তাহলে তুমি বলতে চাও, খুনী বাইরে থেকে এসেছিল? ঠিক যতটুকু বলেছি তার বেশী কিছুই আমি বলতে চাই না সুব্রত! বাকিটা তোমাকে ভেবে দেখতে হবে। বিচার করে দেখতে হবে কার পক্ষে খুন করা সম্ভব! আগেই তোমাকে একটা কথা বলেছি, যে খুন করেছে সে মিঃ সরকারের পরিচিত এবং সে ঐ বাড়ির সব কিছুর সঙ্গে একান্ত পরিচিত। কিন্তু সেকথা বলবার আগে আমি একটা ছোটখাটো experiment করতে চাই। আজ রাত্রে মিঃ সরকারের ঘরে সেই experiment হবে। বলতে বলতে কিরীটী চক্ষু মুদ্রিত করে সোফায় হেলান দিয়ে নীরব হল।
২৫. মিঃ সরকারের শয়নকক্ষ
মিঃ সরকারের শয়নকক্ষ। রাত্রি দুটো বাজতে আর মাত্র মিনিট পনের-যোল বাকি। মিঃ সরকারের শয়নকক্ষে সকলেই এসে জমায়েত হয়েছেন। কিরীটী, সুব্রত, তালুকদার, সুবিমল চৌধুরী—মৃত মিঃ সরকারের জ্যেষ্ঠপুত্র গণেন্দ্র, কনিষ্ঠপুত্র সৌরীন্দ্র, ভাই বিনয়ে, ভাগ্নে অশোক, ভৃত্য রামচরণ আর গোপাল।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখেই একটা গভীর উত্তেজনার কালো ছায়া যেন থমথম করছে। কিরীটী তার হস্তধৃত জ্বলন্ত সিগারে একটা টান দিয়ে বললে, ভদ্রমহোদয়গণ, কেন আজ এই গভীর রাত্রে আপনাদের এখানে সমবেত করেছি তার জবাব এখনি পাবেন। আপনারা সকলেই মৃত মিঃ সরকারের আত্মীয়। পুলিসের লোকদের ধারণা, মিঃ সরকার খুন হয়েছেন। আপনারা প্রত্যেকেই হয়ত হিতাকাঙ্ক্ষী। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আপনারা সকলেই চান যে হত্যাকারী ধরা পড়ুক। আমি হত্যাকারীকে ধরিয়ে দেব।
কিন্তু তার আগে একটা জিনিস আপনাদের দেখাতে চাই। আপনাদের ধারণা, মিঃ সরকার যখন চেয়ারে বসে এই লাইব্রেরি ঘরে অধ্যয়নে রত ছিলেন, সেই সময় কেউ তাকে সিরিঞ্জের সাহায্যে হার্টে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করেছে। কিন্তু আমার ধারণা, আসলে ব্যাপারটা তা নয়। বলতে বলতে কিরীটী তালুকদারকে ডাকলে। তালুকদার সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকে এসে ঐ ঘরে প্রবেশ করলেন। তালুকদারের দিকে তাকিয়ে ঘরের সব কটি প্রাণীই বিস্ময়ে যেন হতবাক হয়ে গেল। তালুকদার একেবারে নিখুঁতভাবে মৃত মিঃ সরকারের ছদ্মবেশে সুসজ্জিত হয়ে এসেছেন।
কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। তালুকদারকে চোখ টিপে ইসারা করতেই তিনি গিয়ে মিঃ সরকারের শয্যার ওপরে শুয়ে পড়লেন। তাঁর বাঁহাতের কড়েআঙুলে একটা পট্টি বাঁধা।
তালুকদার ঘুমের ভান করে চোখ বুজে পড়ে রইলেন শয্যার ওপরে। এমন সময় পা টিপে টিপে সুব্রত শয্যার কাছে এগিয়ে গিয়ে চটপটু তালুকদারের আঙুলের পট্টিটা খুলে পকেট থেকে একটা শিশি বের করে কী একটা জলীয় পদার্থ সেখানে ঢেলে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে তালুকদার হঠাৎ যেন চমকে উঠে প্রবল মোড়ামুড়ি দিয়ে ধপ করে খাট থেকে মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে গেলেন।
তখন সুব্রত চকিতে তালুকদারকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরি ঘরে চেয়ারের ওপরে বসিয়ে দিল। পরে পকেট থেকে সিরিঞ্জটা বের করে যেমন তার বুকে বিধতে যাবে, সহসা ঘরের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে একজন আর্তস্বরে চীৎকার করে উঠল, আমি-আমিই খুনী! আমাকে গ্রেপ্তার করুন! কিন্তু আমাকে খুন করতে বাধ্য করেছিল কে— নেকড়ের থারা! হ্যাঁ, নেকড়ের থাবা! বলতে বলতে বক্তা উঠে দাঁড়াল।
ঘরের সব কটি প্রাণীর ব্যাকুল দৃষ্টি তখন যেন তীক্ষ্ণ শরের মতই বক্তার উপরে গিয়ে পড়েছে।
কিরীটী কঠিন আদেশের সুরে বললে, বসুন, ছটফট করবেন না! অধীরও হবেন না। আপনি যে খুনী, তা আমি প্রথম দিনেই টের পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রমাণের অভাব এবং উদ্দেশ্য বা মোটিভ খুব স্ট্রং মনে না হওয়ায় আপনাকে সেদিন আমি ধরিনি। দিগেনবাবু, আসুন ঘরের মধ্যে! আসামীর হাতে হাতকড়া লাগান।
দরজায় অপেক্ষমাণ পুলিশের দারোগা দিগেনবাবু ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে অপরাধীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন।
ঘরের সব কটি প্রাণী যেন বিস্ময়ে একেবারে বোবা বনে গেছে। কারও মুখে টু-শব্দটি পর্যন্ত নেই। একটা অখণ্ড নিস্তব্ধতা যেন সমগ্র ঘরখানির মধ্যে মৃত্যুর মতই থমথম করছে।
২৬. আমি কিরীটী রায়
কিরীটী এবারে সকলকে ধীর গম্ভীর স্বরে সম্বোধন করে বললে, এবার আমি আপনাদের সকলকে বলবো, কেমন করে আমি খুনের কিনারা করলাম! এই খুনের ব্যাপারে একটা কুশ্রী চক্রান্ত জট পাকিয়ে আছে। এবং সেই চক্রান্তের জের টেনে আমাকে অতীত ইতিহাসের মধ্যে যেতে হবে। কিন্তু তারও আগে আমি বিশ্লেষণ করে বলব, প্রথম দিনই কেমন করে আমার চোখে ধরা পড়েছিল খুন করা কার পক্ষে বেশী সম্ভব! এক্ষেত্রে আপনারা প্রত্যেকেই মিঃ সরকারের খুনের ব্যাপারে সন্দেহের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন, কেননা মিঃ সরকারের মৃত্যুতে আপনারা প্রত্যেকেই টাকার দিক থেকে লাভবান হন!
প্রথমেই ধরা যাক, সেরাত্রে এই বাড়িতে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন—সৌরীন্দ্রবাবু, অশোকবাবু, রামচরণ—সর্বপ্রথমেই ধরা যাক অশোকবাবুর কথা। অশোকবাবু একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। তার পক্ষে বিষপ্রয়োগ করে মিঃ সরকারকে খুন করা এতটুকু অসম্ভব ছিল না। উইল অনুসারে তিনি মিঃ সরকারের মৃত্যুতে লাভবান। অশোকবাবু অনায়াসেই নিজের ঘরের ব্যালকনি দিয়ে সৌরীন্দ্রবাবুর ব্যালকনিতে এসে, তারপর সেখান দিয়ে মিঃ সরকারের ব্যালকনিতে এসে মিঃ সরকারকে খুন করতে পারতেন। কিন্তু তার জীবনী আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, চিরকাল তিনি মামার অনুগ্রহেই লালিত-পালিত। তাই মামার মৃত্যুতে তিনি লাভবান হলেও তাঁর পক্ষে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কেন?