অশোকবাবু তার মামাকে যথেষ্ট ভালবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি জানতেন মামার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ তিনি পাবেন। এক্ষেত্রে তিনি মামাকে খুন করতে যাবেনই বা কেন? অন্তত কোন বিবেচক বুদ্ধিমান ব্যক্তি তা করে না এবং মানুষের সাধারণ সাইকোলজিও তা বলে না। তার উপর প্রত্যেকেরই জবানবন্দীতে প্রকাশ পেয়েছে, অশোকবাবুর স্বভাব ধীর স্থির ও শান্ত। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ হচ্ছে, রাত্রে গোপাল এসে তার ঘর থেকে যে সময় থালা নিয়ে যায়, ঠিক সেই সময়েরই কিছু পরে মিঃ সরকার খুন হন। যে লোক একটু পরে খুন করতে যাবে, সে ঐভাবে নিশ্চিন্তে খেতে পারে না। কিন্তু তবু তার প্রতি সন্দেহ একটু থেকে যায়। এখানে আমি বেনিফিট্ অব্ ডাউট-এর পক্ষ নিয়েছি। যা হোক, অশোকবাবুকে বাদ দিলে এরপর যাঁর কথা মনে পড়ে–তিনি হচ্ছেন সৌরীন্দ্রবাবু।
সৌরীন্দ্রবাবুর নিজস্ব জবানবন্দীতে ও অন্যান্য সকলের জবানবন্দী থেকে যতটুকু আমরা জেনেছি, তা থেকে কী প্রমাণ হয়? সৌরীন্দ্রবাবুর পক্ষে তার পিতাকে খুন করা এতটুকুও সম্ভব ছিল না। তার কারণ অনেকগুলো। এবারে সেগুলোই একটার পর একটা আলোচনা করব। প্রথমত, সৌরীন্দ্রবাবু ছিলেন অত্যন্ত খেয়ালী ও উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির। যে টাকা মাসোহারা হিসাবে তার বাপের কাছ থেকে তিনি পেতেন, তা দিয়ে তার হাতখরচ কুলাতো না। উচ্চুঙ্খল জীবনের অভিশাপ ঐখানেই। কোন উপায়েই কোথাও শান্তি নেই। টাকার জন্য তিনি জুয়া খেলতেন, রেসে যেতেন পর্যন্ত। দিনের পর দিন অধঃপতনের পথে নেমেই চলেছিলেন। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ এগারো বৎসর আগে একবার তিনি শিমুলতলায় বেড়াতে গিয়ে এক বন্ধুর বোনকে বাড়ির সকলের অজান্তে রেজেস্ট্রি করে বিবাহ করেন। বিবাহ করবার ২০২২ দিন বাদেই তিনি অকস্মাৎ গা-ঢাকা দিয়ে সরে পড়েন। শিমুলতলায় উনি ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন। কিছু দিন পরে উনি ওঁর স্ত্রীর এক চিঠিতে জানতে পারেন যে ওঁর স্ত্রীর সন্তান হবে, তখন উনি স্ত্রীকে নিয়মিত যে মাসোহারা দিতেন, তাও বন্ধ করে দেন। ওঁর একটি কন্যাসন্তান জন্মায়।
সহসা এমন সময় গণেনবাবু বলে উঠলেন, সে কি সৌরীন্দ্র, তুই বিয়ে করেছিস, এ কথা তো কাউকে বলিস্ নি! আর বিয়ে যখন করেছিলি, তখন বৌমাকে ঘরে আনিস নি কেন?
সৌরীন্দ্রবাবু একেবারে নিশূপ। একটি কথাও মুখে নেই।
কিরীটী এবারে সোজাসুজি সৌরীন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কী সৌরীন্দ্রবাবু, আমার কথা ঠিক না?
হ্যাঁ।
এ কথা এতদিন গোপন করে রেখেছিলেন কেন?
বাবার বকুনির ভয়ে। তাছাড়া আমি নাম ও জাত দুটোই গোপন করে বিবাহ করেছিলাম।
সে যা হোক, আপনি জানেন আপনার স্ত্রী ও কন্যা কোথায়?
স্ত্রী কোথায় আছে তা জানি, কিন্তু ছয় বৎসর হল কন্যার কোন সংবাদ জানি না।
কন্যার সংবাদ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন?
করেছি, কিন্তু কোন সন্ধানই পাইনি। শুনেছি ছয় বৎসর আগে কে বা কারা তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে।
আপনার এ বিবাহের কথা আর কেউ জানত?
না।
না সৌরীন্দ্রবাবু, আপনি ঠিক জানেন না, আরো একজন এ সংবাদ জানত।
কে সে?
আপনার কাকা বিনয়েন্দ্রবাবু! কী বিনয়েন্দ্রবাবু, আপনি জানতেন না?
বিনয়েন্দ্রবাবু কোন জবাব দিলেন না। নিঃশব্দে বসে রইলেন।
আপনার বাবার মৃত্যুর দিন রাত্রে কী ব্যাপার নিয়ে আপনার সঙ্গে আপনার বাবার ঝগড়া। হয়েছিল সৌরীন্দ্রবাবু?
বাবাকে আমি আমার বিবাহের কথা বলেছিলাম বলে সেই কথারই জের টেনে তার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়। বাবাকে ঐ কথা বলায় বাবা একটা নতুন উইল করেন এবং সে উইলের লেখাপড়া ঐদিনই শেষ হয়। বিকালে বাবা বলেন, সে উইলে আমার ভাগের সমস্ত সম্পত্তির চার ভাগের তিন ভাগ কাকার নামে ও বাকি এক ভাগ আমার স্ত্রীর নামে লিখে দিয়েছেন।
এতদিন সেকথা গোপন করে রেখেছিলেন, হঠাৎ আবার সে কথা বলতে গেলেন কেন?
নেকড়ের থাবা আমাকে ব্ল্যাকমেল করে আমার জীবন্ত করে তুলেছিল। তার খাই মেটাতে গিয়ে আমাকে রেস খেলতে হত, জুয়া খেলতে হত। অবশেষে আর না পেরে বাবার কাছে সব কথা স্বীকার করেছিলাম।
হুঁ, ব্যাপারটা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেল। তাই বলছিলাম, সৌরীন্দ্রবাবুর পক্ষে তাঁর পিতাকে খুন করা খুবই সম্ভব ছিল। তিনি থাকতেন পাশের ঘরে। অনায়াসেই যে কোন সময়ে। এসে তার বাবাকে খুন করে আবার তিনি চলে যেতে পারতেন। কিন্তু খুন করবার পদ্ধতি দেখে বোঝা যায়, যে খুন করেছে সে বিজ্ঞানে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে। কিন্তু সৌরীন্দ্রবাবুর পক্ষে ওভাবে খুন করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সৌরীন্দ্রবাবু ও অশোকবাবুর মধ্যে কেউ একজন যদি ঐ ব্যালকনি-পথে এসে খুন করতেন, তবে দুজনের একজন জানতে পারতেনই। কথাটা চাপা থাকত না। সৌরীন্দ্রবাবু তার বাবাকে খুন করলে ক্ষতিগ্রস্তই হতেন, মিঃ সরকার থাকলে হয়তো কোনও একদিন তার মত বদলাত—ব্যাপারটা সহজ হয়ে আসত। সেক্ষেত্রে উনি তার বাবাকে খুন করে সব দিক নষ্ট করতে যাবেন কেন?
এরপর আসা যাক্ রামচরণের কথায়। রামচরণকে এক কথায় আমি বিশ্বাস করেছিলাম। সে বলেছিল, রাত্রি দেড়টার সময় শব্দ শুনে সে ঘরে এসে উঁকি দেয়। সত্যিই যদি সে খুনী হতো, তবে সে অত সহজে ও কথাটা বলতে পারতো না। তাছাড়া মিঃ সরকারের মৃত্যুতে তার যা লাভ, বেঁচে থাকলেও তাই। তবে সে পুরাতন মনিবের প্রাণ নিতে যাবে কেন?