌরীনদা এখানেই থাকে। মামার ব্যবসা দেখাশোনা করে।
গণেনবাবু আসাযাওয়া করেন না?
আসেন কখনওসখনও। তাও এক আধ ঘণ্টার জন্য।
মিঃ সরকার কাকে বেশী ভালবাসতেন?
আমার মনে হয় মামা তার ছোট ছেলে সৌরীনদাকে যেন বড় ছেলে গণেনদার থেকে একটু বেশী ভালবাসতেন। আর ছোট মামা বিনয়েন্দ্রকেও মামা খুবই ভালবাসতেন।
আপনার মামার কোন শত্রু ছিল বলে আপনার মনে হয়?
মামার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোন কিছুই আপনাকে আমি বলতে পারব না। তাছাড়া মামা চিরদিনই একটু গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। কারও সঙ্গে বেশী কথা বড় একটা বলতেন না।
কাল আপনার মামার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?
না। অশোকের গলার স্বরটা যেন একটু কেঁপে উঠল, কিন্তু পরক্ষণেই সেটা সে সামলে নিল এবং বললে, মামা রাত্রে যেমন একটু দেরি করে শুতেন, তেমনি আবার ভোরে উঠতেন। রাত্রে এবং সকালে ঘন্টাখানেক লাইব্রেরি ঘরে কাটাতেন—তারপর প্রায় বেলা সাতটার সময় দোকানে বের হয়ে যেতেন। ইদানিং তিনি ব্লাডপ্রেসার ভুগছিলেন বলে রাত্রে একবাটি দুধ ও ফল ছাড়া বিশেষ কিছুই খেতেন না। সেও নিজের ঘরে বসে খেতেন। সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে স্নান করে লাইব্রেরিতে ঢুকতেন। অনেক রাত্রি পর্যন্ত পড়াশুনা করতেন। এই সব কারণে বাড়ির কারও সঙ্গেই বড় একটা তার দেখাশুনা হত না।
কবে শেষ আপনার মামার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
পরশু রাত্রে। আমি তখন সবে কলেজ থেকে ফিরেছি, রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটা হবে, তিনি আমাকে তার লাইব্রেরিতে ডেকে পাঠান।
কেন?
আমার পরীক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে।
তারপর আর মামার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
না। এবারও অশোকের গলার স্বরে যেন একটু দ্বিধা।
আপনার মামার কোন উইল আছে কিনা সে সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
হ্যাঁ। কিছুদিন আগে একবার তার হঠাৎ রক্তচাপ বৃদ্ধি হওয়ায় মাইলড় একটা হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল। মামার হার্ট-অ্যাটাক হওয়ায় আমি অত্যন্ত ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার চোখে জলও এসে গিয়েছিল। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, কঁদিস কেন অশোক! মামা কি কারও চিরদিন বেঁচে থাকে রে! সম্পত্তি ও টাকার এক তৃতীয়াংশ তোর নামে উইলে লিখে দিয়েছি। দুই পুরুষ তোর কোন অভাবই হবে না—যদি বুঝে চলতে পারিস। তাছাড়া আমার টাকা থেকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা তুই পাবি!
আর সবাইকে কি দিয়েছেন, সে সম্পর্কে সেদিন কিছু বলেছিলেন?
না।
আচ্ছা আজ সকালে প্রথম কি করে ব্যাপারটা আপনি জানতে পারলেন?
সুবিমলদার চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যায়—
এই সুবিমলবাবুটি কে?
সুবিমলদা মামার দূরসম্পৰ্কীয় পিসতুতো ভাই। রাজলক্ষ্মী মিলে চাকরি করেন। অ্যাভিন হোটলে থাকেন।
সুবিমলবাবু কি আপনাদের এখানে প্রায়ই আসাযাওয়া করেন নাকি?
হ্যাঁ। মামাবাবু সুবিমলদাকে খুব পছন্দ করতেন। তবে—
কি, থামলেন কেন বলুন!
মামাবাবু ওকে মধ্যে মধ্যে শুনেছি বকাবকি করতেন—
কেন?
শুনেছি বড্ড বেহিসেবী ও খরচে বলে?
আপনার মামাবাবু বোধ হয় তাকে সাহায্য করতেন?
হ্যাঁ। প্রায়ই মামাবাবুর কাছে সুবিমলদা টাকা চাইতে আসতেন।
সুবিমলবাবুকে আপনার কি রকম লোক বলে মনে হয়?
ভাল বলেই তো মনে হয়।
আচ্ছা এখন আপনি যেতে পারেন। সৌরীনবাবুকে পাঠিয়ে দিন।
একটু পরে সৌরীন্দ্র এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
সুব্রত আগন্তুকের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
সৌরীন্দ্রের বয়স ছাব্বিশসাতাশের মধ্যে হবে, গায়ের রং একটু চাপা। পিতা মিঃ সরকারের। মতই বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা। পরিধানে দামী ধুতি, গায়ে দামী শাল। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। দেখলেই মনে হয়, একটু বাবু গোছের। চোখের কোল দুটো ফোলা ফোলা–বোধ হয় কাঁদছিলেন।