জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী?
ঐ নামেই বিবাহ হয়েছিল?
হ্যাঁ।
ও নামটা যে তার ছদ্মনাম, কবে আপনি জানতে পারেন?
আমার সন্তানের জন্মের মাস দুই আগে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কোন একটা বিশেষ সাংসারিক গোলযোগে তিনি আমাকে তখন তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারছিলেন না, পরে সব মিটে গেলে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন। তবে প্রত্যেক মাসে আমাকে দেড়শত টাকা করে ভরণপোষণ বাবদ দেবেন বলেছিলেন। শিমুলতলাতেই তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় এবং বিবাহের কুড়ি দিন বাদেই তিনি হঠাৎ আমাদের কাউকে কোন কিছু না বলে কোথায় চলে যান। তার ঠিকানা আমার কাছে ছিল। মাস পাঁচেক নিয়মিত টাকাও পেয়েছি। কিন্তু। দশ-বারাখানা চিঠি লিখে একখানারও জবাব পাইনি। ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে পরে জেনেছিলাম সেখানে উনি থাকেন না। সেটা একটা মনোহারী দোকান। তারপর হঠাৎ তার টাকা আসাও বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর?
তারপর আর তার কোন খোঁজই আজ পর্যন্ত পাইনি।
না।
দাদার এক জমিদার বন্ধু ছিলেন— তার নাম বিনয়েন্দ্র সরকার। তারই দয়ায় আমি চাকরি পাই। নমিতা দেবী একে একে তার এ কয় বৎসরের জীবন কাহিনী বলে গেলেন।
আপনার মেয়েটির আর কোন সন্ধান পাননি?
না।
আপনার মেয়েটি যখন চুরি হয়, তখন তার বয়স কত ছিল?
ছয় বছর হবে।
আজ চার বছর সে চুরি গেছে?
হ্যাঁ, প্রায় পাঁচ বছর হবে।
আপনার মেয়ের নাম কি ছিল?
বাবলু। নমিতা দেবীর চোখের কোল দুটি অতীত স্মৃতির দোলায় ঝাপসা হয়ে ওঠে।
এমন সময় সহসা কিরীটী বাবলুকে সামনে টেনে এনে নমিতা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে, দেখুন তো, এই মেয়েটিকে আপনি চিনতে পারেন কিনা?
কে—কে? কে এই মেয়েটি? নমিতা দেবী অধীর আগ্রহে বাবলুকে বুকের ওপরে দু হাত বাড়িয়ে টেনে নিলেন।
পাগলের মতই তিনি মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ হাসি-কান্নায় যেন দুলে উঠলেন, এই তো, এই তো আমার মেয়ে। কোথায় পেলেন একে? বাবলুবাবলু সোনা।
মা–মা-মণি!
কিছুক্ষণ বাদে কিরীটী উঠে দাঁড়াল, আজ তাহলে আসি, নমিতা দেবী। আপনার স্বামীর পরিচয় শীঘ্রই আমি আনব। কিন্তু তার আগে, আপনাকে লেখা আপনার স্বামীর কোন চিঠি যদি আপনার কাছে থাকে, তবে সেটা দিলে আমার খুব সুবিধা হয়।
আছে—প্রথম দুখানা চিঠি এখনও আমার কাছে আছে। এখুনি এনে দিচ্ছি।
২৪. আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে বের হয়ে
আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে বের হয়ে কিরীটী ক্লাইভ স্ট্রীটে মিঃ সরকারের অ্যাটর্নীর অফিসে গিয়ে প্রবেশ করল এবং কিছুক্ষণ ধরে অ্যাটর্নীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে যখন সে অ্যাটর্নী-অফিস থেকে। বের হয়ে এল, বেলা তখন প্রায় দুটো। অ্যাটর্নী কলকাতায় ছিলেন না, তাই এর আগে কিরীটী তার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।
টালিগঞ্জের বাড়িতে ফিরে এসে কিরীটী দেখলে, বাইরের ঘরে একটা সোফার ওপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে সুব্রত।
কিরীটীর পায়ের শব্দে সুব্রত চোখ মেলে তাকাল, এত দেরি হল যে?
সব কাজ সেরে এলাম। তুই কতক্ষণ এসেছিস?
প্রায় ঘন্টাখানেক।
মিঃ বি. সরকারের শয়নঘর ও লাইব্রেরিঘর যা চাবি দেওয়া ছিল—সেটা নিয়ে এসেছিস তো?
হ্যাঁ।
সকলকেই আড়ালে ডেকে আলাদা আলাদা করে বলে এসেছিস তো যে ও-ঘরের মধ্যে যেন কেউ না ঢোকে?
হ্যাঁ। তারপর তোমার কাজ কতদূর এগুলো?
প্রায় কমপ্লিট। শুধু সামান্য একটু একত্সপেরিমেন্ট আজ রাত্রে যা বাকি। ব্যস, তারপরই খুনী ধরা পড়বে। তুই বোস, চট্র করে আমি স্নানটা সেরে আসছি—অনেক আলোচনা করবার আছে।
কিরীটী বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
***
সামনে ধূমায়িত চায়ের দুটো কাপ।
কিরীটী বলছিল, প্রথম দর্শনে কেসটা আমার বেশ জটিল বলেই মনে হয়েছিল। তার অবিশ্যি কারণ ছিল তিনটি ১নং মৃত ব্যক্তি চেয়ারে বসে ছিল কেন? মানে ঐ চেয়ারে বসা অবস্থায় ছিল কেন? ২নং, মিঃ সরকারের হাতঘড়িটা ভাঙল কি করে? আর ৩নং কারণ, সহজ দৃষ্টিতে বিচার করে দেখতে গেলে খুন করবার যে মোটিভ মিঃ সরকারের উইলের দ্বারা লাভবান হওয়া, তা ওবাড়ির প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব ছিল। কেন আমি একথা বলছি, কারণ ও বাড়ির প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব ছিল খুন করা!
কারণ প্রথম দর্শনেই আমি স্থিরনিশ্চিত হয়েছিলাম, মিঃ গজেন্দ্র সরকারকে খুন করেছে ও-বাড়িরই কেউ। বাইরের লোকের দ্বারা ওভাবে মিঃ সরকারের খুন হওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না। সেকথাটা সর্বাগ্রে না বলে নিলে বাকি কথাগুলো তোমার কাছে খোলসা হবে না। সব কিছু বিচার করবার আরল আগে যে কথাটা সকলের মনেই সন্দেহের দোলা জাগাতে পারে, সেটা হচ্ছে মিঃ সরকারের মৃত্যু কী করে ঘটেছিল! ডাক্তারের ময়নাতদন্তের বিবরণ থেকে যা প্রকাশ হয়েছে, তা থেকে আমরা জানি বা জানতে পেরেছি, মিঃ সরকারের মৃত্যু ঘটেছে আনুমানিক মধ্যরাত্রিতে অর্থাৎ বারোটা-একটার মধ্যে। এবং তীক্ষ্ণ হাইড্রোসায়নিক অ্যাসি বিষে তার মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। অ্যানালিসিস করে তাই পাওয়া গেছে।
তার বক্ষের ফিফথ ইনটারকস্টাল স্পেসে যে পাংচার-উন্ড দৃষ্ট হয়, সেটার তাৎপর্য মৃত্যুর কারণের পরে কিছুই নেই। অন্য লোককে বিপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওটা স্রেফ একটা ধোঁকা মাত্র এবং হয়েছিলও তাই। তুমি তদন্ত করতে গিয়ে সেই ক্ষতচিহ্নটিকে নিয়েই বেশি মাথা ঘামাতে শুরু করেছিলে। সিরিঞ্জের ইতিহাস ও তার গুঢ় তত্ত্ব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলে। আসলে ঐ সিরিঞ্জটাও খুনীর ইচ্ছাকৃত আর একটা চাল এবং নিজের ঘাড় থেকে অন্য এক নির্দোষীর ঘাড়ে খুনের দায়টা চাপিয়ে দেবার জন্য একটা উৎকৃষ্ট উদ্ভাবিত পন্থা মাত্র।