হেলায় রাখিলে ফেলে কার্য নাহি হয়।
চকিতে কি একটা কথা সুব্রতর মনে পড়তেই সুব্রত চট করে পকেট থেকে আজ সকালে প্রাপ্ত চিঠিখানা টেনে বের করে চিঠিটা খুলে ফেললে।
হ্যাঁ, অবিকল তার সন্দেহই ঠিক। একই কালি। চিঠির কালিই ব্যবহার করা হয়েছে বইয়ের পাতাতেও, দুটো কালি হুবহু একই রংয়ের।
সুব্রত অতঃপতর ব্যাপারটা তালুকদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
তালুকদার সেই চিঠি রামায়ণের পাতার আন্ডারলাইন করা কালির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে বললেন, হ্যাঁ, একই কালি বলে মনে হচ্ছে!
কিন্তু আমি কি ভাবছি, জানেন তালুকদার?
কি?
এই জনৈক বন্ধুটি কে?
দেখা যাক না এঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। জনৈক বন্ধুটির সম্পর্কে এঁরা কেউ কিছু বলতে পারেন কিনা!
এদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু জানা যাবে কিনা বলতে পারি না তালুকদার, তবে আমার মনে হচ্ছে, চিঠি যিনি লিখেছেন তিনি সরকার পরিবারের বিশেষ কোন পরিচিতজনই হবেন।
আমার কিন্তু একটা সন্দেহ হচ্ছে সুব্রত!
কি?
চিঠি যিনি লিখেছেন তিনি এই হত্যা-ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত না হলেও এই হত্যা-ব্যাপার সম্পর্কে তিনি অনেক কিছুই জানেন।
অসম্ভব নয় কিছু।
নচেৎ তোমার চিঠিপ্রাপ্তি ও ঐ চৌধুরী না কে, তার এখানে আজ সকালে আবির্ভাবের ব্যাপারটা–
একটা অদৃশ্য যোগযোগ হয়তো আছে।
জবানবন্দী কি শুরু করব? তালুকদার প্রশ্ন করলেন।
তার আগে একবার ওপরের তলাটা ভাল করে ঘুরে দেখে নিলে হত না?
বেশ তো চলুন। আমি অবিশ্যি ইতিপূর্বে একবার দেখছি।
উপরের তলায় সর্বসমেত সাতটি ঘর।
সুব্রত তালুকদার সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে বারান্দায় এল। প্রথমেই যে ঘরখানা পরে সেটা মিঃ সরকারের ছোট ছেলে সৌরীন্দ্রের শয়নকক্ষ।
সৌরীরে ঘর থেকে মিঃ সরকারের ঘরে আসতে হলে বারান্দায় এসে তবে অন্য ঘরে যাওয়া যায়। দুই ঘরের মধ্যবর্তী কোন যাতায়াতের পথ নেই,
সৌরীন্দ্রের ঘরের পরেই মিঃ সরকারের ভাগ্নে অশোকের ঘর। সৌরীন্দ্রের ঘর থেকে যেমন লাইব্রেরিতে যাতায়াতের কোন পথ নেই,—তেমন অশোকের ও সৌরীন্দ্রের পরস্পরের ঘর থেকেও পরস্পরের ঘরে যাতায়াতের কোন পথ নেই।
অশোকের ঘরের পাশেই বিনয়ের ঘর—মিঃ সরকারের বৈমাত্রেয় ছোট ভাই।
অশোক ও বিনয়ের ঘরের পরই মিঃ সরকারের খাসভৃত্য রামচরণের ঘর। রামচরণের ঘরের পাশ্ববর্তী ঘরটি খাওয়ার ঘর বা ডাইনিং হল।
গজেন্দ্রের শয়নকক্ষ, লাইব্রেরি, সৌরীন্দ্র ও অশোকের ঘরের পিছনদিকে এক একটি করে ছোট ব্যালকনি আছে। ঐদিকটাই বাড়ির পশ্চাৎদিক।
বাড়ির পশ্চাৎভাগে একটা সরু গলি। গলির ওপাশে একটা মস্ত বড় পোড় মাঠ। মাঠের ওদিকে খানকয়েক বস্তি-ঘর চোখে পড়ে। গজেন্দ্রের শয়নঘরের পিছনদিকে একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বরাবর নীচে চলে গেছে। ওই সিঁড়ি দিয়ে মেথর যাতায়াত করে। গজেন্দ্রের ঘর থেকে ঘোরানো সিঁড়ির দরজাটা সর্বদাই ঘরের ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। তখনও ছিল।
অশোক মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তার ঘরভর্তি শেলফে সব মোটা মোটা ডাক্তারি বই। ঘরের এক কোণে পার্টিশন দিয়ে সে ছোটখাটো একটা ল্যাবরেটারি মতও করেছে।
এককালে সে কেমেস্ট্রির ছাত্র ছিল। ডাক্তারি পড়তে পড়তে এখনও সে কেমিস্ত্রির চর্চা করে। ইচ্ছা ডাক্তারি পাস করবার পর এম. এস-সিটাও দেবে কেমিস্ট্রিতে।
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সে। দিনরাত নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ছোটখাটো শিশি, বোতল, ফ্লাস্ক, টেস্টটিউব, বুনসেন বার্নার, মাইক্রোসকোপ ইত্যাদিতে তার ছোট ল্যাবরেটারিটি ভর্তি। শিয়রের পাশে ছোট একটা টীপয়। টীপয়ের ওপরে একটা সোনার রিস্টওয়াচদুটো বেজে বন্ধ হয়ে আছে!
সুব্রত একান্ত কৌতূহলবশে অশোকের ল্যাবরেটারিটি দেখতে লাগল।
হঠাৎ তার নজরে পড়ল, ল্যাবরেটারির টেবিলের এক পশে একটি ফাইভ সি. সি.-র রেকর্ড সিরিঞ্জ এবং সিরিঞ্জটার সঙ্গে লাগানো একটা মোটা নিল। সিরিঞ্জটা তুলে পরীক্ষা করতেই দেখা গেল, সিরিঞ্জটার মধ্যে খানিকটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সূঁচ পরানো সিরিঞ্জটা সিরিঞ্জের বাক্সের ওপরে রাখা।
সুব্রত আস্তে আস্তে সিরিঞ্জ থেকে নিটা খুলে, নিক্স ও সিরিঞ্জটা একটা কাগজে মুড়ে নিজের পকেটে রেখে দিল। একটা কথা চকিতে তার মনে হয়, ঐ সিরিঞ্জ ও নিডলের সাহায্যই নেওয়া হয়নি তো! সিরিঞ্জের মধ্যস্থিত জমাটবাধা রক্তটুকু অ্যানালিসিস করলেই হয়তো ব্যাপারটার ওপরে আলোকসম্পাত হবে। সুব্রত মনে মনে ভাবে, দুটো সূত্র পাওয়া গেল—এক, চিঠির ডিপ ভায়োলেট কালি। দুই, সিরিঞ্জ।
ঐসময় ভৃত্য এসে সংবাদ দিল, মিঃ সরকারের জ্যেষ্ঠ পুত্র গণেন্দ্র সরকার এসেছেন। সুব্রত কিন্তু কোন জবাব দিল না। তার মনের মধ্যে তখন অন্য এক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সুব্রত লক্ষ্য করেছিল, ঘরের পিছনের ব্যালকনিগুলি এত কাছে কাছে যে একটা ব্যালকনি থেকে অন্য ব্যালকনিতে অনায়াসেই লাফিয়ে যাওয়া যায়। তবে কী হত্যাকারী ঐ ব্যালকনি-পথেই লাইব্রেরিতে কোন এক সময় প্রবেশ করেছিল।
০৪. প্রথমেই ডাক পড়ল অশোকের
প্রথমেই ডাক পড়ল অশোকের।
লাইব্রেরি ঘরে বসেই জবানবন্দী নেওয়া শুরু হল।
অশোক ঘরে এসে প্রবেশ করল।
বেশ বলিষ্ঠ উঁচু লম্বা চেহারা। পরিধানে ঢোলা পায়জামা ও গরম ফ্লানেলের ঢোলা হাতা পাঞ্জাবি। মাথার চুলগুলি বিস্বস্ত এলোমেলো। চোখের চাউনি যেন ভীত চঞ্চল। রাত্রিজাগরণের সুস্পষ্ট আভাস চোখের কোলে।