এরপর যাঁরা বাইরে ছিলেন, তাদের মধ্যে সুবিমলবাবু, গগনবাবু ও বিনয়েন্দ্রবাবু। সুবিমলবাবুর মুভমেন্ট সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, রাত্রি দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত তিনি Rainbow Cub থেকে বের হয়ে পার্ক সার্কাসে এক বিখ্যাত জুয়ার আড্ডায় ছিলেন। গণেনবাবু সিনেমা থেকে ফিরে তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তার কারণ তিনি জেনেছিলেন, তার বাবা আর একটা নতুন উইল করেছেন। সেই সম্পর্কে জানতে, অন্য কোন কারণে নয়। আর রাত্রি সাড়ে বারোটায় তিনি বাড়ি ফিরে যান।—খুন হয়েছে তার পরে সেকথা ময়নাতদন্তেই প্রকাশ হয়েছে। বাকি থাকলেন আমাদের বিনয়েবাবু। বিনয়েন্দ্রবাবুই খুনী—সেকথা প্রমাণিত হয়েছে। গোড়া থেকেই আমি বিনয়েন্দ্রবাবুকে সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু কেন?
বিনয়েবাবুর একটা চমৎকার অ্যালিবাই ছিল। সেটা হচ্ছে ঐ রাত্রে তিনি বরাহনগরে বন্ধুর বাসায় বিবাহ-উৎসবে মেতেছিলেন। রাত্রি বারোটা পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। আগে থেকেই তার প্ল্যান ঠিক করা ছিল। প্ল্যান অনুযায়ী তিনি ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এসে বাথরুমের বাইরে অপেক্ষা করেন। রাত্রি সাড়ে বারোটার পর তিনি বাথরুম দিয়ে এসে দাদার লাইব্রেরি ঘরে প্রবেশ করেন। তার দাদা তখন লাইব্রেরি ঘরে বসে পড়ছেন। তিনি পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করে থাকেন। গজেনবাবু শয্যায় শুয়ে ঘুমোবার পর বিনয়েন্দ্রবাবু তার দাদাকে বিষপ্রয়োগ করেন। তিনি কিছুদিন ডাক্তারি পড়েছিলেন, ও বি.এস-সি পাস ছিলেন। কোন্ বিষের কেমন ক্রিয়া তার পক্ষে জানা খুবই সম্ভব। তাই খুন হবার পর মিঃ সরকার যখন শয্যা থেকে মাটিতে পড়ে যান, তাড়াতাড়ি তখন তিনি মৃতদেহ তুলে নিয়ে লাইব্রেরি ঘরে চেয়ারের উপরে বসিয়ে দেন। রামচরণের আসতে একটু দেরি হয়েছিল, তার মধ্যেই বিনয়েন্দ্রবাবু কাজ হাসিল করে আত্মগোপন করেন। রামচরণ ঘরের মধ্যে খুঁজলেই বিনয়েন্দ্রবাবুকে দেখতে পেত।
যা হোক, তারপর বিনয়েন্দ্রবাবু সোজা বারান্দা দিয়েই নিজের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করেন। অশোকবাবু ঘুমিয়ে পড়লে তার সিরিঞ্জটা চুরি করে নিয়ে আবার দাদার ঘরে এসে প্রবেশ করেন এবং মৃতদেহের হার্টে পাংচার করে আবার নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজা দিয়ে অশোকবাবুর ঘরে যান এবং সিরিঞ্জটা রেখে আসেন। সকলকে একটা ধোঁকা দেবার জন্য। সমস্ত ঘড়িগুলো রাত্রি দুটোর সময় বন্ধ করে নীচের সিঁড়ি দিয়ে যখন পালাতে যান, তখন গোপালের চোখে পড়ে যান। তাড়াতাড়ি আবার উপরে চলে আসেন। বাধ্য হয়েই তাকে তখন। যে পথে তিনি এসেছিলেন, সেই পথেই আবার পালাতে হয়। যদিও এতখানি দায়িত্ব নেওয়া তার পক্ষে খুবই দুঃসাহসের কাজ হয়েছিল তার উচিত ছিল লাইব্রেরি ঘরের দরজা দিয়েই বের হয়ে যাওয়া। তাই আমার মনে হয়েছিল, দরজা কেন বন্ধ? ওটা বন্ধ থাকা তো উচিত ছিল না?
আবার তিনি ট্যাক্সিতে করে বরাহনগরে বিবাহ-বাড়িতে ফিরে যান ও সকালে ফিরে আসেন। দুটো কারণে তাকে আমি সন্দেহ করি। এক নম্বর, খুনের পদ্ধতি ও দুনম্বর, তিনি নিজে একজন আর্টিস্ট। তার পক্ষে সুবিমলবাবুর হাতের লেখাটা নকল করে একটা চিঠি লেখা অসম্ভব কিছুই ছিল না। এবং করেও ছিলেন তাই। যাতে সুবিমলের ওপর সন্দেহটা পড়ে। কিন্তু কেন তিনি খুন করলেন? টাকার লোভে! সৌরীনের বিবাহের সংবাদে নিজে আত্মগোপন করে নেকড়ের থাবাকে দিয়ে তার সাহায্যে নিজের ভাইপোকে তিনি শোষণ করছিলেন এবং তিনিই ষড়যন্ত্র করে সৌরীন্দ্রবাবুর মেয়েকে চুরি করেন। ইচ্ছা ছিল সময়মত সৌরীনের কাছ থেকে ঐ মেয়েকে দিয়ে আরও কিছু শোষণ করবেন। কিন্তু ভাগ্যচক্র ঘুরে গেল—সব ভেস্তে গেল। অতি লোভে তাঁতী নষ্ট হল। তাই আমি সেদিন বলেছিলাম, খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে!
আমার কাজ শেষ হয়েছে। বিনয়েন্দ্রবাবুকে সুব্রতর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সুব্রত ওঁকে দেবে ধর্মাকিরণের হাতে তুলে। সেখানে হবে ওঁর বিচার। আর সৌরীনবাবু, আপনার মেয়েটিকে সুব্রত নেকড়ের থাবার কবল থেকে উদ্ধার করেছে। সে এখন তার মার কাছে। কালই সকালে তাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন। আচ্ছা আসি, নমস্কার। চল রে, সুব্রত, তালুকদার রইলেন, উনি ওঁর অতিথির সংবর্ধনা করবেন! বন্ধু, বড় চাল চেলেছিলে কিন্তু একটা কথা তুমি ভুলে গিয়েছিলে যে আমি কিরীটী রায়!